• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
দুর্দমনীয় সাকিব

সাকিব আল হাসান

সংগৃহীত ছবি

ক্রিকেট

দুর্দমনীয় সাকিব

  • মাহমুদুন্নবী চঞ্চল
  • প্রকাশিত ২৬ জুন ২০১৯

যতটা না বোলার, তার চেয়ে বেশি যেন ব্যাটসম্যানের আবহে মোড়া। ব্যাট হাতে চার-ছক্কার ফুলঝুরিতে জ্বলজ্বলে। বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত তিনটি ম্যাচ জিতেছে বাংলাদেশ, তিনটিতেই তার অবদান সিংহভাগ। পেয়েছেন তিন ম্যাচেই সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি। বৈশ্বিক মঞ্চে সর্বোচ্চ রানের তালিকায় শীর্ষে থাকা চাট্টিখানি কথা নয়। আবার বল হাতেও ঘূর্ণিজাদু। নানা রেকর্ডে জড়িয়ে দুর্দমনীয় গতিতে ছুটছে বাংলাদেশের গৌরব সাকিব আল হাসান। কেউ কেউ বলছেন, তিনি মানুষ নন, অতি মানব। কেউ বা ডাকছেন, বাংলাদেশের সুপারম্যান।

আসলেই তাই। হয়তো ক্যারিয়ারের সেরা বিশ্বকাপ কাটাচ্ছেন সাকিব আল হাসান। যার ফল পাচ্ছে বাংলাদেশও। ব্যাট-বলের আলোক বিচ্ছুরণে ভাঙছেন নানা রেকর্ডও। ক্রমশ নিজেকেই ছাড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি। গায়ে লাগতে শুরু করছে ক্রিকেট বিশ্বে অন্যতম সেরাদের একজনের তকমা। সাকিব-স্তুতি শুধু এখন বাংলাদেশে নয়, গোটা বিশ্বেই আলোচিত। প্রশংসা ঝরছে সাবেক-বর্তমান গ্রেটদের মুখে। আর সেটা ব্যক্তি সাকিবকে নিয়ে নয়, একজন অলরাউন্ডার হিসেবে।  

৬ ম্যাচে দুই সেঞ্চুরি, তিন ফিফটি। সর্বোচ্চ ১২৪*। মোট রান ৪৭৬। আফগানিস্তানের সঙ্গে ফিফটি করার পর চড়ে বসেছেন সর্বোচ্চ রানের তালিকায় (অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড ম্যাচের আগে হিসাব)। আফগানদের সঙ্গে ম্যাচের আগেও উইকেট সংগ্রহের তালিকায় অনেকটা পিছিয়ে ছিলেন সাকিব। তবে ম্যাচ উইনিং পাঁচ উইকেট নিয়ে দারুণভাবে ফিরে এসেছেন। ৬ ম্যাচে মোট উইকেট ১০। সাকিবের সঙ্গে মোস্তাফিজ ও সাইফউদ্দিনের উইকেটও তাই। ১৫ উইকেট নিয়ে শীর্ষে পাকিস্তানের মোহাম্মদ আমির (অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড ম্যাচের আগ পর্যন্ত)। ২৯ রানে পাঁচ উইকেট। বর্তমান বিশ্বকাপে সেরা বোলিং ফিগার, আর সেটা সাকিবেরই। সাকিবের এটি ক্যারিয়ার-সেরা বোলিংও। বিশ্বকাপে প্রথম কোনো বাংলাদেশি ক্রিকেটারের সাফল্যও। এক ম্যাচে ফিফটি ও পাঁচ উইকেট, বিশ্বকাপে এমন কীর্তি আগে ছিল শুধু ভারতের যুবরাজ সিংয়ের (২০১১ বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে)। এখন যুবরাজের সঙ্গে আছেন সাকিবও। বিশ্বকাপে এক হাজার রান ও ৩০ উইকেটের মাইলফলক-একমাত্র সাকিবের। আবার একই বিশ্বকাপে চার শতাধিক রান ও ১০ উইকেট-এমন কীর্তিও ছিল না কারো। এখন সেটাও সাকিবের। 

এই বিশ্বকাপ সাকিবের জন্য দারুণ এক উপলক্ষ। ক্রিকেটের অভিজাত মঞ্চে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব পাকাপোক্ত করার সুযোগ। ক্রিকেটের কুলীনদের ভাবনা নাড়িয়ে দেওয়ার সুযোগও। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে প্রথম উঠেছিলেন ওয়ানডে অলরাউন্ডারদের র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে। এরপর থেকে তিন সংস্করণে শীর্ষে ওঠার ধারাবাহিকতায় তার ধারে-কাছে ছিল না কেউ। একই সঙ্গে তিন সংস্করণে শীর্ষে থাকা ইতিহাসের একমাত্র অলরাউন্ডারও তিনি। তবু ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মতো জায়গায় তাকে ঠিক সেই উচ্চতায় দেখতেন না অনেকে। ধারাভাষ্যে, কলামে, মতামতে অনেকে বলতেন ‘অন্যতম সেরা’, কিংবা ‘সেরাদের একজন’ বা বড়জোর ‘বাংলাদেশের সেরা’। এই বিশ্বকাপে যেন সেই সংশয় গুঁড়িয়ে এগিয়ে চলেছেন সাকিব। ‘অন্যতম’ বা ‘সেরাদের একজন’-এই ধরনের বন্ধনীর বলয় ছিঁড়ে নিজেকে তুলে নিচ্ছেন আপন উচ্চতায়।

বিশ্বকাপে নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে সাকিবের আত্মমূল্যায়ন, ‘ভালো লাগছে। কোনো একটি লক্ষ্য থাকলে সেটি অর্জন করার একটি তাড়না থাকে। সেটি অর্জন করতে পারলে অবশ্যই ভালো লাগে।’ কী সেই তাড়না? অনুমান করে নিতে কষ্ট হয় না। এবারের আগেও বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি রান ও উইকেট ছিল সাকিবের। কিন্তু সব মিলিয়ে পারফরম্যান্স ঠিক সাকিবীয় নয়। গত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে অসাধারণ ম্যাচ জেতানো সেঞ্চুরি করেছেন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। কিন্তু অন্য ম্যাচগুলোয় ছিলেন বিবর্ণ। প্রয়োজন ছিল তাই বিশ্ব মঞ্চে চমকপ্রদ কিছু করার। পারফরম্যান্স দিয়েই নজর কাড়ার। সাকিব সেই দাবি মেটাচ্ছেন সত্যিকারের চ্যাম্পিয়নের মতোই।

একটু চোখ বোলানো যাক সাকিবের ছয় ম্যাচের পারফরম্যান্সে। বাংলাদেশের বিশ্বকাপ মিশন শুরু হয় দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচ দিয়েই। শুরুতেই বাজিমাত। বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করে ২১ রানের রোমাঞ্চের জয়ে। জয়ের নায়ক শুরু থেকেই সাকিব। ব্যাট হাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭৫ রান, বল হাতে এক উইকেট। ম্যাচ সেরা তিনিই। দ্বিতীয় ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের কাছে দুই উইকেটের আফসোসের হার বাংলাদেশের। এই ম্যাচেও ব্যাটে-বলে আলো ছড়ান সাকিব। ৬৪ রান, দুটি উইকেট। ম্যাচ হারে সব সাফল্য ম্লান।

কার্ডিফে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের কাছে ১০৬ রানের হার। এমন হারের ম্যাচেও সান্ত্বনা ছিল শুধুই সাকিব। করেন বিশ্বকাপে নিজের প্রথম সেঞ্চুরি (১২১)। এই ম্যাচে পাননি উইকেটের দেখা। এরপর প্রত্যাশিত জয়ের ম্যাচ হয়ে যায় পণ্ড। বৃষ্টির কারণে বল গড়ায়নি বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচে। পয়েন্ট ভাগাভাগি হলেও হূদয়ে রক্তক্ষরণ হয় ঠিকই টাইগার সমর্থকদের। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে পরের ম্যাচেই দুর্দমনীয় গতিতে ফেরে টিম বাংলাদেশ। রান তাড়ার রেকর্ড গড়ে জেতে ম্যাচ। সাত উইকেটে। সাকিবের ব্যাটে আসে ১২৪ রানের অপরাজিত জ্বলজ্বলে এক ইনিংস। বল হাতে দুই উইকেট। ম্যাচ সেরাও তিনি। অস্ট্রেলয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচে বড় টার্গেট ছুঁতে পারেনি বাংলাদেশ। তা-ও আসে দলীয় সর্বোচ্চ রান (৩৩৩)। এই ম্যাচেই ফিফটির দেখা পাননি সাকিব। করেন ৪১ রান। থাকেন উইকেটশূন্য। ব্যাট হাতে এদিন নিজেকে মেলে ধরেন নির্ভরযোগ্য মুশফিকুর রহিম। করেন হার না-মানা এক সেঞ্চুরি (১০২*)। কিন্তু ৪৮ রানের হারে ঢাকা পড়ে যায় সব।

অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে লড়াকু মনোভাবের প্রশংসা কুড়ানো বাংলাদেশ আগের হারের ঝাল মেটায় অহমিকায়পূর্ণ আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে। ৬২ রানের জয়ে সেমির স্বপ্ন জিইয়ে থাকা ম্যাচে সাকিব আরো জ্বলজ্বলে। ব্যাট হাতে ফিফটির পর বল হাতে সবচেয়ে বিধ্বংসী। ২৯ রানে পাঁচ উইকেট। আফগানদের ব্যাটিং দেয়াল ধসিয়ে দেন তিনিই। আসে ম্যাচ সেরার স্বীকৃতি।

বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সামনে রয়েছে আর দুটি ম্যাচ। ২ জুলাই ভারত, ৫ জুলাই পাকিস্তান। এ দুটি ম্যাচের ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের সেমির স্বপ্ন। দুটিতেই জিতলে সেমির স্বপ্ন পূরুণ হতে পারে। একটিতে জিতেও হতে পারে, তবে সে ক্ষেত্রে রয়েছে যদি-কিন্তুর সমাহার। মরণপণ এমন দুটি ম্যাচে পূর্ণোদ্যমে জ্বলে উঠুক বাংলাদেশ। ধারা বজায় থাকুক সাকিব আল হাসানের ব্যাট-বলের ঝলকানি। আর তাতে মধুর কিছু স্মৃতি পেতেও পারে টাইগার সমর্থকরা।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads