• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
‘কাটা মাথার’ গুজবে সতর্ক সরকার

ছবি : সংগৃহীত

সারা দেশ

‘কাটা মাথার’ গুজবে সতর্ক সরকার

  • হাসান শান্তনু
  • প্রকাশিত ১৩ জুলাই ২০১৯

স্বপ্নের পদ্মা রে নির্মাণ বা সেতু জোড়া লাগাতে ‘এক লাখ মানুষের মাথা কেটে রক্ত দিতে হবে’—গত কয়েক দিনে সারা দেশে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে। সেতুতে ‘কাটা মাথা লাগার’ গুজবে সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের মধ্যে কারো কারো যেন মাথায় হাত পড়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির এ যুগেও অবাস্তব, অবৈজ্ঞানিক ও অমানবিক গুজব ছড়িয়ে পড়ায় সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কেউ কেউ বিস্মিতও। ২০১৫ সালে পদ্মা সেতুুর পিলারের কাজ শুরুর সময় চীনের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের গরু জবাইয়ের রক্ত প্রবাহের একটি ছবি ব্যবহার করে এ গুজবকে ‘ভিত্তি’ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ‘কাটা মাথা লাগার’ গুজবে বিভিন্ন এলাকার মানুষের মধ্যে ভিত্তিহীন আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।

সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের সূত্র জানায়, পদ্মা সেতুু নির্মাণে শুরু থেকে দেশি ও বিদেশি নানা জটিলতা ও ষড়যন্ত্রের পথ পেরুতে হলেও এমন গুজব ছড়িয়ে পড়েছে দ্বিতীয়বারের মতো। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কোটি মানুষের স্বপ্ন ধারণ করে তিল তিল করে বেড়ে ওঠা এ সেতুর দুই কিলোমিটারের বেশি এখন দৃশ্যমান। শিগগিরই সেতুর পাইল ড্রাইভিংয়ের কাজ শতভাগ শেষ হবে বলে এ সময়টাকেই গুজব ছড়ানোর জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। ২০১৩ সালে মহাজোট সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মওলানা দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীকে কথিত চাঁদে দেখা যাওয়ার গুজব ছড়িয়ে দেশজুড়ে সহিসংতায় জড়ায় জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। তখন প্রাণ হারান ৭৮ জন। পদ্মা সেতু নিয়ে গুজব ছড়িয়ে তেমন কোনো অপতৎপরতার সুযোগ যেন না পায় গুজব রটনাকারীরা, এ বিষয়ে সরকার সতর্ক। বড় ধরনের দুর্ঘটনার আগেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সক্রিয় হওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সন্দেহ, পদ্মা সেতুুর নির্মাণকে কেন্দ্র করে সরকারবিরোধী অশুভ কোনো গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়িয়ে সামাজিক অস্থিরতা তৈরির ষড়যন্ত্র করছে। সেতু নির্মাণের চলমান কার্যক্রমকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে ‘শিশু বলির’ কথা বলে অনলাইনকেন্দ্রিক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে দেশের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়ানো ও অপপ্রচার চালানো হচ্ছে বলেও অনেকে মনে করছেন। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন সরিয়ে নেওয়া, কানাডার আদালতে ঘুষের মামলা ও দেশব্যাপী নানা নেতিবাচক প্রচারণাসহ সব সমালোচনার মুখে লাগাম পরিয়ে দেশের সবচে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতুর দৃশ্যমান কাজ এগিয়ে চলছে নতুন নতুন প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সরকারকে বিপদে ফেলতে দেশের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিতব্য পদ্মা সেতু নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছে ও অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। পদ্মা সেতুর জন্য লাখ মানুষের মাথা দরকার বলে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। উন্মাদের মতো এ ধরনের অপপ্রচার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দলীয় নেতাকর্মীদেরও সক্রিয় হতে হবে। অপপ্রচার ও গুজবের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হতে হবে। রাজপথেই শুধু আন্দোলন করলে চলবে না, সাইবার যুদ্ধেও নামতে হবে।’

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি মনে করি, পদ্মা সেতুু নিয়ে ছড়ানো এ গুজব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এসব গুজব ছড়িয়ে একটা সংঘাতের চেষ্টা চলছে।’

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কয়েক দিন ধরে ছড়িয়ে দেওয়া গুজবে বলা হচ্ছে, পদ্মা সেতুর জন্য প্রয়োজন এক লাখ শিশুর মাথা। এ জন্য সারা দেশে ৫০টি দল বিভিন্ন বিদ্যালয়ে গিয়ে ও বাড়ি থেকে অপহরণ করছে শিশুদের। এ বিষয়ে বিভিন্ন ফেসবুক আইডির টাইমলাইনে স্ট্যাটাস পোস্ট করতে দেখা গেছে। এতে অনেকেই ঘাবড়ে গেছেন। শুধু তাই নয়, এ বিষয়ে ম্যাসেঞ্জারে ইনবক্স পাঠিয়ে একে-অপরকে ‘সতকর্’ করছেন নেটিজেনদের কেউ কেউ। অনেকে না বুঝে এ রকম কুসংস্কারে গা ভাসিয়েছেন।

গুজবে এমনও বলা হচ্ছে, পদ্মা সেতুু নির্মাণের জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকার নানা বয়সী মানুষ অপহূত হচ্ছে। যদিও কোনো এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকেই কোনো অপহরণের খবর পাওয়া যায়নি। তবে আতঙ্কিত হয়ে কোথাও কোথাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে বিভিন্ন স্থানে ঘটছে গণপিটুনির ঘটনাও। গুজব ছড়ানোর অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ও আটক করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সেতু নির্মাণ বা এ রকম বড় কোনো স্থাপনা নির্মাণকাজে ‘নরবলির’ গুজব দেশে নতুন নয়। এবার ফেসবুক, টুইটার ও মুঠোফোন ইত্যাদির মাধ্যমে তাড়াতাড়ি গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। পদ্মা সেতুর জন্য মানুষের রক্ত বা মাথা লাগবে এমন গুজব বা অপপ্রচার এটাই প্রথম হয়নি। এর আগে গত বছরের আগস্টে একই রকম গুজব ছড়িয়েছিল রাজবাড়ী জেলায়। সে সময় রাজবাড়ীর সদর উপজেলায় ১৫ দিনের মধ্যে তিন নারী ও এক শিশুকে গলাকেটে হত্যার ঘটনায় গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ‘পদ্মা সেতুর জন্য রক্ত লাগবে’ বলে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটছে বলে অপপ্রচার চালানো হয় তখন।

গুজব রুখতে বসে নেই পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষও। ‘সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে’ বলে ছড়ানো গুজবে বিভ্রান্ত না হতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মধ্য দিয়ে দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জানায় পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পটির পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ পরিচালনায় মানুষের মাথা লাগবে বলে একটি কুচক্রী মহল বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে অপপ্রচার চালাচ্ছে, তা প্রকল্প কর্তৃপক্ষের নজরে এসেছে। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, এটি একটি গুজব। এর কোনো সত্যতা নেই। এমন অপপ্রচার আইনত দণ্ডণীয় অপরাধ।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পদ্মা সেতুুর নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। মূল সেতুর ২৯৪টি পাইলের মধ্যে ২৯২টি বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। ৪২টি পিয়ারের মধ্যে ইতোমধ্যে ৩০টি পিয়ারের কাজ শেষ হয়েছে। এ পর্যন্ত ১৪টি স্প্যান স্থাপন করা হয়েছে, যা এখন দৃশ্যমান। সেতুটির নির্মাণ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সাফল্যের খবরটি আসতে যাচ্ছে আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে। সেতুর সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ পাইল ড্রাইভিং কাজ শতভাগ শেষ হবে এ সময়ের মধ্যে। ফলে পদ্মা সেতুর নকশা জটিলতার কার্যকর সমাধান মেলার পাশাপাশি কাজের গতিতে দৃশ্যমান পরিবর্তন আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads