• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
এবারো ভোট নিয়ে শঙ্কা

সংগৃহীত ছবি

নির্বাচন

এবারো ভোট নিয়ে শঙ্কা

রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতাদের উসকানিমূলক নির্দেশনা

  • আফজাল বারী
  • প্রকাশিত ২৫ জানুয়ারি ২০২০

ঢাকাবাসীর মধ্যে এখন নির্বাচনী উত্তেজনা। দিবানিশি প্রচার লড়াইয়ে প্রার্থীরা। নির্ঘুম এ লড়াই চলবে বুধবার রাত ১২টা পর্যন্ত। আগামী শনিবারই ভোটযুদ্ধ। সব ধরনের প্রস্তুতি চলছে। ইসি, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এবং তাদের সমর্থন দেওয়া রাজনৈতিক দল সব পক্ষেরই একই সিদ্ধান্ত-স্ব স্ব অবস্থান থেকে ভোটের দিন ‘সর্বশক্তি’ প্রয়োগ করা হবে। রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের এ ধরনের উসকানিমূলক নির্দেশনায় স্থানীয় নেতা-কর্মীরা আরো উগ্র ও লাগামহীন আচরণ করছেন।   

এদিকে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্বরূপে ফিরছে ভোটচিত্র। ভোট সংস্কৃতিতে সংঘাত-সংঘর্ষের ব্যাপকতা এখনো দৃশ্যমান না হলেও এবারো নানামুখী শঙ্কা প্রকাশ করছেন ভোটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই। ইতোমধ্যে হামলা-পাল্টা হামলার অভিযোগ উঠেছে, মামলা এবং তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে।

অন্যদিকে ভোটারদের তরফ থেকে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়েই প্রশ্ন তোলা হয়েছে আদালতে। আর প্রার্থীর বিরুদ্ধে তথ্য গোপনের অভিযোগ পড়েছে নির্বাচন কমিশনে। এসব দেখে সরকারবিরোধী পক্ষ বিএনপির তরফ থেকে অভিযোগ এসেছে তাদের প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে সরানোর ‘অপকৌশল’ গ্রহণ করা হচ্ছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট গ্রহণের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে সবাইকে আশ্বস্ত করা হয়েছে।

ঢাকার দুই সিটিতে (উত্তর ও দক্ষিণ) ১২৯টি সাধারণ ওয়ার্ড, ৪৩টি সংরক্ষিত আসনে ভোটের লড়াই হবে। ২২ জানুয়ারি তফসিল ঘোষণার পর ২ জানুয়ারি বাছাই, ৯ জানুয়ারি প্রত্যাহারের শেষ করে প্রচারে মাঠে নেমেছেন প্রার্থীরা। ভোট গ্রহণের দিন ছিল ৩১ জানুয়ারি। কিন্তু হিসাবে গরমিল ধরা পড়ে পূজার কারণে। দাবি ওঠে ভোটের তারিখ পেছানোর। ইসির অনড় থাকায় বিষয়টি গড়ায় আদালতে। রাজপথে শুরু হয় আন্দোলন। অবশেষে ভোটের দিন পেছানো হয়েছে। ভোট হবে ১ ফেব্রুয়ারি। ভোটের দিন নিয়ে সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান হয়নি। ভোটারের তরফ থেকে জনৈক ব্যক্তি আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। তার দাবি প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিনের পর প্রত্যাহারের সুযোগ না থাকলে তফসিলের পর ভোটের দিন পেছানো যায় কী করে? আবেদনকারীর শুনানি ও আদেশ আসছে আগামীকাল রোববার।

বাছাইয়ের ২১ দিন পর বিএনপি মনোনীত উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের বিরুদ্ধে ইসিতে লিখিত আবেদন করেছেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। তার অভিযোগ, তাবিথ আউয়াল সিঙ্গাপুরের কোম্পানিতে ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের শেয়ার হোল্ডারের তথ্য গোপন করেছেন। এ অপরাধে তাবিথের প্রার্থিতা বাতিল হতে পারে। নির্বাচিত হলেও এ অপরাধে তিনি অযোগ্য হবেন। কমিশন ব্যবস্থা না নিলে প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে আগামীকাল রোববার রিট করা হবে বলেও জানান সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। এদিকে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর ওপর রাজধানীর গাবতলীতে হামলার ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের গঠন করা তদন্ত কমিটি গত ২২ ও ২৩ জানুয়ারি দুটি প্রতিবেদন দালিখ করেছে। প্রতিবেদনের আলোকে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

 

প্রস্তুত সব পক্ষ

১ ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই স্ব স্ব অবস্থান থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতোমধ্যে নির্বাচন নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠক হয়েছে। বৈঠক থেকে নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানের উদ্দেশে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বলেন, আমি চাই না কোনো অভিযোগ, অনিয়ম, বিচ্যুতি আমাদের পর্যন্ত আসুক। ছোটখাটো কোনো সমস্যা হলে নিজ নিজ বাহিনীর প্রধানের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করবেন। কোনো গাফিলতি হলে পুলিশ, বিজিবি, র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে আপনারা নিজেরাই তা সমাধান করবেন। কোনো বিচ্যুতি হলে কাউকে ছাড়ব না। কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেব।

সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে পুলিশের যা যা করণীয় সব ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম। তিনিও বলেন, কারো বিরুদ্ধে কোনোরকম গাফিলতি কিংবা হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার পুলিশ হবে জনতার’-এ স্লোগান ধারণ করে দায়িত্ব পালন করার আহ্বান জানান ডিএমপি কমিশনার।

ইতোমধ্যে, নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট নেওয়ার প্রক্রিয়া জানতে ও জানাতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রার্থীরা প্রস্তুত করছেন তাদের পোলিং এজেন্ট। প্রচারণা নিয়ে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে ক্ষণেক্ষণে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের পাহাড় গড়ে উঠেছে। প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হয়েছেন মেয়রপ্রার্থী, কাউন্সিলরসহ কর্মী-সমর্থকরা। ঘরবাড়ি, নির্বাচনি প্রচারণা কেন্দ্রে হামলা, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।  

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেছেন, বিএনপিকে সরকার বিরত রাখার ‘অপকৌশল’ করছে। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমাদের যে দুজন মেয়রপ্রার্থী আছেন তারা ইতোমধ্যেই ঢাকা মহানগরীতে গণজোয়ার সৃষ্টি করেছেন। তাদের বিভিন্নভাবে এই নির্বাচনের যে প্রতিযোগিতা সেখান থেকে তাদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য, বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। শারীরিক আক্রমণ পর্যন্ত করা হয়েছে তাবিথ আউয়ালের ওপরে, ইশরাকের মিছিলে আক্রমণ করা হয়েছে। তাদের দুই কাউন্সিলরের ওপর আঘাত করা হয়েছে। অসংখ্য নেতা-কর্মীকে মারধর করা হয়েছে। পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হয়। নির্বাচন কমিশনার, স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ দিয়েও লাভ হয়নি।  মাঠে ভ্রাম্যমাণ ম্যাজিস্ট্রেট নামানো হলেও তারা কোনো কাজ করছে না বলে অভিযোগ বিএনপির। সিটি নির্বাচনে ভোট ডাকাতির শঙ্কা প্রকাশ করেছেন জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব। নাগরিকদের সচেতনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের আহ্বান জানিয়ে গত সোমবার তিনি বলেন, এবার আপনাদের ভোট দিতে আসতেই হবে। আপনার ভোটাধিকার আপনাকেই রক্ষা করতে হবে। আর কেউ ভোট ডাকাতি করতে এলে হাত কেটে দেবেন।

এদিকে আওয়ামী লীগের তরফ থেকেও অভিযোগের কমতি নেই। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে বিএনপি নির্বাচনে লোক দেখানো অংশগ্রহণ করেছে। নির্বাচনে জেতার চেয়ে তাদের বড় লক্ষ্য হচ্ছে নির্বাচনটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। কোনো ধরনের ঝামেলা করতে চাইলে জনগণ তাদের প্রতিহত করবে। গত ৬ জানুয়ারি এক সভায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে আওয়ামী লীগ গুরুত্বসহকারে নিয়েছে। ভোটের দিন আওয়ামী লীগ তার সমস্ত শক্তি নিয়োগ করে বিজয়ী হওয়ার চেষ্টা করবে।

বিএনপি সমর্থিত ঢাকা দক্ষিণের মেয়রপ্রার্থী ইশরাক হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস। তিনি বলেছেন, ইশরাকের বাসায় ভোট চাওয়ার পর আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলরদের প্রচারে ধাওয়া করেছে ইশরাকের লোকজন।

এদিকে তাবিথ আউয়াল ও ইশরাক হোসেন দুজনেই দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, ১ ফেব্রুয়ারি ভোটের দিন তারা মাঠে থাকবেন। এক মিনিটের জন্য তারা মাঠ ছাড়বেন না। তবে কোনো বাধা, কারচুপির আভাস পেলে তারা জনগণকে নিয়ে প্রতিহত করবেন। দলটির অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তও এমনটি। গত নির্বাচনে মাঠ ছেড়ে দিলেও এবার তারা মাঠে থাকবে।

বিরোধী ও ক্ষমতাসীন দুই দলের নেতা-কর্মীরা মাঠে থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। প্রাক-প্রস্তুতিকালেই উভয়ের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, হামলার ঘটনা ঘটছে। দুই পক্ষের নেতারাই জানিয়েছে, আগামীর প্রতিবাদ আরো কঠোর হবে। সব মিলে অশনি সংকেত বহন করছে নির্বাচনের মাঠে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, আমাদের দেশে নির্বাচন মানেই সংঘাত-সংঘর্ষ, অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ। দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভোটার এবং প্রার্থীদের আস্থায় আনতে পারেনি। আইনের প্রয়োগ দেখাতে পারেনি। মারামারি হয়েছে অনেক। ভোটের দিন পর্যন্ত আরো অঘটন ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads