• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

সারা দেশ

ভোলায় পুলিশ-জনতা সংঘর্ষ

সমাবেশে সায় ছিল পুলিশের ছিল না প্রস্তুতি

  • ভোলা প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ২৬ অক্টোবর ২০১৯

ফেসবুকে ‘ধর্ম অবমাননার’ অভিযোগ এনে এর প্রতিবাদে ভোলার বোরহানউদ্দিনে ডাকা সমাবেশ আয়োজনে অনুমতি ছিল না-এমন বক্তব্য এখন পুলিশ দিলেও ছোট আকারের সমাবেশে সায় ছিল তাদের। অন্যদিকে, সমাবেশের আয়োজক ‘তৌহিদী জনতার’ সংগঠকরা সেটিকে ছোট পরিসরে না রেখে বড় করেছেন। একপর্যায়ে পরিস্থিতি আর তাদের নিয়ন্ত্রণেও ছিল না। এমন আয়োজনের মৌখিক অনুমতি দিয়েও পরে ঠেকানোর প্রস্তুতি ছাড়া সমাবেশস্থলে গিয়েছিলেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এর মধ্যে পূর্বনির্ধারিত সময়ের আগে সেটি বন্ধ করে দিয়ে জনরোষের মুখে পড়ে পুলিশ।

সমাবেশের আগের রাতে ‘তৌহিদী জনতা’র সংগঠক ও প্রশাসনের বৈঠকের উপস্থিত কমপক্ষে ছয়জন ব্যক্তি এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে এমন তথ্য। এক হিন্দু তরুণের ফেসবুক আইডি ‘হ্যাক’ করে ‘অবমাননাকর’ পোস্ট ছড়ানোর পর গত রোববার বোরহানউদ্দিনের ঈদগাহ মাঠে সমাবেশ ডেকেছিল ‘মুসলিম তৌহিদী জনতা’। ওই সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশ-জনতার সংঘর্ষের একপর্যায়ে গুলি চালায় পুলিশ, নিহত হন চারজন।

প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে সিদ্ধান্তের বিষয়ে বোরহানউদ্দিন উপজেলার বাটামারার পীর মওলানা মুহিববুল্লাহ বলেন, ‘সিদ্ধান্ত হয়েছিল সমাবেশ হবে না এবং প্রত্যেকে গিয়ে তার এলাকায় জানিয়ে দেবে। তবে যারা সমাবেশ স্থগিতের বিষয় জানবে না এবং যদি তারা সমাবেশস্থলে উপস্থিত হয়েই যায়, তাহলে তাদের বুঝিয়ে পাঠানোর একটা কথা উঠেছিল। সমাবেশে বোঝানোর এ কাজ করবেন আলেম সমাজের প্রতিনিধি এবং প্রশাসনের লোক। সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন আমি মনে করিনি।

তার এমন বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায় ভোলার পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সারের কথায়ও। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা কথা বলব, এমন কথা ছিল না। হুজুররা তাদের বুঝিয়ে পাঠাবেন বলে কথা হয়।’

পরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেওয়া প্রসঙ্গে এসপি বলেন, ‘ওনাদের (মওলানাদের) অনুরোধে আমরা বক্তব্য দিয়েছি। পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেছি।’ পুলিশের অভিযোগ, শনিবার (১৯ অক্টোবর) থানায় অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সমাবেশ স্থগিতের বিষয়টি মওলানারা সভা শেষে ও নিজেদের মসজিদে ফজরের নামাজের সময় জানিয়ে দেবেন। কিন্তু তারা সেটি করেননি। উল্টো মঞ্চ তৈরি এবং ১৭টি মাইক লাগানো হয়।

সমাবেশ আয়োজকদের একজন বোরহানউদ্দিন কামিল মাদরাসার শিক্ষক মওলানা ফয়জুল আলম। তিনি বলেন, ‘পুলিশ ও প্রশাসনের লোকরা যখন আসে, তখন আমরা শুরুতে তাদের নিয়ে বসি। কাদের পক্ষে কারা বক্তব্য দেবেন, তা ঠিক হয়।’

রোববার মানুষ জমায়েত হলে তাদের উদ্দেশে প্রশাসন ও আলেম সমাজের প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেবেন, এমন সিদ্ধান্ত বৈঠকে হয়েছিল বলে জানান বোরহানউদ্দিন পৌরসভার মেয়র রফিকুল ইসলামও। প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে ধর্মীয় নেতারা আশ্বস্ত হয়েছিলেন জানিয়ে মওলানা ফয়জুল বলেন, ‘স্মারকলিপি দেওয়ার কথা ছিল, আমরা সেটি সেই রাতেই ডিসি সাহেবের হাতে তুলে দিয়েছি। আমরা আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু মানুষকে আশ্বস্ত করার স্বার্থে পরদিনের সমাবেশ করার কথা ছিল। রোববারের সমাবেশ ছোট পরিসরে থাকা এবং মিছিল না হওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল’, এমনটিও বলেন তিনি।

সমাবেশ এবং সংঘর্ষ

প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ ও সমাবেশের সংগঠকদের সঙ্গে কথা বলে এবং ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে সেদিন ভোলার বোরহানউদ্দিন ঈদগাহ মাঠে সংঘর্ষের আগে-পরে কী ঘটেছিল, তা অনুসন্ধান করে দেখা যায়, সমাবেশ ঘিরে সকাল ৯টা থেকে মাঠে উপস্থিত হতে শুরু করেন এলাকাবাসী। সাড়ে ৯টার কিছু পরে সেখানে হাজির হন পুলিশের বরিশাল রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি এ কে এম এহসান উল্লাহ, ভোলার এসপি সরকার মোহাম্মদ কায়সার, বোরহানউদ্দিন উপজেলার ভারপ্রাপ্ত ইউএনও হাসিবুল হাসান রুমি।

আগের বড় সমাবেশ আয়োজনে না করার বিষয়ে সম্মতি দিলেও মঞ্চ বানানোর পাশাপাশি অন্তত ১৭টি মাইক সেখানে লাগানো হয়। মসজিদে সমাবেশ আয়োজকদের সঙ্গে প্রশাসনের বৈঠকের পর বসে কারা বক্তব্য দেবে, তা ঠিক হয়।

ওই সমাবেশস্থলের ঠিক পেছনে বাড়ি কুয়েতপ্রবাসী আবদুল হাইয়ের। ‘কী হয় তা দেখার জন্য’ মাঠে উপস্থিত হয়েছিলেন বলে জানান তিনি। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আবদুল হাই বলেন, সকাল ১০টার দিকে সমাবেশ শুরু হয়ে তা সাড়ে ১০টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। যারা সেখানে উপস্থিত ছিল তাদের অধিকাংশ মাঠ ছেড়ে যায়। এ সময় সেখানে উপস্থিত লোকজন প্রশাসন ও হুজুরদের উদ্দেশে হট্টগোল করতে থাকে। এর মধ্যে উত্তর বাসস্ট্যান্ড এবং বোরহানউদ্দিন বাজারের দিক থেকে দুটাি মিছিল এসে আবার মাঠ পূর্ণ হয়ে যায়।’

নির্ধারিত সময়ের আগে সমাবেশ শেষ করে দেওয়াই হট্টগোলের মূল বিষয় ছিল বলে জানান ঘটনার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী। মোহাম্মদ ফজলু নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘পরিস্থিতি খারাপ দেখে পেছনে স্কুলের ভেতরে গিয়ে আশ্রয় নিই। দেখি মাঠের মধ্যে পুলিশ সদস্যদের ঘেরাও করে ফেলছে। পরে পুলিশ সদস্যরা মসজিদের ওপরের তলার দুটি কক্ষে গিয়ে অবস্থান নেন।’

সংঘর্ষের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় সাংবাদিক এইচ এম এরশাদ বলেন, ‘মসজিদের ওপরের দুই রুমে দৌড়ে এসে পুলিশ কর্মকর্তা ও অন্য সদস্যরা অবস্থান নেন। এ সময় নিচ থেকে প্রচুর ইটপাটকেল ছোড়া হয়। তখন উত্তেজিত লোকজন ওপরের দিকে চলে আসতে চাইলে মাদরাসাছাত্রদের বাধার মুখে পড়ে এবং তখন পুলিশ ফাঁকা গুলি ‍ছুড়লে দূরে সরে যায়।’

পুলিশের প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন

সমাবেশের অনুমতি না দিলে তা ঠেকানোর জন্য পুলিশের যথেষ্ট প্রস্তুতি ছিল না বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। বোরহানউদ্দিনের একজন কলেজশিক্ষক বলেন, ‘ভিডিও ফুটেজ দেখলেই বুঝবেন, মাত্র ১৫ থেকে ২০ জন পুলিশ সদস্য ছিল। যে পরিস্থিতি এলাকায় ছিল, তা প্রতিরোধে পুলিশের প্রস্তুতি কোনোভাবে যথেষ্ট ছিল না। এ কারণে গুলি করে থামাতে হয়েছে তাদের। যত সময় ধরে ঝামেলা আর সংঘর্ষ হয়েছে, তাতে খুব সহজেই ভোলা থেকে অতিরিক্ত ফোর্স আনা যেত। কিন্তু তা আমরা দেখিনি।’

তবে প্রস্তুতি ‘যথেষ্ট ছিল’ বলে দাবি করেছেন ভোলার পুলিশ সুপার সরকার কায়সার। তিনি বলেন, ‘যথেষ্ট প্রস্তুতি ছিল না, তা ঠিক নয়। আমাদের ৪০ জনের ফোর্স ছিল। ২০ জন সামনে এবং ২০ জন পেছনে। কিন্তু মানুষের উপস্থিতির কারণে পেছনের ২০ জন ইন-অ্যাকটিভ হয়ে গিয়েছিল।’

অতিরিক্ত পুলিশ আনার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অতিরিক্ত ফোর্স আসেনি, তা ঠিক নয়। তারা এসেছিল, কিন্তু উত্তর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় মানুষের বাধার কারণে আসতে পারেনি।’

দোয়া মাহফিল স্থগিত

নিহতদের স্মরণে গতকাল শুক্রবারের সর্বদলীয় মুসলিম ঐক্য পরিষদের ব্যানারে যে দোয়া মাহফিল ডাকা হয়েছিল, তা স্থগিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে সংগঠনটির যুগ্ম সদস্য সচিব মওলানা মিজানুর রহমান জানান, প্রশাসনের অনুমতি না পাওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads