• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
আরাধ্যের ট্রফিতে বিশ্বকাপ টনিক

ছবি : সংগৃহীত

ক্রিকেট

আরাধ্যের ট্রফিতে বিশ্বকাপ টনিক

  • মাহমুদুন্নবী চঞ্চল
  • প্রকাশিত ১৯ মে ২০১৯

লাকি সেভেন বলেই অনেকে পাখির চোখ করেছিল। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। অতীত ছয় ফাইনালের চেয়েও কঠিন ছিল মালাইহাডের পরিবেশ। টার্গেট ২১০, মাত্র ২৪ ওভারে। এমনিতেই চীনের প্রাচীর টপকানোর মতো অবস্থা। তার ওপর ফাইনাল নামক দুর্বোধ্য ধাঁধা। যে ধাঁধার উত্তর খুঁজতে গত এক যুগ ধরে গলদঘর্ম বাংলাদেশ। হয়ে হয়ে হচ্ছিল না। নিঃশ্বাস দূরত্বের শিরোপা আচমকা নিয়ে যাচ্ছে প্রতিপক্ষ। চোখের সামনে দেখতে হয়েছে ট্রফি নিয়ে প্রতিপক্ষদের উন্মত্ত উল্লম্ফন। টাইগারদের চোখে তখন জল। ভক্তদের হূদয় এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেওয়ার অনুভূতি।  এশিয়া কাপ থেকে নিদাহাস টুর্নামেন্ট, একটি ট্রফির জন্য কত আকুলতা, কত প্রার্থনা; তা প্রত্যক্ষ করেছে সবাই। অবশেষে স্বপ্নপূরণ, তাও সুদূর আয়ারল্যান্ডে।

দ্বিপাক্ষিক অনেক সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। প্রবল শক্তিশালী দলগুলোকে ধবলধোলাইয়ের লজ্জাও দিয়েছে ম্যাশ ব্রিগেড। কিন্তু ত্রিদেশীয় সিরিজ কিংবা বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে একটি ট্রফি ছিল অধরা। সেই স্বপ্ন ধরা দেবে বিরূপ কন্ডিশনের আয়ারল্যান্ডের মাটিতে? তা অনেকেই ভাবেনি। কারণ স্বাগতিকদের দাপট তো ছিলই, সঙ্গে চোখ রাঙাচ্ছিল ক্যারিবীয়রাও। রাউন্ড রবিন লিগ পর্বের শুরু থেকেই কন্ডিশনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মাশরাফিদের উত্তুঙ্গ পারফরম্যান্স আশার পালে লাগাচ্ছিল জোর হাওয়া। বিশ্বকাপের আগে একটি ট্রফি জয়ের স্বপ্নের ডালপালা ছড়াচ্ছিল দ্রুত বেগে।

প্রথমে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে উড়িয়ে মিশন শুরু। দ্বিতীয় ম্যাচ আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে পণ্ড বেরসিক বৃষ্টিতে। তৃতীয় ম্যাচে আবারো জয় ক্যারিবীয়দের বিরুদ্ধে। ফাইনাল নিশ্চিত তখনই। নিয়মরক্ষার ম্যাচে বাংলাদেশের কাছে পাত্তা পায়নি আয়ারল্যান্ড। ধারেভারে, পরিসংখ্যানে সব দিক থেকেই ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ম্যাচটি যখন ফাইনাল, শঙ্কার কালো মেঘ ছিল শুরু থেকেই। দলের প্রাণভোমরা সাকিব আল হাসান ছিলেন না, যা ছিল বড় ঘাটতি।

টস হেরে ক্যারিবীয়দের ঝড়ো গতিতে রান তোলা সেই শঙ্কা জোরালো করে। তারপর হঠাৎ বৃষ্টিতে সব ভজকট অবস্থা। ২০.১ ওভারে তখনই উইন্ডিজের সংগ্রহ বিনা উইকেটে ১৩১। একটা হিসাব তখন পরিষ্কার ছিল, বৃষ্টিতে আর খেলা না হলে বেশি জয়ের সুবাদে চ্যাম্পিয়ন হবে বাংলাদেশ। কিন্তু এভাবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মধ্যে গৌরব নেই। টাইগারদের এমন মনোবাসনায় হয়তো কৃপা হয় বৃষ্টি দেবতার। আর সে কারণেই সোয়া পাঁচ ঘণ্টা রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরির পর ম্যাচ নেমে আসে ২৪ ওভারে। ব্যাট করতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সংগ্রহ ১ উইকেটে ১৫২।

কিন্তু ২৪ ওভারেই বাংলাদেশের টার্গেট দেখে অনেকের চক্ষু চড়ক গাছ। করতে হবে ২১০ রান। ডার্কওয়ার্থ ও লুইস সাহেবদের দ্বারা সৃষ্ট বৃষ্টি আইনের গুষ্টি উদ্ধার করছে তখন ভক্ত-সমর্থকরা। কিন্তু মাঠে কাজটা করতে হবে ক্রিকেটারদের। কঠিন সেই কাজটি করে দেখালেন সবাই। মালাইহাডে রচিত হলো নতুন ইতিহাস। সৌম্যের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে আসে জয়ের ভিত্তি। মাঝে পকেট ডায়নামো মুশফিকের খণ্ড অথচ গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস। শেষটা তো মোসাদ্দেকময়। বাহারি শটে সাজানো ২৪ বলে ৫২ রানের ঝলমলে ইনিংস। বাংলাদেশ জয় পায় সাত বল হাতে রেখে।

অথচ বল-রানের সমীকরণ একসময় বেশ কঠিনই ছিল। শঙ্কা জাগছিল না জানি, দুই চার রানে হেরে আবারো কান্নায় শামিল হয় গোটা টাইগার শিবির। ২১ ওভার শেষে বাংলাদেশের রান ছিল ৫ উইকেটে ১৮৩। ১৮ বলে তখন জয়ের জন্য দরকার ২৭ রান। ২২তম ওভারে দৃশ্যপট ভোজভাজির মতো পাল্টে দিলেন এক মোসাদ্দেকই। অ্যালেনের বলে টানা দুই ছক্কা, এরপর চার, চতুর্থ বলে আবার ছক্কা। এই ওভারেই আসে ২৫ রান। জয় তখন হাতের মুঠোয়। ১৬ বলে দরকার ২ রান। রেইফারের ওভারে দেখেশুনে আগানো মাহমুদউল্লাহ চতুর্থ বলে হাঁকালেন বাউন্ডারি। বাকিটা ইতিহাস।

জয়ের ভিত্তি গড়ে দেয় সৌম্যর ৬৬ রানের ইনিংস। ম্যাচসেরার পুরস্কারটি তিনি পাননি। পেয়েছেন শেষ বেলায় ঝড় তুলে অপরাজিত থাকা মোসাদ্দেকই। প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক কোনো ম্যাচে সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃত, সঙ্গে ট্রফি জয়। নিজেকে চরম ভাগ্যবান ভাবতেই পারেন মোসাদ্দেক।

আর কদিন পর শুরু হবে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ। যেখানে থাকছে বাংলাদেশও। বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার আগে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের এই ট্রফি টনিক হিসেবে কাজ করবে বহুলাংশে। যদিও বিশ্বকাপ আলাদা মঞ্চ। যেখানে চাপ থাকবে অনেক। কিন্তু অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ যে অসম্ভব ধারাবাহিক পারফরম্যান্স দেখাল ডাবলিনে, তাতে বৈশ্বিক মঞ্চে টাইগারদের নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখতেই পারে সবাই। পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যাটিং কিংবা বোলিং, সব মিলিয়ে পরিণত এক বাংলাদেশকে দেখে মুগ্ধ ক্রিকেটামোদীরা। 

ফাইনাল গেরো কেটেছে বাংলাদেশের। ট্রফি জেতার অভ্যাস শুরু হলো। মেন্টাল ব্লক বলে একটা কথা ঘুরে বেড়াত সব জায়গায়। সেটা হয়তো কাটল। অধিনায়ক মাশরাফির মতে, ‘আশা তো করি কাটল। ফাইনালে একটা জয় না আসা পর্যন্ত স্বস্তিটা আসছিল না। এখন অন্তত প্রথম জয়ের তীব্র মরিয়া ভাবটা থাকবে না, যা চাপ কমাবে। এখন আমি মনে করি, ৫টি ফাইনাল খেললে অন্তত ২টি আমরা জিতব। ৩টিও পারি জিততে। আর হারলেও হয়তো ক্রিকেটীয় কারণে হারব, মানসিক নয়।’

এই ট্রফি বিশ্বকাপে দলকে আরো মানসিকভাবে পোক্ত করল বলেও বিশ্বাস করেন নড়াইল এক্সপ্রেস। তবে বিশ্বকাপ আলাদা একটা জায়গা বলেই মানছেন তিনি, ‘নিজেদের ওপর বিশ্বাস আরো পোক্ত হলো। কিন্তু বিশ্বকাপের সঙ্গে এটার তুলনাই চলে না। অন্তত তিনগুণ কঠিন হবে বিশ্বকাপ। প্রতিটি মাঠ, প্রতিপক্ষ, পরিস্থিতি সব সামলে দীর্ঘ সময় ধরে ছন্দে থাকা খুবই কঠিন হবে। ভালো সময়, খারাপ সময় আসবে। এসবের সঙ্গে কীভাবে মানিয়ে নিচ্ছি, এটাও গুরুত্বপূর্ণ হবে।’

ডাবলিনে স্মরণীয় ট্রফি জেতা ম্যাচের নায়ক মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত অবশ্য বিশ্বকাপের আগে আত্মবিশ্বাসের জ্বালানিতে ভরপুরই থাকছেন, ‘আমরা প্রথম কাপ জিতলাম, সেটিও দেশের বাইরে। আমাদের জন্য অনেক বড় ব্যাপার। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বিশ্বকাপের আগে অনেক আত্মবিশ্বাস আমরা পেয়েছি। আমি মনে করি, আমাদের ব্যাটিং ও বোলিং ইউনিট যা আছে, এখানকার মতো খেলতে পারলে বিশ্বকাপেও ভালো কিছু করতে পারব।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads