• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯
সিরাজগঞ্জে বন্যামুক্ত উভচর বাড়ি

ছবি : সংগৃহীত

সারা দেশ

সিরাজগঞ্জে বন্যামুক্ত উভচর বাড়ি

  • সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ১৮ আগস্ট ২০১৯

সিরাজগঞ্জ পৌর শহরের রানীগ্রামে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের পাশেই নির্মিত হয়েছে একটি বাড়ি।

এই ভাসমান বাড়ি বা বন্যামুক্ত বাড়িটিকে বলা হচ্ছে উভচর বাড়ি। বন্যার সময় সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকায় বাড়িঘর তলিয়ে যাওয়ায় মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আর এ দুর্ভোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য নির্মিত ভাসমান বাড়ি এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য ও আশার আলো জাগিয়েছে। বিদেশি প্রযুক্তিতে বিশেষভাবে নির্মিত ভাসমান বাড়ি বন্যার পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠবে আবার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে যথাস্থানে বসে যাবে।

১৯০০ সালে বা তারও কিছু আগে থেকে পানিতে বাড়ি তৈরির ভাবনা দানা বাঁধতে শুরু করে স্থপতিদের মধ্যে। আর তখন থেকেই গড়ে উঠতে শুরু করে সিয়াটল, ওয়াশিংটন ও পোল্যান্ড অরিগানোর মতো জলভিত্তিক শহর। বহু বছর আগে থেকে জিম্বাবুয়ে, ভারত, লাওস ইত্যাদি দেশে পর্যটন আকর্ষণ, যাতায়াত বা আনন্দ ভ্রমণে নানা ধরনের বোটহাউস ব্যবহার হয়ে আসছিল। ঐতিহ্যগতভাবে কিছু সম্প্রদায়ের লোক এখনো নৌকায় বসবাস করে। পাশাপাশি বাণিজ্যিক মাপকাঠিতেও ভাসমান বাড়ির চাহিদা এখন ব্যাপক।

তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থলের এই পৃথিবীতে মানুষের আবাস যে স্থলেই, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের এই সময়ে জীবনযাপনেও এসেছে ব্যতিক্রম উদ্যোগ। তাই মানুষ স্থলের পাশাপাশি জলেও আবাসন গড়তে উৎসাহী হচ্ছে। ইউরোপ আমেরিকায় এমন আবাসন নতুন নয়। তবে বাংলাদেশে এমন বাড়ি নতুন। সিরাজগঞ্জের যমুনার পাড়ে বন্যার সময় জলে বসবাসের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে এমনই একটি ভাসমান বাড়ি। দাবি করা হচ্ছে এটি সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তিতে তৈরি বাংলাদেশের প্রথম বন্যা প্রতিরোধক উভচর বাড়ি। তবে বন্যার পানি স্পর্শ করার আগেই গত ৭ জুলাই বাড়িটি নির্মাণ শেষে মালিক শহিদুলের স্ত্রী আছিয়া বেগমের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আট শতক জমির ওপরে দুই হাজার বর্গফুটের আধুনিক ডিজাইনের নান্দনিক স্থাপনা হিসেবে পরিচিত এই বাড়ি দেখার জন্য এ অঞ্চলের মানুষকে আকর্ষণ করছে।

পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে সিরাজগঞ্জ পৌর শহরের রানীগ্রামে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের পাশেই নির্মিত এই ভাসমান বাড়ি বা বন্যামুক্ত বাড়িটিকে বলা হচ্ছে উভচর বাড়ি। বন্যার পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটিও ভাসতে থাকবে এবং পানি সরে গেলে তা মাটিতে যথাস্থানে অবস্থান করবে। উন্নত প্রযুক্তিতে বাড়িটি নির্মাণে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে নেদারল্যান্ডস সরকারের দুই গবেষক এবং বাংলাদেশের একজন বুয়েট গবেষক। বিশেষ প্রযুক্তিতে সিরাজগঞ্জে নির্মিত বাড়িটি বাংলাদেশে প্রথম বলা হচ্ছে। তবে এর আগেও বাংলাদেশের শরীয়তপুরের শিবচরে একটি ভাসমান বাড়ি নির্মিত হয়েছে। তবে তার প্রযুক্তির সঙ্গে এ বাড়ির প্রযুক্তিগত এবং কৌশলগত ভিন্নতা রয়েছে। শরীয়তপুরের শিবচরের বাড়িটি নির্মাণে পানির ওপর খালি ড্রাম সাজিয়ে ঘর তৈরি করা হয়েছে।

এ ধরনের প্রযুক্তি বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো পরিচিতি পেতে গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করেছে আরবানাইজিং ডেল্টাস অব দ্য ওয়ার্ল্ড প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর বাংলাদেশ প্রজেক্ট এবং নেদারল্যান্ডসের আইএইচই ডেলক্ট। এদের সহযোগিতায় সিরাজগঞ্জে বেসরকারি সংস্থা সার্প এর বাস্তবায়ন করে। এই বাড়ি নির্মাণে নেদারল্যান্ডসের বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার এবং বাড়িটি নির্মাণে যে খরচ হয়েছে তার পুরোটাই নেদারল্যান্ডসের ওই প্রজেক্টই বহন করেছে। বাড়ি নির্মাণে নেদারল্যান্ডস থেকে আনা বিশেষ ধরণের ভাসমান শিট, স্থানীয় ককশিট, কাঠ ও টিন প্রয়োজন হয়েছে। বাড়িটি নির্মাণে খরচ পড়েছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। তবে বাস্তবায়নকারী সংস্থা জানায়, স্থানীয় প্রযুক্তিতে বাড়িটি নির্মাণ করলে খরচ অর্ধেকের কম হবে।

বাড়ির মালিক শহিদুল ইসলাম বলেন, ঘরটি তৈরির আগে যারা তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন; তারা যেমনটি বলেছিলেন তেমনটি করে ঘরটি তৈরি করা হয়নি। এখনো বসবাসের উপযোগী নয় এই বন্যামুক্ত বাড়ি। বাড়িটি পানিতে ভাসলেও, বৃষ্টির পানি সহজেই ঘরের মধ্যে চলে যায়। তাতে ঘরের মধ্যে থাকা কষ্ট হবে। কিন্তু বন্যা আসার আগেই বাড়িটির নির্মাণকাজ শেষ না করে তড়িঘড়ি করে উদ্বোধন করা হয়েছে। কোোন ঘরেই নেই দরজা-জানালা। আর পানির জন্য আলাদা মোটরের ব্যবস্থা থাকলেও এটি অন্যান্য জায়গায় সরবরাহের জন্য নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। এনজিও’র কোনো এক কর্মকর্তা তাকে জানিয়েছেন, ঘরের দরজা-জানালা তাকেই তৈরি করে নিতে হবে। যেটা তিনি করতে নারাজ। কেননা উঁচু ভিটায় তার টিনশেড বিল্ডিং রয়েছে। যেখানে তিনি আরামেই আছেন। তবে বন্যার সময় আশপাশের মানুষ বন্যামুক্ত বাড়িতে এলে তিনি সেখানে তাদের থাকতে দেবেন। পাশাপাশি তিনি আশা করছেন খুব শিগগিরই বাড়ির অন্য নির্মাণকাজগুলো শেষ করা হবে।

শহিদুল ইসলামের স্ত্রী আছিয়া বেগম জানান, প্রতিবছরই আমাদের এলাকায় বন্যা হয়। আর এ সময় গবাদি পশু ও পরিবার-পরিজন নিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হয়। সে সময় দুর্ভোগের সীমা থাকে না। সার্প আমাদের এই বাড়ি করে দেওয়ায় সে দুর্ভোগ থেকে এবার রেহাই পেয়েছি। তিনি জানান, তাদের এই বাড়ি দেখে এলাকার আরো অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

সার্পের নির্বাহী প্রধান মো. শওকত আলী জানান, আমাদের এলাকা বন্যাপ্রবণ। আর এই বন্যার সময় মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। এই কথা চিন্তা করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শাহ আলম খানের মাধ্যমে নেদারল্যান্ডসের প্রফেসর ক্রিস্টিয়ান জেভেনবার্গেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের প্রযুক্তি ও আর্থিক সহযোগিতায় এ বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। এই বাড়ির স্থায়িত্ব প্রায় ৫০ বছর হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, যদি সরকারের পাশাপাশি বিত্তবানরা এগিয়ে আসেন তাহলে বানভাসি অসহায় মানুষের দুর্ভোগ অনেকাংশেই লাঘব হবে।

বুয়েটের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শাহ আলম খান বন্যাপ্রতিরোধক উভচর বাড়ি তৈরির প্রযুক্তি এবং এর সুবিধা সম্পর্কে বলেছেন, বন্যা প্রতিরোধক উভচর বাড়ি তৈরি প্রযুক্তি বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো পরিচিত পেতে যাচ্ছে। যেখানে গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করছে আরবানাইজিং ডেল্টাস অব দ্য ওয়ার্ল্ড প্রকল্পের বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের কোর বাংলাদেশ প্রজেক্ট এবং নেদারল্যান্ডসের আইএইচই ডেলফট। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশে বন্যা আক্রান্ত জনগোষ্ঠী বন্যার কারণে যে আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি হয় তা থেকে দ্রুত প্রতিকার পাওয়া যায়। তিনি আরো জানান, বন্যা প্রতিরোধক উভচর বাড়ির সুবিধা হলো-এই বাড়ি বন্যার পানিতে ভেসে উঠবে এবং বন্যার পানি যখন সরে গেলে তা আবার যথাস্থানে প্রতিস্থাপিত হবে। পাইলট প্রকল্প হিসেবে কয়েক মাস আগে আট শতক জায়গার ওপর নির্মিত প্রথম দুই হাজার বর্গফুট বাড়িটি তৈরিতে প্রায় ১৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবে পরবর্তী বাড়ি নির্মাণ ব্যয় প্রথম বাড়ির ব্যয় থেকে অনেকটা কমে যাবে বলেও জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads