• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
বেহিসেবি বোরো উৎসব

ছবি : সংগৃহীত

সারা দেশ

বেহিসেবি বোরো উৎসব

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ২০ মে ২০১৯

দেশে বোরো উৎসব চলছে। যদিও তাতে কৃষক আনন্দ করতে পারছেন না। ধান উৎপাদন থেকে শুরু করে কাটার মজুরি পর্যন্ত সব ব্যয় ধরে যে খরচ হয়েছে তা ধান বিক্রি করে মিলছে না। এর মাঝে কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকার বোরো ধান ও চাল ক্রয় শুরু করলেও বাজারে এর প্রভাব তেমন পড়েনি। সব মিলিয়ে কৃষক ধান চাষ করে দিশেহারা। তারা আগামীতে ধান চাষ না করার কথা জানান। তারা এও জানান, কৃষকের উৎপাদনের লাভ নিয়ে নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। 

আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—

 

বরিশালে কৃষকের মুখে হাসি নেই : সরকার বোরো ধান ও চাল ক্রয় শুরু করলেও বরিশালের বাজারে এর প্রভাব তেমন পড়েনি। বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের বাজারে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি হচ্ছে। এতে হতাশ প্রান্তিক কৃষক। তাদের অভিযোগ, প্রতি বছরই কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য খাদ্য বিভাগের মাধ্যমে ধান-চাল ক্রয় করে সরকার। তবে সরকারের এই ভর্তুকির অর্থ সাধারণ কৃষকদের পকেটে না গিয়ে মধ্যস্বত্বভোগী, ধান-চাল ব্যবসায়ী ও মিলমালিকদের পকেটে চলে যায়। এবারো তাই ঘটছে। কৃষকরা বলছেন, সরকার ২৬ টাকা কেজি দরে ১ হাজার ৪০ টাকায় প্রতি মণ ধান ক্রয় করছে। আর ৩৬ টাকা দরে ১ হাজার ৪৪০ টাকায় প্রতি মণ চাল ক্রয় করছে। কিন্তু স্থানীয় বাজারে ৪০ কেজির জায়গায় ৪৫ কেজি ধরে প্রতি মণ ধান ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি করছেন কৃষকরা।

বরিশালের উজিরপুর উপজেলার ধামুরা গ্রামের যুবক সিরাজুল ইসলাম (৩৬) এবার ৮ একর জমিতে বোরোর আবাদ করেছেন। ফলনও ভালো পেয়েছেন। তবে হাসি ফোটেনি সিরাজুলের মুখে। তিনি বলেন, বাম্পার ফলন হলেও বাজারে ধানের মূল্য কম। ৮ একর জমিতে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে বোরো আবাদ করেছি। কিন্তু ধানের যে দাম, তাতে উৎপাদন খরচ উঠবে না। লাভ ঘরে তোলা যাবে না। ধান কাটাতে মজুরি দিতে হয়েছে ৩৪ হাজার টাকা। মুখে হাসি আসবে কোথা থেকে?

সিরাজুলের মতো আরো অনেক কৃষক আছেন, যারা ধান আবাদ করে বিপাকে পড়েছেন। গৌরনদীর বার্থী গ্রামের মাসুদ সরদার (৪৬) এবার এক একরে বোরো আবাদ করেছেন। তিনি বলেন, জমি চাষ, সার, বীজ, কীটনাশক, শ্রমিক, সেচ, মাড়াইসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে প্রতি মণ ধান ফলাতে আমাদের ৮৭৫ টাকা ৭৬ পয়সা খরচ হয়েছে। কিন্তু বাজারে প্রতি মণ ধানের দাম পাচ্ছি ৪৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা। এই ক্ষতি কীভাবে পোষাব আমরা?

বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বলছে, বরিশালের ছয় জেলায় ১ লাখ ৪৬ হাজার ৮১১ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৯ লাখ ৭৪ হাজার ৭৬৩ টন ধান।

বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক তৌফিকুল আলম বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে প্রচুর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে এবং ফলনও ভালো হয়েছে। সরকার প্রতি মণ ধানের মূল্য ১ হাজার ৪০ টাকা নির্ধারণ করেছে। কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পান, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব খাদ্য বিভাগের।

আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্র জানায়, বিভাগের ছয় জেলায় ১০০ মিলমালিকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। তারা চাল সরবরাহ করবেন। শনিবার পর্যন্ত এই বিভাগে ৬২৭ টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে কোনো ধান সংগ্রহ করা যায়নি।

বরিশাল বিভাগীয় আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক রেজা মো. মোহসিন বলেন, ধান-চাল ক্রয়ের আগে মাইকিং, সাইনবোর্ড ঝোলানো, প্রচার চালানোর নিয়ম আছে। সেটা ঠিকভাবে করা হয় না বলে কৃষক জানতে পারে না- এমন অভিযোগ আছে তবে। সেটা সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা ক্রয় কমিটি দেখভাল করে।

 

নীলফামারীতে এক বিঘার ধান কাটতে লাগে ৫ মণের দাম :  এবার বোরো মৌসুমে ধানের ফলন ভালো হলেও উৎপাদন খরচের চেয়ে বাজার মূল্য কম হওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন নীলফামারীর কৃষক। জমি ও বীজ তৈরি থেকে শুরু করে ঘরে তোলা পর্যন্ত এক মণ ধানে খরচ পড়েছে অন্তত ৭৩০ টাকা। এখন বিক্রি করতে হচ্ছে ৪০০ টাকা মণ দরে।

নীলফামারী জেলায় এবার সরকারিভাবে দুই হাজার ৬৬২ টন ধান ও ১৭ হাজার ৯৬৫ মেট্রিক টন চাল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু ধান ও চাল ক্রয় এখনো শুরু না হওয়ায় ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণ করে ধান ক্রয় করছে; কৃষকরা অসহায় হয়ে পড়েছেন।

নীলফামারী সদরের ইটাখোলা ইউনিয়নের চৌধুরী পাড়ার কৃষক আইয়ুব আলীর (৫৫) নিজের আবাদি জমি নেই। মানুষের জমি ইজারা নিয়ে আবাদ করে সংসার চালান। এবার বোরো মৌসুমে আট বিঘা জমি ইজারা নিয়ে ধান চাষ করেছেন। প্রতি বিঘা জমির ইজারা বাবদ জমির মালিককে পরিশোধ করতে হয়েছে চার হাজার করে মোট এক ৩২ হাজার টাকা। ধানের চারা রোপণ থেকে শুরু করে কাটা-মাড়াই পর্যন্ত প্রতি বিঘায় তার খরচ হয়েছে ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। সেই হিসাবে এক বিঘা জমি ইজারা নেওয়া থেকে শুরু করে চারা রোপণ আর কাটা-মাড়াই পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১৭ হাজার ৫০০ টাকা। আর প্রতি বিঘায় গড়ে ধান হয়েছে ২৪ মণ। অর্থাৎ প্রতিমণ ধানের উৎপাদন খরচ ৭৩০ টাকার মতো। আট বিঘার মোট ধানের উৎপাদন খরচ এক লাখ ৪০ হাজার টাকা।

কৃষক আইয়ুব আলীর ভাষ্য, পরিকল্পনা ছিল ধান বিক্রির টাকা থেকে ধার-দেনা পরিশোধ করবেন। যেসব গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি বিক্রি করেছিলেন চাষের খরচ জোগাতে তা আবার কিনবেন। কিন্তু ৪০০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করে পেয়েছেন ৭৬ হাজার ৮০০ টাকা। লোকসান হয়েছে ৬৩ হাজার ২০০ টাকা।

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, জেলায় এবার ৮৩ হাজার ৬৪৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ইতিমধ্যে ৩০ ভাগ জমির ধান কাটা হয়েছে। জেলায় এবার সরকারিভাবে দুই হাজার ৬৬২ টন ধান ও ১৭ হাজার ৯৬৫ টন চাল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২৫ এপ্রিল থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ধান ও চাল ক্রয়ের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু সরকারি ক্রয় অভিযান এখনো শুরু হয়নি। জেলা কৃষক সমিতির সভাপতি আতিয়ার রহমান বলেন, প্রতি মণ ধান উৎপাদনে একজন কৃষকের খরচ হয় ৮০০ টাকা। সেখানে ধান বিক্রি করে পাচ্ছেন অর্ধেক টাকা। এ অবস্থায় পুঁজি হারানো কৃষক ধান আবাদ থেকে বিরত থাকবেন। এতে খাদ্য ঘাটতিতে পড়বে দেশ। তিনি বলেন, সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া সহজীকরণের জন্য প্রতিটি বড় হাট-বাজারে ক্রয় কেন্দ্র খোলার দাবি জানিয়ে আসছি। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কাজী সাইফুদ্দিন অভি বলেন, সরকারের অভ্যন্তরীণ বোরো ধান সংগ্রহ অভিযান চলবে ২৫ এপ্রিল থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। অন্যান্য অঞ্চলের ধান আগে ওঠা শুরু করলেও এ অঞ্চলের ধান দেরিতে ওঠে।

 

বগুড়ায় কষ্টের ধান লোকসানে বেচতে হচ্ছে : এবার প্রায় ১৮ বিঘা জমিতে ব্রি-২৮ ধান লাগিয়েছিলেন কৃষক রমজান আলী। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজও প্রায় গুটিয়ে এনেছেন। প্রতি বিঘায় এ জাতের ধান থেকে গড়ে ফলন পেয়েছেন ২০ মণ হারে।

ব্রি-২৮ জাতের প্রতি মণ ধান বর্তমান বাজারে ৫৮০-৬২০ টাকা ধরে কেনাবেচা হচ্ছে। সর্বোচ্চ প্রতি মণ ৬২০ টাকা ধরে হিসেব কষলে উৎপাদন অনুসারে এক বিঘা জমি থেকে ১২ হাজার ৪০০ টাকার ধান বিক্রি করা যায়। এছাড়া এই পরিমাণ জমি থেকে বড় জোর ১ হাজার টাকার খড় বিক্রি করা যায়। তবে খড় বিক্রি করতে চাইলে সেক্ষেত্রে ধান গোড়া থেকে কর্তন করতে হয়।

এভাবে এই জাতের এক বিঘা জমির ধান বিক্রি করলে সবমিলে একেকজন কৃষকের পকেটে উঠবে ১৩ হাজার ৪০০ টাকা। অথচ কৃষক রমজান আলীর দেওয়া হিসেবে অনুযায়ী ১ বিঘা জমির বিপরীতে মোট উৎপাদন ব্যয়ের পরিমাণ ১৫ হাজার ৯০০ টাকা। সঙ্গে জমি বর্গা বাবদ ব্যয় ধরলে বিঘা প্রতি সর্বমোট উৎপাদন খরচের পরিমাণ দাঁড়ায় ২০ হাজার ৯০০ টাকা। বর্গা বাবদ ব্যয় ছাড়াই এ হিসেবে প্রতিবিঘা জমির ধানের বিপরীতে আড়াই হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে একেকজন কৃষককে। ধানের দাম তুলনামূলক কম থাকায় উৎপাদিত বোরো ধানে লোকসানের কথা স্বীকার করলেও তবে কৃষকের দেওয়া হিসেব মানতে নারাজ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্য, এক বিঘা জমির বিপরীতে একেকজন কৃষকের সর্বোচ্চ সাড়ে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এছাড়া ধানের ফলনও এবার অনেক ভালো। তাই লোকসানের পরিমাণ অনেকটা কম হবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালকের কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলার ১২ উপজেলায় চলতি বোরো মৌসুমে এবার ১ লাখ ৮৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে ধান লাগানো হয়েছে। এবার জেলায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৫৪ হাজার ৪০ টন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপপরিচালক বাবলু সূত্রধর লোকসানের কথা স্বীকার করে জানান, সরকারিভাবে ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। দ্রুত বাজারে এর প্রভাবে পড়বে।

 

ধান আবাদ করে ফকির টাঙ্গাইলের কৃষক : ‘আমার ছয় লাখ টাকা ছিল। গত ছয় বছরে ধান আবাদ কইরা সব টাকা ফুরাইছি। এহন অন্যের জমিতে কামলা না দিলে খাইতে পারি না। ধান আবাদ কইরা আমি এহন পথের ফকির।’

ক্ষোভের সাথে কথাগুলো বলছিলেন টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার পাইকড়া ইউনিয়নের বানকিনা গ্রামের বর্গাচাষি মকবুল হোসেন। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘আমি এইবার ৩০০ শতাংশ জমিতে ধান আবাদ করছি। কামলার অভাবে, টাকার অভাবে ধান কাটতে পারতাছি না। ঘরের ধানের ভাত খাইয়া অভ্যাস। তাই আবাদও ছাড়তে পারি না। এইবার আমার খরচ হইছে এক লাখ টাকা। ধান পামু ১৫০ মণ। এর মধ্যে জমির মালিকের ৭৫ মণ, বর্গাচাষি হিসেবে আমার ৭৫ মণ। বর্তমান বাজার অনুযায়ী যার দাম ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা। তাইলে বাকি টাকা আমি কই পামু? আঙ্গরে এহন (আমাদের এখন) মরণদশা।’

জেলায় এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু তাতে খুশি হতে পারছেন না কৃষক। একদিকে ধানের দাম কম, অন্যদিকে শ্রমিকের মূল্য বেশি। আবার অধিক মূল্য দিয়েও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। শ্রমিকের অভাবে সময়মতো ধান ঘরেও তুলতে পারছেন না চাষিরা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, জেলায় এবার বোরো ধানের আবাদ হয়েছে এক লাখ ৭১ হাজার ৭০২ হেক্টর জমিতে। ফলনও হয়েছে ভালো।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক আবদুর রাজ্জাক জানান, এই সময়ে ধানের বাজার কিছুটা কম থাকলেও কৃষক যদি ধান সংরক্ষণ করে রাখেন তবে ক’দিন পরেই অধিক মূল্য পাবেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads