• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
স্বপ্নপূরণের রঙিন যাত্রা

ছবি : সংগৃহীত

ক্রিকেট

স্বপ্নপূরণের রঙিন যাত্রা

  • মাহমুদুন্নবী চঞ্চল
  • প্রকাশিত ০৩ জুন ২০১৯

জয়ের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার দরকার ৬ বলে ৩৩ রান। বোলার মোস্তাফিজ। জয় দেখছে বাংলাদেশ, এমন আশা অমূলক ছিল না। তারপরও ক্রিকেট বলে কথা। যেখানে ম্যাচের পরতে পরতে থাকে চরম অনিশ্চয়তা। প্রথম বলে ছক্কা হাঁকিয়ে টেনশনটা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন রাবাদা। কিন্তু শেষটা টাইগারদের জন্য পরম সুখকর ও গর্বের। অসাধ্য সাধন করতে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। শেষ ওভারে প্রোটিয়ারা নিতে পারল মাত্র ১১ রান। লন্ডনের দি ওভালে ২১ রানের অবিস্মরণীয় এক জয়ে বিশ্বকাপ মিশন শুরু করল বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে শুরু হলো স্বপ্নপূরণের রঙিন যাত্রা।

দারুণ, অভূতপূর্ব কিংবা বিস্ময়কর। ম্যাচটি ছিল নানা রেকর্ডে ভরপুর। ব্যাটিং কিংবা বোলিং। সমানতালে মাশরাফি ব্রিগেডের দাপুটে পারফরম্যান্স। যেন পরিণত এক বাংলাদেশরই প্রতিচ্ছবি দেখা মিলল ওভালে। আগে ব্যাট করতে নেমে ৬ উইকেটে টাইগারদের রেকর্ড ৩৩০ রান। জবাবে ৮ উইকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার সংগ্রহ ৩০৯ রান। শ্বাসরুদ্ধকর এমন ম্যাচে ব্যাট হাতে ৭৫ রানের পাশাপাশি এক উইকেট নেওয়া সাকিব জিতেছেন ম্যাচসেরার পুরস্কার।

লক্ষ্যটা পাহাড়সমান। আর তাই টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে শুরুটা ডি কক ও মারক্রামের শুরুটা ছিল দেখেশুনে। কিন্তু তারপরও উদ্বোধনী জুটি ছুঁতে পারেনি পঞ্চাশ। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে রানআউট ডি কক। ৯.৪ ওভারে মিরাজের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়েছিলেন কক, তা ধরতে পারেননি মুশফিক। পরক্ষণেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেন মুশি। রান নিতে গিয়ে ধরা কক, মুশফিকের থ্রোয়ে ভাঙে স্ট্যাম্প। ২৩ রানে ফেরেন কক। বাংলাদেশ শিবিরে প্রথম উইকেট নেওয়ার আনন্দ।

ওয়ানডাউনে অধিনায়ক ডু প্লেসিস মারক্রামের সঙ্গে শক্ত জুটির আভাস দেন। তবে এই জুটি ভেঙে দলকে স্বস্তি এনে দেন সাকিব। জায়গায় দাঁড়িয়ে খেলতে চেয়েছিলেন মারক্রাম। ব্যাটে-বলে করতে পারেননি, ফিরে যান বোল্ড হয়ে। ৫৬ বলে চারটি চারে ৪৫ রান মারক্রামের।

মারক্রামকে ফিরিয়ে ওয়ানডেতে দ্রুততম পাঁচ হাজার রান ও আড়াইশ উইকেটের কীর্তি গড়েন সাকিব। আইসিসি ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ের সেরা অলরাউন্ডারের এই অর্জনে লেগেছে ১৯৯ ম্যাচ। রেকর্ডটি ছিল পাকিস্তানের আবদুল রাজ্জাকের অধিকারে। এই পেস বোলিং অলরাউন্ডারের লেগেছিল ২৩৪ ম্যাচ।

তৃতীয় উইকেট জুটিতে ভয়ংকরই কিছুর আভাস দিচ্ছিল ডু প্লেসিস ও মিলার। এবার চিত্রনাট্যে জাদুকরের ভূমিকায় মেহেদী হাসান মিরাজ। সরাসরি বোল্ড করেন ডু প্লেসিসকে। দলীয় ১৪৭ রানে পতন তৃতীয় উইকেটের। ৫৩ বলে ৬২ রানে ফেরেন প্রোটিয়া অধিনায়ক। এরপর জীবন পান ডেভিড মিলার। সাকিবের বলে মিলার ক্যাচ দিলেও লাফিয়ে তা তালুতে জমাতে পারেননি সৌম্য। কিছুক্ষণ পর মিলারের আবারো ক্যাচ, বোলার এবার মোস্তাফিজ। তবে বলের ফ্লাইট বুঝতে পারেননি মাহমুদউল্লাহ। মিস। দুই জীবন পেয়েও রক্ষা হয়নি মিলারের। ৩৫.১ ওভারে মোস্তাফিজের বলে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে সুপার ক্যাচ মিরাজের। ৪৩ বলে ৩৮ রানে সাজঘরে মিলার। দলীয় রান তখন ২০২।

নির্ভরযোগ্য ডুমিনি এলবিডব্লিউ ৩৭.১ ওভারে মোস্তাফিজের বলে। রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। ডুমিনির সঙ্গী তখন তুঙ্গে থাকা ভ্যান ডার ডসন। কিন্তু সেই ডসনের দায়িত্বটা এবার তুলে নিলেন পেস অলরাউন্ডার সাইফউদ্দিন। ৩৯.১ ওভারে উপড়ে ফেললেন স্ট্যাম্প। দুই হাতে চুমু এঁকে গোটা ওভালকে আলিঙ্গন করতে চাইলেন যেন সাইফ। টাইগার শিবিরে জয়ের সুবাস। ৩৮ বলে ৪১ রান করে ব্যর্থ মনোরথে সাজঘরের পথে ডসন।

এরপর প্রোটিয়াদের আশার পালে হাওয়া শুধু ডুমিনিই (৪৫) দিয়েছেন। মোস্তাফিজের বলে সেই ডুমিনি বোল্ড হলে আশা শেষ হয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকার। শেষের দিকে মোস্তাফিজ ও সাইফউদ্দিনের বলে সুবিধাই করতে পারেনি লেজের ব্যাটসম্যানরা। দারুণ জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ। তিন উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ শিকারি কাটার স্পেশালিস্ট মোস্তাফিজ। সাইফ দুটি, সাকিব ও মিরাজ নেন একটি করে উইকেট।

এর আগে ওভালে টস-ভাগ্য মাশরাফির ছিল না। টস জিতে দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক ব্যাটিংয়ে পাঠায় বাংলাদেশকে। শুরুটা অবশ্য ছিল ধীরলয়ে। সৌম্য সরকার সাবলীল থাকলেও তামিম বের হতে পারেননি নিজের খোলস থেকে। তারপরও উদ্বোধনী জুটি থামে ৬০ রানে। একটু বাড়তি লাফানো বল ঠিকমতো খেলতে পারেননি তামিম। ব্যাটের কানা ছুঁয়ে জমা পড়ে কুইন্টন ডি ককের গ্লাভসে। ২৯ বলে দুই চারে ১৬ রান করেন তামিম। নবম ওভারে ভাঙে ৬০ রানের উদ্বোধনী জুটি।

সৌম্য ছিলেন একটু ক্ষ্যাপাটে। বাউন্ডারি হাঁকাচ্ছিলেন বেশ। তাতেই হয়তো কাল হলো। শর্ট বলে ফিরলেন তিনি। ক্রিস মরিসের বল অ্যাঙ্গেলে বের হয়ে যাচ্ছিল। পুল করে ওড়াতে চেয়েছিলেন বাঁঁহাতি ওপেনার। গ্লাভস ছুঁঁয়ে সহজ ক্যাচ যায় পেছনে। ছুটে এসে সামনে ঝাঁপিয়ে বল গ্লাভসে জমান কুইন্টন ডি কক। ৩০ বলে ৯ চারে ৪২ রান করেন সৌম্য।

দুই ওপেনারের বিদায়ে হতাশা বাড়লেও তা সামাল দেন অভিজ্ঞ সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহিম। প্রোটিয়া বোলারদের নাচিয়ে বাড়াতে থাকেন দলীয় স্কোর। দুজনে সমানতালে তুলতে থাকেন রান। এই জুটি বিচ্ছিন্ন হয় ১৪২ রান করে। ততক্ষণে হয়ে গেছে রেকর্ডও। বিশ্বকাপের সেরা জুটি এরাই। আগেরটি ছিল ১৪১ রানের। গত বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে, মাহমুদউল্লাহ-মুশফিক।

দলীয় ২১৭ রানে বিদায় নেন সাকিব। তারকা অলরাউন্ডারকে ফেরান নিজের শততম ম্যাচ খেলতে নামা প্রোটিয়া স্পিনার ইমরান তাহির। সুইপ করতে চেয়েছিলেন। ব্যাটে-বলে হয়নি, বোল্ড। থামেন ৭৫ রানে, বিশ্বকাপে সেরা স্কোর। আগেরটি ছিল ৬৩ রান। ৮৪ বলের ইনিংসে সাকিব হাকান আটটি চার ও একটি ছক্কা। সাকিবের বিদায়ের পর মুশফিকের ইনিংস নিয়ে আশাবাদী ছিলেন অনেকে। তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগারে পৌঁছাক মুশি, সবাই চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি তিনিও। তবে তার ব্যাটে এসেছে ইনিংস সর্বোচ্চ ৭৮ রানও। তিনিও তামিমের মতো ফেলুকোয়োর শিকার। ততক্ষণে বাংলাদেশের স্কোর বরাবর ২৫০। ৮০ বলের ইনিংসে মুশফিক হাঁকিয়েছেন আটটি চার। মুশফিকের আগে অবশ্য থিতু হতে পারেননি মোহাম্মদ মিঠুন। তারপরও তার ব্যাট থেকে এসেছে ২১ বলে ২১ রান। ইমরান তাহিরকে স্লগ সুইপ করতে গিয়ে বোল্ড হন তিনি।

৪২.১ ওভারে নেই টপ অর্ডারের পাঁচ ব্যাটসম্যান। শেষের দিকে ঝড় তোলার দায়িত্বটা পড়ে অভিজ্ঞ মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে তরুণ হিটার মোসাদ্দেকের। শুরুর দিকে আঁটসাঁট বোলিংয়ে সুবিধা করতে না পারলেও আস্তে আস্তে বেড়েছে রানের গতি। শেষ পর্যন্ত তা গিয়ে পৌঁছায় ৩৩০ রানে। আর এতে ভাঙে তিনটি রেকর্ড। ২৭৮ রান ছিল এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান। বিশ্বকাপে এর আগে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দলীয় রান ছিল ৩২২/৪, ২০১৫ বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে নেলসনে। শেষটা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দলীয় রানের রেকর্ড। টপকে যায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৩২৯ রানের রেকর্ডটি।

২০ বলে ২৬ রানের ইনিংস খেলে ফেরেন মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত। তিনি হাঁকিয়েছেন চারটি চার। তবে ৪৬ রানে অপরাজিত ছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ৩৩ বলের ইনিংসে তার ইনিংস সাজানো ছিল তিন চার ও এক ছয়ে।

পারফরম্যান্সের মুগ্ধতা দিয়ে বিশ্বকাপ মিশন শুরু বাংলাদেশের। দ্বিতীয় ম্যাচে প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড। সে ম্যাচেও আসুক জয়, ঈদের আনন্দ দ্বিগুণ হোক টাইগার ভক্ত-সমর্থকদের। এমন আশা করতেই পারে এখন সবাই।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads