• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, ইসির বাধা সংবিধান

ছবি : সংগৃহীত

নির্বাচন

লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, ইসির বাধা সংবিধান

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৫ নভেম্বর ২০১৮

সরকার কিংবা সরকারবিরোধী কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট নয়, জাতীয় নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে সংবিধানই সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। সংবিধানে সুরক্ষিত ক্ষমতার (বিশেষ সুবিধা) বলে মন্ত্রী-এমপিদের ওপর চালানো যাচ্ছে না নির্বাচনী আচরণ বিধির (আরপিও) খড়্গ। যে কারণে সাংবিধানিক ক্ষমতায় অনেক শক্তিধর হয়েও নির্বাচন আয়োজনকারী এই সংস্থাটির পক্ষে প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা প্রায় অসম্ভবই হয়ে পড়েছে। সঙ্গত কারণেই বিরোধী পক্ষের তুলনায় সরকারি দলের হেভিওয়েট এসব প্রার্থী নির্বাচনী মাঠে প্রভাব বিস্তার করলেও অনেকটা নিশ্চুপই থাকতে হচ্ছে ইসিকে। যদিও ইসির পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে। 

রাজনৈতিক ও নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা মানে প্রার্থী হিসেবে মন্ত্রী-এমপি যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন; ভোটে অংশ নেওয়া সবার জন্য একই ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এটা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। বিভিন্ন বিধিবিধানের মাধ্যমে তারা এটা করে থাকে। সরকার যথাসম্ভব সহায়তা দিয়ে থাকে। অবশ্য এবার সমান সুযোগ দেওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ, সাংবিধানিকভাবে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আছে। এ সরকারের মন্ত্রীরা আইনগতভাবে বেতন-ভাতাসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। বিধি দিয়ে সেটা রদ করা যাবে না। এ ছাড়া সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদের ৫ উপানুচ্ছেদ অনুযায়ী এমপিদের বিশেষ অধিকার দেওয়া হয়েছে। সংবিধান প্রদত্ত অধিকার কোনো বিধি দিয়ে রদ করা যায় না। 

এসব কারণে বর্তমান কমিশন ইচ্ছে করলেই নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে পারবে না বলেই মনে করছেন তারা। তাদের মতে, ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অন্তর্বর্তীকালীন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন শুরু হয় ২০১৪ সাল থেকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গে বর্তমান সরকারের মন্ত্রীদের কার্যক্রমের পার্থক্য বিস্তর। উপদেষ্টারা তিন মাস মেয়াদের জন্য মনোনীত ছিলেন। তাদের দায়িত্ব ছিল রুটিন কাজ করা। কিন্তু বর্তমান মন্ত্রীরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত। তারা পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেছেন। এখনো নির্বাচিত সরকারই বিদ্যমান। কাজেই এ ধরনের সরকারকে যদি নির্বাচনকালীন সময়ে রুটিন কাজের মধ্যে রাখতে হয়, তবে তার জন্য সুনির্দিষ্ট বিধান থাকা উচত ছিল। রুটিন কাজকে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এটা করা হয়নি। যে কারণে যতই হাঁকডাক দেওয়া হোক না কেন; ইসিকে মনে রাখতে হবে, এবার দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকাবস্থায় সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হচ্ছে। তাই এ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হলে তাদের বিভিন্ন দিকে খেয়াল রাখতে হবে। গতানুগতিক কাজ করলে হবে না।

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা সংবিধান ও আইনের বাইরে যেতে পারি না। সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হচ্ছে, মন্ত্রী-এমপিরা পদে থেকেই নির্বাচন করবেন। পদে থাকার কিছু সুবিধা তারা পাচ্ছেন। এক্ষেত্রে সংবিধান ও আইনগতভাবে আমাদের কিছু করার নেই। তবে আমরা চেষ্টা করছি, তাদের সর্বোচ্চ সরকারি সুবিধামুক্ত রাখার। তিনি বলেন, আমরা ভোটার, প্রার্থী ও রাজনৈতিক দল- সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। ভোটাররা যেন তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বিঘ্নে বাসায় ফিরতে পারেন, প্রার্থীরা যেন সাধ্যমতো ও আইনানুগ প্রচার চালাতে পারেন, রাজনৈতিক দলগুলো যেন সমান সুযোগ পায়- ইসি সেই প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

তবে ইসি যাই বলুক; নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার বিষয়টি আচরণবিধিতে স্পষ্ট না করায় ভোটে প্রভাব বিস্তারের যথেষ্ট সুযোগ থেকেই গেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ইসি যতই আচরণবিধির কথা বলুক, একজন এমপি এমনিতেই নানা ধরনের সুযোগ পান। যা অন্য প্রার্থীরা পান না। নির্বাচনী আচরণবিধিতে প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, সরকারের মন্ত্রী, এমপিসহ সংশ্লিষ্টদের সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে বোঝানো হয়েছে। নির্বাচনে প্রচার বিষয়ে আচরণবিধিতে এদের বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘সরকারের সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাহার সরকারি কর্মসূচির সঙ্গে নির্বাচনী কর্মসূচি বা কর্মকাণ্ড যোগ করিতে পারিবেন না।’ ‘সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাহার নিজের বা অন্যের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় সরকারি যানবাহন, সরকারি প্রচারযন্ত্র ব্যবহার বা অন্যবিধ সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করিতে পারিবেন না এবং এতদুদ্দেশ্যে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ব্যবহার করিতে পারিবেন না।’ কিন্তু বিধিতে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।

বর্তমানে কোনো মন্ত্রী এলাকায় গেলে পুলিশ প্রটোকল পান। কিন্তু তারা ভোটের সময় পুলিশ প্রটোকল নেন না। তবে তাদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ থাকে। এক্ষেত্রে শব্দগত কিছু পার্থক্য ছাড়া তেমন কিছু নেই। কারণ প্রটোকলও পুলিশ দেয়, আর নিরাপত্তাও পুলিশই দেয়। অথচ অন্য প্রার্থীরা পুলিশি নিরাপত্তা পাচ্ছেন না। যদিও ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়, কেউ চাইলে পাবেন। কিন্তু বাস্তবে এমন নজির নেই বললেই চলে। এ ছাড়া বর্তমান এমপিদের মধ্যে যারা একাদশতম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে- তারা সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে সুযোগ-সুবিধা পাবেন। একইভাবে তাদের জন্য আচরণবিধিতে উল্লিখিত বিধিনিষেধ প্রযোজ্য হবে। কিন্তু যেসব এমপি এবার মনোনয়নবঞ্চিত হবেন তাদের ক্ষেত্রে বিধির কোন ধারা বা আদৌ কোনো ধারা প্রযোজ্য হবে কি না তা উল্লেখ নেই।

নির্বাচন বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন এ বিষয়ে বলেন, ইসির নির্বাচন আচরণবিধিতে অনেক গ্যাপ আছে। এককথায় বললে হবে না যে, সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হবে। মন্ত্রী এবং এমপিরা কীভাবে প্রচার চালাবেন তা সুনির্দিষ্ট করা দরকার। মন্ত্রী কোথাও গেলে সেখানে লোকজন সমবেত হবে, মিছিল হবে। ইসি বললেই এটি বন্ধ হবে না। যেসব এমপি এবার মনোনয়ন পাবেন না তাদের জন্য আচরণবিধির কোন ধারা প্রযোজ্য হবে, এটা স্পষ্ট করতে হবে। এককথায় বলা হলো মন্ত্রীরা প্রটোকল পাবেন না, নিরাপত্তা পাবেন। কীভাবে পাবেন, অন্য প্রার্থীরাও পাবেন কি না-তা জানাতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমপিদের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ প্রভাব থাকে। যেমন- আইনি কাঠামোতে একজন এমপি উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা। তাকে কোন আইন বলে উপজেলা পরিষদের কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা হবে, এ জন্য সুনির্দিষ্ট বিধান থাকা প্রয়োজন। বর্তমানে দলীয় সরকার ক্ষমতায়। নির্বাচনের সময় তাদের রুটিন কাজ সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া উচিত। নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তার আচরণ কী হবে, ভোটের আগে-পরে তারা কী করতে পারবেন তা চিহ্নিত করে দেওয়া উচিত। আর এসব করলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কিছুটা হলেও নিশ্চিত করা যেত।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads