• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
একজন সংস্কৃতিযোদ্ধার বিদায়

রানী সরকার চলচ্চিত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী ছিলেন

সংরক্ষিত ছবি

ঢালিউড

একজন সংস্কৃতিযোদ্ধার বিদায়

  • সোহেল অটল
  • প্রকাশিত ০৯ জুলাই ২০১৮

রানী সরকার যখন অভিনয়ে নাম লেখান, তখন বাঙালি মুসলিম সমাজ এটাকে ভালো চোখে দেখত না। অভিনয় মুসলিমদের কাজ নয়, এটা ধর্মবিরোধী— সমাজে এই ধারণাই ছিল প্রবল। ষাট দশকের সেই সময়ে অভিনয়ের প্রতি এতটাই টান ছিল রানী সরকারের যে, নিজের নামও পরিবর্তন করে ফেলেন তিনি।

তার আসল নাম মোসাম্মৎ আমিরুন নেসা খানম। বাবার নাম সোলেমান মোল্লা, মায়ের নাম আছিয়া খাতুন। মুসলিম ঘরের মেয়ে হয়ে চলচ্চিত্রে অভিনয় করাটা সমাজ যেহেতু ভালো চোখে দেখবে না, সেজন্য সবার আগে নিজের নাম বদলালেন। আমিরুন নেসা খানম হয়ে গেলেন রানী সরকার। অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা থেকে নাম বদলানোর এমন কৌশল ওই সময়ে অন্য মুসলিম শিল্পীরাও নিতেন। রানী সরকার ছিলেন সেই সংস্কৃতিযোদ্ধা, যিনি ভালোবাসা আর সাহস নিয়ে চলচ্চিত্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছিলেন বলেই শাবানা-কবরীদের মতো উত্তরসূরিদের কাজটা সহজ হয়েছিল। চলচ্চিত্রে নারী জাগরণে রানী সরকার ও তার মতো অভিনেত্রীদের গুরুত্ব তাই ইতিহাসে অপরিসীম।

রানী সরকার চলচ্চিত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী ছিলেন। প্রায় পঞ্চাশ বছরের ক্যারিয়ারে অভিনয় করেছেন শতাধিক চলচ্চিত্রে। সবই নেতিবাচক চরিত্রে। একে তো নারী শিল্পী, তার ওপর নেতিবাচক চরিত্র। কাজটা যে কত কঠিন ছিল, তা বর্তমান সময়ে বসে কল্পনা করা যায় না। সেই কঠিন কাজটাই করেছেন রানী সরকার।

চলচ্চিত্র ও অভিনয় কলার প্রতি রানী সরকারে ভালোবাসার আরেকটা প্রমাণ পাওয়া যায় তার একাকী জীবন কাটানোর মধ্যে। বিয়ে করেননি কখনো। কারণ, বিয়ে করলে চলচ্চিত্র ছাড়তে হবে কিংবা যে চরিত্রে তিনি অভিনয় করতেন সেটা করতে পারবেন না। চলচ্চিত্রকেই নিজের পরিবার বানিয়ে ফেলেছিলেন এই শিল্পী।

আর দশজন প্রবীণ শিল্পীর মতো রানী সরকারের শেষজীবনও কেটেছে অর্থকষ্টে। অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিলেন দীর্ঘদিন। তবে তার ভাগ্য অন্যদের চেয়ে ভালো যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে যথেষ্ট অর্থ সাহায্য করেছেন। অসুস্থ রানী সরকারকে ২০ লাখ টাকার আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন তিনি। এরপর ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে তাকে আবার সরকারি তহবিল থেকে পাঁচ লাখ টাকার চেক দেন প্রধানমন্ত্রী। তার অসুস্থতা ও দুর্ভোগের কথা শুনে তিনি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে নগদ ৫০ হাজার টাকা দেন। এ ছাড়া তার বাসার জন্য গণভবন থেকে দুই বস্তা চাল, কিছু মাছ ও শাক-সবজি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।

যতদিন বেঁচেছিলেন রানী সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভালোবাসার কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর থেকেই জীবনে খানিক পরিবর্তন এসেছিল তার। কিছু কাজও করেছিলেন নাটকে। তবে তার আগে যে চলচ্চিত্র পরিবারের কথা চিন্তা করে ঘর-সংসার কিছুই করা হয়নি রানী সরকারের, সেই পরিবারের সদস্যরা খুব একটা খোঁজ নেয়নি। অর্থসাহায্য নিয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। কোনো কাজে ডাকেনি। পরশু মৃত্যুর পর শবদেহের পাশে দাঁড়িয়ে যারা টিভি ক্যামেরার সামনে বক্তৃতা দিতে দিতে ঘেমেনেয়ে উঠেছেন, হয়ত তারাও কোনো দিন অসুস্থ রানী সরকারের পাশে দাঁড়াননি।

তাতে রানী সরকারদের কিছু যায়-আসে না। তারা আসেন একেকটা বিপ্লব কাঁধে নিয়ে। দায়িত্ব পালন করে চলেও যান। কেউ নীরবে, কেউ দাগ রেখে। রানী সরকার পৃথিবী ছেড়ে গেছেন বটে; দাগ রেখে গেছেন ইতিহাসের পাতায়। বাংলা তথা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যতদিন থাকবে, নারী জাগরণের অগ্রপথিক হিসেবে, সংস্কৃতিযোদ্ধা হিসেবে লেখা থাকবে রানী সরকারের নাম।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads