• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
বরিশালে চার প্রার্থীর ভোট বর্জন

সাদিক ও সরোয়ারের ভোটের হিসাব

ছবি : বাংলাদেশের খবর

নির্বাচন

বরিশালে চার প্রার্থীর ভোট বর্জন

  • প্রকাশিত ৩১ জুলাই ২০১৮

রানা হানিফ ও কামাল মাছুদুর রহমান, বরিশাল থেকে

ভোট শুরুর চার ঘণ্টার মধ্যেই বরিশাল সিটি করপোরেশন (বিসিসি) নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন বিএনপি মনোনীত মজিবর রহমান সরোয়ারসহ অন্য তিন মেয়র প্রার্থী। ভোটগ্রহণ শুরুর আগেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী সাদিক আবদুল্লাহর পক্ষে নৌকা প্রতীকে সিল মারা, বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে বিএনপির পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়া, মেয়র প্রার্থীর ওপর হামলাসহ নানা অভিযোগে তারা নির্বাচন বর্জন করেছেন। আর প্রার্থীদের এমন ঘোষণার পরপরই ভোটারশূন্য হতে থাকে কেন্দ্রগুলো। বেলা ২টার পর থেকে কোনো কেন্দ্রেই ভোটারের তেমন উপস্থিতি লক্ষ করা যায়নি। সকাল ৮টায় ভোটগ্রহণ শুরুর প্রথম দুই-তিন ঘণ্টা বরিশাল নগরীর টাউন হল, সিটি কলেজ, সরকারি গার্লস কলেজ, সদর গার্লস স্কুল কেন্দ্রসহ অধিকাংশ কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়।

বিসিসি নির্বাচনে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী

মেয়র প্রার্থী আওয়ামী লীগের সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ সকাল ৮টার দিকে তার বাসার অদূরে কালীবাড়ি রোডের সরকারি বরিশাল কলেজ কেন্দ্রে ভোট দেন। বিএনপির মেয়র প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ার সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে ভোট দেন পশ্চিম কাউনিয়ায় তার মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত সৈয়দা মজিদুন্নেছা মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। পরে সাদিক সাংবাদিকদের জানান, জয়ের ব্যাপারে তিনি শতভাগ আশাবাদী। নির্বাচনের একমাত্র নারী মেয়র প্রার্থী বাসদের ডা. মনীষা চক্রবর্তী অক্সফোর্ড মিশন হাই স্কুল কেন্দ্রে ভোট দেন।

এদিকে বিএনপি, বাসদ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মনোনীত মেয়র প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা অভিযোগ করেন, সকাল ৯টার মধ্যেই অধিকাংশ কেন্দ্রের দখল নেয় সরকারদলীয় প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা। তারা কেন্দ্র থেকে বাকি সব দলের মেয়র প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের বের করে দিয়ে নৌকা প্রতীকে সিল মারতে থাকে।

সকাল পৌনে ৯টার দিকে সদর গার্লস কলেজ কেন্দ্রে বাসদ মেয়র প্রার্থী মনীষা চক্রবর্তী পরিদর্শনে গেলে সেখানে আগে থেকেই নৌকা প্রতীকে সিল মারা শতাধিক ব্যালট পেপার দেখতে পান। এ বিষয়ে ওই কেন্দ্রের পোলিং অফিসারের কাছে অভিযোগ জানালে কেন্দ্রে উপস্থিত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মনীষার ওপর হামলা চালায়। এ ঘটনায় পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়ে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন বাসদ প্রার্থী।

বেলা ১১টার দিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মনোনীত প্রার্থী ওবায়দুর রহমান মাহাবুবও ভোট কারচুপি, প্রশাসনের নিষ্ক্রিয় ও পক্ষপাতিত্বমূলক ভূমিকা এবং কেন্দ্র থেকে পোলিং এজেন্ট বের করে দেওয়ার প্রতিবাদে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন।

নগরের টাউন হল কেন্দ্রের সামনে ওবায়দুর রহমান মাহাবুবের পক্ষে চরমোনাই পীরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা আশরাফ আলী আকন্দ ও প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট আবদুল্লাহ আল নাসির সমাবেশ করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। তারা বলেন, সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত আধা ঘণ্টা ভোটগ্রহণ মোটামুটি ঠিক ছিল। এর পর থেকে আমাদের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়। ভোটারদের কাছ থেকে ব্যালট নিয়ে আওয়ামী লীগের লোকজন নৌকায় ভোট দিতে থাকে। ইভিএম কেন্দ্রের ডিসপ্লেতে সব প্রতীক দেখানোর কথা থাকলে শুধু নৌকা ও আওয়ামী লীগ কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রতীক সেখানে দেখানো হচ্ছে এমন অভিযোগও তোলেন তারা।

এর ঠিক প্রায় এক ঘণ্টা পর বরিশাল প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন ডেকে নির্বাচন বর্জন, বাতিল ও পুনর্নির্বাচনের দাবি জানান বিএনপির মেয়র প্রার্থী সরোয়ার। সংবাদ সম্মেলনে ধানের শীষের এই প্রার্থী বলেন, খুলনা-গাজীপুরে তো ভোট হয়েছিল। বরিশালে ভোটই হয়নি। ভোট শুরুর আগেই ৭০-৮০টা কেন্দ্রে নৌকায় সিল মেরে বাক্স ভরা হয়েছে। সব কেন্দ্র থেকে আমাদের পোলিং এজেন্টকে বের করে দেওয়া হয়েছে।

সরোয়ার বলেন, নির্বাচনে প্রশাসনের ভূমিকা ন্যক্কারজনক, আমি চারবার এমপি ও একবার মেয়র ছিলাম। স্বাধীনতা-পরবর্তী বহু নির্বাচন দেখেছি। টুকিটাকি অনিয়ম হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো সরকারের আমলে এমন নজিরবিহীন ভোট দেখিনি। এমন প্রহসনের নির্বাচন না করে সরকার এমনিতেই ঘোষণা দিয়ে নিয়ে নিতে পারত।

এদিকে বিএনপির প্রার্থীর ভোট বর্জনের ঘোষণার পরপরই বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে বরিশাল নগরী। একই সঙ্গে তিন প্রার্থীর সমর্থকরা নগরের কাকলী মোড় থেকে কোতোয়ালি থানা পর্যন্ত সদর রোডের পুরো অংশ জুড়ে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ও সড়ক অবরোধ করে রাখে। শুরুতে বিএনপির সমর্থকরা সরকার, প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। বিএনপির মিছিলটি নগর কার্যালয়ের সামনে থেকে শুরু হয়ে সদর রোড পরিদর্শন করতে থাকে। একই সময়ে বাসদের কার্যালয় থেকে মেয়র প্রার্থী মনীষা চক্রবর্তীর নেতৃত্বে আরেকটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। অন্যদিকে বিবিরপুকুর পাড় সংলগ্ন সদর রোডের পুরো অংশ অবরোধ করে রাখে ইসলামী আন্দোলনের মনোনীত প্রার্থী ওবায়দুর রহমান মাহবুবের কর্মী-সমর্থকরা।

মিছিল শেষে বাসদের প্রার্থী মনীষা সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন কমিশন ও সরকারের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের যে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল তা তারা করতে পারেনি। ভোটগ্রহণের শুরু থেকেই সরকারদলীয় সন্ত্রাসীরা কেন্দ্র দখল করে নিয়েছে। প্রশাসনের সামনে তাদের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগের সমর্থকরা নৌকায় সিল মেরেছে। নৌকায় সিল মারা ব্যালট আমরা হাতেনাতে ধরলেও পোলিং অফিসার ছিলেন নির্বিকার। আমাদের অভিযোগ তিনি আমলে নেননি। উল্টো পুলিশের সামনে সরকারদলীয় সন্ত্রাসীরা আমাদের ওপর হামলা করেছে।

দুপুর ১টার দিকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী আবুল কালাম আজাদও ভোট বর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির বহিষ্কৃত প্রার্থী মো. ইকবাল হোসেন তাপসও পুনর্নির্বাচনের দাবি জানান।

৫ মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন বর্জন ও স্থগিতের আবেদন পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান বলেন, নির্বাচন স্থগিতের এখতিয়ার আমার নেই। প্রার্থীরা যে অভিযোগ দেখিয়েছেন তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে। তারা তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

অপরদিকে সকাল থেকে সরেজমিন বরিশাল সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে কয়েকটি কেন্দ্রে জাল ভোট দেওয়া ও প্রভাব বিস্তারের দৃশ্য দেখা গেছে। বেলা ১১টার দিকে বরিশাল মহানগর পশ্চিম কাউনিয়া এলাকার সৈয়দা মজিদুন্নেছা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পুরুষ কেন্দ্রের চার নম্বর বুথে গিয়ে দেখা যায় টেবিলের ওপর মেয়র পদের ব্যালট বইয়ের মুড়িটি ভাঁজ করা অবস্থায় পড়ে আছে। প্রতিটি ব্যালটে নৌকা প্রতীকের ওপর সিল মারা। ওই বুথের দায়িত্বে থাকা সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা তৌহিদা খানম বলেন, একদল লোক এসে জোর করে এই ব্যালট বইয়ে সিল মেরে গেছে। সঙ্গে সিল-প্যাডও নিয়ে গেছে। পরে কেন্দ্র দখল, জোরপূর্বক ব্যালট ছিনতাই করে সিল মারার অভিযোগে দুপুর ১২টার দিকে কেন্দ্রের ভোট কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত করেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার।

এদিকে বেলা দেড়টার দিকে নগরীর কাশীপুর কার্যালয়ে গিয়ে বরিশাল জেলা আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে চার মেয়র প্রার্থী ভোটে কারচুপি, এজেন্টদের বের করে দেওয়া ও মারধরসহ বিভিন্ন অভিযোগ করেন। তারা হলেন বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী সরোয়ার, ইসলামী আন্দোলনের মেয়র প্রার্থী মাহাবুব, জাপার বহিষ্কৃত মেয়র প্রার্থী তাপস এবং বাসদের মেয়র প্রার্থী মনীষা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads