• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

সারা দেশ

৪৬ বছরে বাকৃবিতে ১৬ খুন বিচার হয়নি একটিরও

  • বাকৃবি প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ১৩ অক্টোবর ২০১৯

ময়মনসিংহের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে গড়ে ওঠা দক্ষিণ এশিয়ার কৃষি শিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)। ছাত্ররাজনীতির নামে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঝরে গেছে ১৬টি তাজা প্রাণ। এখন পর্যন্ত এর একটিরও বিচার হয়নি।

ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা দেশে চলমান ছাত্ররাজনীতির নামে অপরাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন। কিছু কিছু শিক্ষকও একই দাবি জানান।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে বিগত ৪৬ বছরের ইতিহাসে ছাত্রসংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ১৬ জন। প্রতিটি সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ডের পর গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। তবে আজ পর্যন্ত কোনো হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনও আলোর মুখ দেখেনি।

জানা গেছে, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ছাত্ররাজনীতির জের ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষ হয়েছে শতাধিকবার। আহত হন সহস্রাধিক এবং নিহত হন ১৬ জন। প্রথম খুনটি হয় ১৯৭৩ সালে। কর্মচারী-শিক্ষক-ছাত্র সংঘর্ষে প্রথম নিহত হন রঞ্জিত। এরপর থেকে শুরু হয় হত্যার রাজনীতি। টানা ১০ বছরের শান্ত ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হয় ১৯৮৩ সালে। ওই বছরে ছাত্রদলের নেতা এ টি এম খালেদ নিহত হওয়ার জের ধরে প্রতিপক্ষের বুলেটে নিহত হন ছাত্রলীগ ও বাকসুর নেতা শওকত, ওয়ালী ও মহসিন। অতঃপর টেন্ডারবাজি, সিট দখল, বাজেট বণ্টন ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ১৯৯৩ সালে খুন হন রেজাউর রহমান সবুজ।

১৯৯৪ সালে কর্মচারীর কলেজ পড়ুয়া ছেলে, ১৯৯৫ সালে বাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আলাউদ্দিন, শওকত, কবির ও হাসান নামে চার শিবিরকর্মী এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে খুন হন কামাল ও রণজিত নামে দুই ছাত্রলীগ কর্মী। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এলে ছাত্রদল চার গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায়, যার ফলে ২০০১ সালে খুন হন ছাত্রদল নেতা হাসু।

গত বছরের ১৯ জানুয়ারি নিয়োগ বাণিজ্য, অর্থ ভাগবাঁটোয়ারা ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বাকৃবি ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে নিহত হয় পাশের গ্রামের ১০ বছরের ছোট শিশু রাব্বী। ছাত্রলীগের আন্তঃকোন্দল, গ্রুপিং, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাদকসহ বিভিন্ন কারণে সভাপতি ও সম্পাদক গ্রুপের সংঘর্ষের জেরেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি।

সর্বশেষ ২০১৪ সালের বছরের গত ১ এপ্রিল নিজ সংগঠনের নেতাকর্মীদের পিটুনিতে মারা গেছেন মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের শেষবর্ষের ক্লাস প্রতিনিধি ও আশরাফুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সায়াদ ইবনে মোমতাজ (সাদ)। সায়াদের হত্যাকরীদের বিচারের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে তিন মাস উত্তাল ছিল ক্যাম্পাস। তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন শিক্ষক সমিতির নেতাকর্মীরাও।

তবে আজও হত্যাকারীদের বিচার হয়নি, ঝুলে আছে মামলা। অনেক আসামিকে দেওয়া হয়েছে অব্যাহতি। আদৌ বিচার হবে কি না এ নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। সায়াদের বাবা ছেলে হত্যার বিচারের জন্য কোনো মামলা করেননি। তিনি অভিযোগ করে বলেছেন, ‘মামলা করব না। বিচার পাওয়া যাবে না।’

বাকৃবি ক্যাম্পাসে ১৬টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলেও একটিরও বিচার পায়নি কোনো পরিবার। সব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত রিপোর্ট হিমাগারে।

সম্প্রতি বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার পর ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, দলীয় লেজুড়বৃত্তির কারণে ছাত্ররাজনীতি সাধারণ ছাত্রদের দাবি-দাওয়া নয়, দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্যাম্পাসে দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুলেছেন অনেকে। কেউ কেউ বলছেন নিষিদ্ধ নয়, দরকার সংস্কার। শিক্ষক রাজনীতির ফলে শিক্ষকরাও সরকারদলীয় ছাত্র নেতার অপকর্মের বিরুদ্ধে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি করেন। তারা বলেন, বর্তমান লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ে বা দেশের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনছে না। বরং রাজনৈতিক ক্ষমতায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের নানাভাবে হয়রানি ও নির্যাতন করা হচ্ছে। এতে মূল রাজনৈতিক সংগঠনের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকরাজনীতিও বন্ধের দাবি করেন। তবে তারা ছাত্র সংসদ চালু রাখতে প্রশাসনের কাছে দাবি জানান।

বেশ কিছু শিক্ষক ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের দাবি করেন।

আবরার ফাহাদ হত্যার পর বাকৃবি ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে অনেক শিক্ষক কথা বলছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করছেন। আবার অনেক শিক্ষক বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।

শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, উন্নত বিশ্বের কোনো দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নেই। তারা কি চলছে না? আমাদের দেশে কি এত প্রয়োজন ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির? আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বুয়েটের মতো আমাদের ক্যাম্পাসেও ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ হোক।

বাকৃবি ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, বর্তমান ভিসি দায়িত্ব নেওয়ার পর বারবার বলেছেন ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। তিনি এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নির্দেশনা প্রদান করেন। আর হত্যার বিচারের বিষয়ে তিনি বলেন, এটি আদালতের বিষয়।

বিশিষ্ট অপরাধ বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, যেই সরকার ক্ষমতায় আসে তার দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা মূলত এসব ঘটনায় জড়িত থাকে। লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি এটার মূল কারণ। আবার দেখা যায়, এসব হত্যাকাণ্ডের অধিকাংশের বিচার হয় না। ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন হয়, পরে সেই কমিটি আর আলোর মুখ দেখে না।

তিনি বলেন, আমাদের আশার আলো হচ্ছে যে, বুয়েটের ঘটনার পর ছাত্রলীগেরও অনেক নেতা এ ঘটনার বিচার চেয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে তারাও সোচ্চার হচ্ছেন। আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমনটাই দেখছি। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন দুর্নীতির বিরুদ্ধে যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তাতে আমরা এসব ঘটনার সঠিক বিচার পাব বলে আশা করছি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads