• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

সারা দেশ

দ্রোহের আগুনে বেড়ে উঠছে রোহিঙ্গা শিশুরা

  • এমদাদুল হক খান
  • প্রকাশিত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯

চোখের সামনে বাবা-মা বা স্বজনদের চরম নির্যাতন দেখেছে রোহিঙ্গা শিশুরা। নিজেও হয়েছে নির্যাতনের শিকার। ফলে তাদের মনে জ্বলছে প্রতিহিংসার আগুন। প্রতিনিয়ত তাদের সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। নিজেদের ফায়দা হাসিলের জন্য একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মানুষ তাদের অস্ত্র-মাদক চোরাচালানেও ব্যবহার করছে। ফলে দ্রোহের আগুনে বেড়ে উঠছে রোহিঙ্গা শিশুরা।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য রোহিঙ্গা শিশুদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়বে। তারা দিন দিন স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর একধরনের বিরূপ মনোভাব পোষণ করবে বা স্থানীয় জনগণের সঙ্গে তাদের বিবাদ বাড়তে থাকবে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, দিন দিন রোহিঙ্গারা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। পাশাপাশি তারা চুরি, হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। শিবির থেকে বেরিয়ে স্থানীয়দের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, নির্যাতিত এই শিশুরা একটি ট্রমা নিয়ে বড় হচ্ছে। একটি ক্ষত নিয়ে বেড়ে উঠছে এসব শিশু। প্রথমত মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য তাদের যে অধিকার পাওয়ার কথা— সে অধিকারগুলো রাষ্ট্র বা সমাজ থেকে পায়নি। দ্বিতীয়ত, সে যে দেশের নাগরিক হিসেবে নিজেকে দাবি করছে, সে দেশের সরকার বা কোনো একটি বাহিনী তাকে সর্বোচ্চ নির্যাতন করে সে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে। তৃতীয়ত, তার কমিউনিটির লোকজনও অনেক সময় তাদের ক্ষমতার আধিপত্য নিয়ে রোহিঙ্গা কর্তৃক রোহিঙ্গারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ফলে একটি শিশু মানুষের বিরুদ্ধে ক্ষোভ নিয়ে বড় হচ্ছে। এর ফলে যেটি হবে, পরবর্তী সময়ে নিজের অবস্থান বা নিজে বেঁচে থাকার জন্য অন্য একজনকে হত্যা, নির্যাতন কিংবা তাকে কোনো ধরনের বিপদে ফেলা- এ বিষয়গুলো করার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের মানবিক অনুভূতি তার মধ্যে কাজ করবে না অথবা এ বিষয়ে চিন্তার সুযোগ বা ক্ষেত্রটি কমে যাবে। কারণ সে দেখেছে, অন্যকে নির্যাতন না করলে আমার অবস্থান তৈরি হচ্ছে না, অন্যকে সরিয়ে দিতে না পারলে আমি ভালো থাকতে পারছি না। রোহিঙ্গা শিশুরা এ ধরনের মানবিক বিপর্যয়মূলক মনোভাব এবং মানসিকতা নিয়ে বড় হচ্ছে— এটি মৃত্যু পর্যন্ত এসব শিশুদের তাড়িত করবে। এর ফলে তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার যে সুযোগ এবং একই সঙ্গে নিজ সমাজে কন্ট্রিবিউশন করার জায়গাটি কমেই যায়। এমনকি মানুষ হিসেবে এই পৃথিবীতে অবদানের জায়গাটিতে অনীহা তৈরি হয়। এর ফলে তাদের মধ্যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড, যেমন অস্ত্রের বিষয়টি, মাদকের বিষয়টি, সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা, কাউকে হত্যা করা- এই কাজগুলোতে একসময় শিশুরা জড়িয়ে যায় নিজের অবস্থান, নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। রোহিঙ্গা শিশুরা সেই মনোভাব নিয়েই বড় হচ্ছে। ফলে রোহিঙ্গা শিশুদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়বে। ইতোমধ্যে তাদের মধ্যে ১৪টি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আছে। তাদের অধিকাংশই শিশু-কিশোর।

বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা তাদের সহায়তা করছে, কিন্তু তাদের সমস্যার সমাধান করে দিতে পারছে না। তারা মিয়ানমারের জনগোষ্ঠী এমনকি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতি একধরনের ক্ষোভ নিয়ে বড় হচ্ছে। এই ক্ষোভের কিছুটা অস্থায়ী বা সাময়িক বহিঃপ্রকাশ দেখি বাংলাদেশের টেকনাফের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর। এই ক্ষোভটি বাংলাদেশিদের ওপর নেই, এই ক্ষোভটি অন্যের ওপর, এটি তাদের ভেতর থেকে তাড়িত করছে, তাদের মোটিভ করছে, তারই বহিঃপ্রকাশ।

তৌহিদুল হক আরো বলেন, অচিরেই যদি তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো না যায়, তাহলে বাংলাদেশ সমস্যায় পড়বে। বর্তমানে তাদের যে ১৪টি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আছে, সেটি আর ১৪টিতে থাকবে না।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, গত দুই বছরে রোহিঙ্গা শিবিরে নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে নিহত হয়েছেন ৪৩ রোহিঙ্গা। এ ছাড়া ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আরো ৩২ রোহিঙ্গা নিহতের কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বাংলাদেশে প্রবেশের পর ডাকাতি, অপহরণ, ধর্ষণ, চুরি, মাদক ও মানবপাচারসহ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪৭১টি। যার মধ্যে মাদক মামলা ২০৮, হত্যা মামলা ৪৩ ও নারী সংক্রান্ত মামলা ৩১টি। এসব মামলায় আসামি ১০৮৮ রোহিঙ্গা। তাই এদের নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরো কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন স্থানীয় সচেতন মহল।

উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। বিপুল এই জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এদিকে দেশি-বিদেশি দাতা সংস্থাগুলোর কারসাজিতে বেশ কয়েকবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভুগছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। যেখানে রোহিঙ্গাদের এমন অপরাধ কর্মকাণ্ড ও সহিংস আচরণে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকেও ভাবিয়ে তুলেছে।

কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান জানান, রোহিঙ্গারা বেপরোয়া হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। স্থানীয়রা নিহত হয়েছে রোহিঙ্গাদের হামলায়। রোহিঙ্গাদের হামলার শিকার হয়েছে স্থানীয় অধিবাসী, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। স্থানীয় জনগণ রোহিঙ্গা আতঙ্কে ভুগছে। ভবিষ্যতে আরো কঠিন পরিস্থিতির শিকার হবেন স্থানীয়রা এমন আশঙ্কা করছেন।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, রোহিঙ্গারা আশ্রয় নেওয়ার পর অবস্থান যতটা নীরব ছিল, এখন তেমনটি নেই। আগে তাদের চাহিদা ছিল খাদ্য এবং চিকিৎসার। এখন রেশনের খাবার খেয়ে অলসতার কারণে তাদের মাথায় দুষ্টবুদ্ধি কাজ করে প্রতিনিয়ত। তাছাড়া ক্যাম্পগুলোতে অর্ধেকেরও বেশি যুবক। ফলে অপরাধপ্রবণতা বাড়ার কারণে আইনশৃৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে সংখ্যাগত দিক দিয়ে একটু খারাপের দিকেই যাচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। নিয়মিত টহল ও অভিযান জোরদার করেছে পুলিশ। কঠোর অবস্থান ও নজরদারিতে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে বিশাল এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads