• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও দুর্গাপুরে মুক্তিযুদ্ধের স্থানগুলোতে হয়নি স্মৃতিসৌধ

প্রতিনিধির পাঠানো ছবি

সারা দেশ

স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও দুর্গাপুরের মুক্তিযুদ্ধের স্থানগুলোতে হয়নি স্মৃতিসৌধ

  • রিফাত আহমেদ রাসেল, দুর্গাপুর (নেত্রকোণা) প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ০৬ ডিসেম্বর ২০১৯

আজ ৬ ডিসেম্বর দুর্গাপুর মুক্তদিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে হানাদার মুক্ত হয় নেত্রকোণার সীমান্তবর্তী এই উপজেলা। কিন্ত দেশ স্বাধীনের ৪৯ বছরেও এখন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের স্থানগুলোতে করা হয়নি কোনো স্মৃতিসৌধ আর মার্যাদা পাইনি গণকবরগুলো। ফলে মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাস জানা থেকে অনেকটাই বঞ্চিত হচ্ছে নতুন প্রজন্মরা। তবে মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণে দ্রুত কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। 

মেঘালয়ের গারো পাহাড়ের ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি নেত্রকোনার দুর্গাপুরের বিজয়পুর। অপার সম্ভাবনার এই এলাকা দেশ বিদেশের মানুষের কাছে পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিচিতি পেলেও  ৭১'এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় এখানেই ছিল পাকবাহিনীর শক্তিশালী একটি ঘাটি। চারিদিকে বড় বড় পাহাড় আর ঘন বনজঙ্গল পাকবাহিনীদের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে দাড়ায়। তবুও ক্যাম্পের চারপাশে অসংখ্যা বাংকার তৈরি করে ভারি অস্ত্রপাতি দিয়ে সুরক্ষিত ছিল পুরো ঘাটি। তৎকালীন পাক হানাদার বাহিনীর মেজর সুলতানের নেতৃত্বে দুর্গাপুরের বিরিশিরি থেকেই বাংলার কুখ্যাত দালাল, আলবদর, রাজাকারদের সহযোগিতায় নিয়ন্ত্রণ করতো দুর্গাপুর সদর, বিজয়পুর, কলমাকান্দার সীমান্ত এলাকা লেংগুরা ও নাজিরপুর এলাকার ক্যাম্পগুলো। তবে বিজয়পুরের পাক বাহিনীর ক্যাম্পটি জন্য পাক বাহিনীর মূল ঘাটি।

দেশ স্বাধীনের লড়াকু সৈনিক সাবেক সাংসদ মরহুম জালাল উদ্দিন তালুকদার, মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু এমপি সহ প্রায় ১২৫ জনের একটি দল ভারতের মেঘালয়ের বাঘমারা ও তুরায় প্রায় এক মাস পাঁচ দিন প্রশিক্ষণ নেয়। পরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সন্তোষ বিশ্বাসের নেতৃতে বিজয়পুর থেকে পাকবাহিনীদের বিতাড়িত ও তাদের ঘাটি দখল করতে মুক্তিযোদ্ধারা হামলা চালায়।

এটিই ছিলো দুর্গাপুরের মুক্তিযোদ্ধের প্রথম সম্মুখযুদ্ধ। এই যুদ্ধে টানা কয়েক ঘণ্টা পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধদের গুলিবিনিময়ের এক পর্যায়ে পাকবাহিনী গুলি করা বন্ধ করে দেয়। এই সময় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সন্তোষ বিশ্বাস জয় বাংলা উচ্চারণ করে এগিয়ে আসতে থাকলে আবারো পাকবাহিনী গুলি করা শুরু করে। পাকবাহিনীর ছোরা একটি টু-ইঞ্চ মর্টার গুলি এসে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সন্তোষ বিশ্বাসের মাথায় আঘাত করলে তখনই তিনি মৃত্যুবরণ করে। আহত হন মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্রাশফায়ারে নিহত হন পাক বাহিনীর ১০ সেনা। মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ সন্তোষ বিশ্বাসের মরদেহটিকে বর্তমান বিজয়পুর বিজিবি ক্যাম্প থেকে ১ কিলোমিটার দূরে ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি একটি জঙ্গলে ধর্মীয় রীতি মতে তাকে দাহ করা হয়।

এরপর দফায় দফায় বিজয়পুরে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে হামলা চালায় মুক্তিযোদ্ধারা। পাকবাহিনীদের ভারি অস্ত্রপাতির কাছে বেগ পেতে হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের। কিন্তু দেশে প্রতি ভালোবাসা আর সহযোদ্ধাদের হারানোর বেদনায় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হাটেনি। সর্বশেষ  ৫ শে ডিসেম্বর রাতে চারদিকে ঘেরাও করে আবারো বিজয়পুরে হামলা চালায় মুক্তিযোদ্ধারা। সারারাত মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীদের লক্ষ করে গুলি করতে থাকে। এতে ভেঙ্গে যায় পাকবাহিনীর সকল বাংকার নিহত হয় তাদের বেশিরভাগ সৈনিক। শেষ পর্যন্ত আর কোনো পথ না পেয়ে বিজয়পুর ক্যাম্প ছাড়তে বাধ্য হয় পাকসেনা। ৬ শে ডিসেম্বর ভোরে বিজয়পুর থেকে বিরিশিরিতে পালিয়ে যায় পাকসেনা। পরে বিরিশিরিতে মুক্তিযোদ্ধের অবস্থান টের পেয়ে ময়মনসিংহতে পালিয়ে পাকসেনারা। এর মাঝে মুক্তিযোদ্ধারা দুর্গাপুরে দখল করে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে দুর্গাপুরকে হানাদার মুক্ত দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

 

তবে দেশ স্বাধীনের ৪৯ বছর হলেও এখন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধের এই স্থানগুলোতে করা হয়নি কোনো স্মৃতিসৌধ। পাশাপাশি যুদ্ধ চলাকালীন ভারতের বাঘমারা আশ্রয় ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া শত শত বাঙ্গালী মারা যায় তখনকার মহামারি কলেরায়। কলেরা মারা যাওয়া ও অনেক মুক্তিযোদ্ধে শহিদেও একত্রে একটি গণকবর তৈরি করে দাফন করা হয় এই বিজয়পুরেই। কিন্তু আজ কালের বিবর্তনে অনেক গণকবর হারিয়ে গেছে নদীগর্ভে। আর কিছু ঘন জঙ্গলে অবহেলায় পড়ে আছে। ফলে বর্তমান নতুন প্রজন্মের কাছে অনেকটাই অজানা এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাস। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বার বার বিজয়পুরে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবী জানিয়ে আসলেও তা আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।

এদিকে দুর্গাপুরের একটি শহীদ মিনার যা শহীদ সন্তোষের নামানুসারে করা হলেও সেটিও অব্যবস্থাপনা আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হুমকির মুখে রয়েছে। দুই বছর ধরে ভেঙ্গে পরে আছে শহীদ মিনারের মূল প্রবেশদ্বার। ফলে বাস-ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহন ভেতরে ঢুকে নষ্ট করে ফেলেছে মাঠের বেশ কিছু অংশ। আবার পাশপাশের বাড়ি-ঘরের নিয়মিত ময়লা আবর্জনা ফেলায় ও পথচারীদের পয়:নিষ্কাশনে দূষিত হচ্ছে শহীদ মিনারের পরিবেশ।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল সাবেক ডেপুটি কমান্ড সোহরাব হোসেন তালুকদার জানায়, এই যুদ্ধটা ছিলো আমাদের জন্য অনেক কঠিন। এই বিজয়পুরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। তেমনি আহতও হয়েছেন অনেকে। আমরা অনেক বার প্রশাসনের কাছে দাবী জানিয়েছি আসছি এখানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই স্থানে কেনো স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়নি।

কুল্লাউড়া ইউপি চেয়ারম্যান সুব্রত সাংমা বলেন, এই কুল্লাউড়া ইউনিয়ন একটি পর্যটন এলাকা। পাশাপাশি এখানের মহান মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাস ও একটি গণকবর রয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা এই গণকবরটিকে চিন্তিত করেছি। আসলে এখানে কোনো স্মৃতিসৌধ নির্মাণের মতো অর্থ আমাদের নেই। এখানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ হলে স্থানীয়দের পাশাপাশি বাইরে থেকে পর্যটকরা এসেও এখানকার মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads