• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

সম্পাদকীয়

কেমন করে বদলে গেল সব

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ১৯ মে ২০১৮

দিনকয়েক আগে আমার থেকে বছর বিশেক বড় এক ভদ্রলোকের অফিসে গিয়েছিলাম। তিনি বেশ বড় একজন কর্মকর্তা। ফেরার সময় লিফট অবধি এগিয়ে দিলেন। আমি না না করায় তিনি বললেন, ‘না তা হয় না!’ আমি তার থেকে বয়সে, পদমর্যাদায়, সম্মানে, আভিজাত্যে কোনো দিক দিয়েই উঁচু নই। কিন্তু তিনি আমাকে এই সম্মানটা দেখালেন। এটা তার পারিবারিক শিক্ষা, শিষ্টাচার।

গত  রোজার কথা। আমার বাসায় একজন ইফতার পাঠালেন। ইফতার বহনকারী গৃহকর্মীর কাছে ইফতার রেখে দ্রুত চলে গেছেন। আমি বাসায় ছিলাম না। এসে ইফতার দেখে খুবই অবাক হয়ে গেলাম। কারণ যিনি পাঠিয়েছেন, তাকে আমি চিনি না। প্যাকেটে একটা কার্ড দেখে চেষ্টা করলাম যোগাযোগ করতে। কার্ডে শুধু টিঅ্যান্ডটি নাম্বার ছিল। কাজেই রাতে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হলো না। পরদিন যোগাযোগ করেও কোনো সদুত্তর পেলাম না। তিনি জানালেন, ইফতারটা তার প্রতিষ্ঠানেরই। তবে আমার নামটা কে যোগ করেছে তিনি জানেন না। জেনে জানাবেন। ইফতারটা আমাকেই পাঠানো হয়েছে কি-না এটাও তিনি নিশ্চিত করতে পারলেন না।

ইফতার পাঠানোর সংস্কৃতি আমাদের ছেলেবেলায় ছিল, এখন নেই। ইফতারের সময় হলেই এ বাড়ি থেকে ও-বাড়ি ট্রেতে করে ঝালর দেওয়া কাপড়ে ঢেকে ইফতার আসত। আমরা উৎসুক হয়ে থাকতাম প্রতিবেশীর ইফতার খাওয়ার জন্য। বাড়ির ইফতার আর প্রতিবেশীর ইফতারের মেন্যু ছিল অভিন্ন। সেই ছোলা, পেঁয়াজু, বেগুনি, মুড়ি। তারপরও নিজের বাড়িরটা ভালো লাগত না। একই অবস্থা হতো শবেবরাতের আগের সন্ধ্যায়। ডাল, সুজির হালুয়া আর চালের আটার রুটি বাড়ি বাড়ি পাঠানো হতো। নিজের বাড়িরটা রেখে আমরা অন্য বাড়িরটা খেতেই পছন্দ করতাম। এখন আর সেদিন নেই। এই ব্যস্ত নাগরিক জীবনে কারো সময় নেই বাটি চালাচালি করার। তখন পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে চাল থেকে শুরু করে নুন কাঁচামরিচ পর্যন্ত ধারের রেওয়াজ ছিল। ফেরত দেওয়ার সময় সবাই কম দেওয়ার চেষ্টা করত এই অপবাদও ছিল। যেমন বড় সাইজের ডিম নিয়ে ছোট ডিম দেওয়া, বড় কাপে ডাল নিয়ে আঙুল ডুবিয়ে ডাল কম দেওয়া, চামচে উঁচু উঁচু করে লবণ নিয়ে কম লবণ দেওয়া, বড় মরিচের জায়গায় ছোট মরিচ দেওয়া, এসব। আর এই দেওয়া-নেওয়ার মধ্যে অদ্ভুত ধরনের একটা আনন্দও ছিল। এখন সব উধাও। কখনো কখনো কোনো শিল্পপতি বা কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিকের পক্ষ থেকে ইফতার বিতরণ করা হয়। বিভিন্ন ঠিকানায় পাঠানো হয়। কিন্তু কার কাছে সেই ইফতার পৌঁছালো, সে খবর রাখার প্রয়োজনবোধ করা হয় না। আর যে পেল সেও অনেক সময় অস্বস্তিতে ভোগে। আর এ ধরনের প্রেরণ এবং গ্রহণ প্রায়ই হয় লাভ-লোকসানের হিসেবে।

দিন সত্যিই বদলেছে। ছেলেবেলায় বাবা-মা শিখিয়েছে গুরুজনকে মান্য করতে হবে, অন্যের মূল্যবোধকে স্বীকৃতি দিতে হবে, অন্যের মতামতকে দাম দিতে হবে। কখনো গুরুজনের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াইনি, হেলান দিয়ে বসিনি। পায়ের ওপরে পা তুলে বসার তো প্রশ্নই ওঠে না। শিক্ষকদের রেখেছি মাথায় করে। সময়ের ব্যবধানে কেমন করে যেন বদলে গেল সব! আজকাল ছাত্র-শিক্ষকের ব্যবধান বোঝা যায় না। ছাত্র-শিক্ষকের সামনে দিব্বি পায়ের ওপর পা তুলে বসছে, হেলান দিয়ে বসছে। শিক্ষক-ছাত্রের সিগারেট ধরিয়ে দিচ্ছেন। একসঙ্গে ধোঁয়া ছাড়ছেন। চা খেতে খেতে গুলতানি মারছেন। নানা ধরনের গসিপ আর নোংরা জোকস বলছেন। অনেকে হয়তো বলবেন, ‘শিক্ষকের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হলে পড়াশোনা ভালো হয়। ছাত্র যদি শিক্ষককে ভয় পায় তাহলে জড়তা কাটে না। ঠিকমতো পড়াশোনা হয় না। দেখেন না বিদেশে ইত্যাদি ইত্যাদি।’ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আর একসঙ্গে বিড়ি-সিগারেট টানা এক জিনিস না। বিদেশ বিদেশই। তাদের সংস্কৃতি আদব-কায়দা সব তাদের মতো। আমাদের সঙ্গে কিছুই মেলে না। কথাতেই আছে, ‘যস্মিন দেশ যদাচার।’ বন্ধু হতে হতে আজকাল এমন অবস্থা হয়েছে যে, ছাত্ররা শিক্ষকদের অবরোধ করে রাখতেও পিছপা হয় না।

বড়দের সঙ্গে শিষ্টাচার আর ভদ্রতা বজায় রেখে কথা বলা আর ছোটদের সঙ্গে আদর, স্নেহের সঙ্গে কথা বলতেই শিখেছিলাম আমরা। ছোটরা ছোট বলেই তাদের তাচ্ছিল্য করা যাবে না, তাদের যথেষ্ট সমীহ করে কাছে টেনে কথা বলতে হবে আর ছোটবেলাতেই বুঝিয়ে দিতে হবে বড়দের মতো তাদেরও আত্মমর্যাদা আছে। এসব আজকাল কয়জন মানেন? আমাদের ছেলেবেলায় মনে পড়ে না কেউ কখনো আমাদের অবমূল্যায়ন করেছে। আবার অতি আদর দিয়েও কেউ বেয়াড়া বানায়নি। আজকাল অধিকাংশ ছেলেমেয়েকে বাড়তি আদর, বাড়তি সুযোগ দেওয়া হয়। ফলে ছেলেবেলা থেকেই অতিরিক্ত পেতে পেতে তারা লাগামছাড়া হয়ে যায়। কাউকে কিছু দেওয়া বা ভাগ করে নেওয়ার মানসিকতা তাদের থাকে না।

নৈতিকতা আদব-শিষ্টাচার এসব শব্দ এখন অন্তর্হিত প্রায়। বাবা-মা শিখিয়েছিলেন, ‘কথা বলবে হাসিমুখে, ভদ্রভাবে। কখনো যেন ঔদ্ধত্য বা অহঙ্কার প্রকাশ না পায়।’ হাসিমুখ তো আজকাল দুরবিন দিয়ে খুঁজতে হয়। সবাই যেন রেগে আছে। মেজাজ সবার মাথায় চড়ে আছে এমনই অবস্থা। অন্যের কথা শোনার ধৈর্য কারোই যেন এখন আর নেই। নিজেই বলবে। এবং বলবে জোরে জোরে, গলা ফাটিয়ে। যেন চারপাশের সব লোক বধির, কেউ কানে শোনে না। আর নিজে যেটা বলবে সেটা প্রতিষ্ঠিত করতেই হবে এমন একটা চিন্তা আজকাল অধিকাংশ মানুষের মধ্যে।

অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা, তার দিকে তাকিয়ে কথা শোনা আর তার কথা শেষ হলে নিজের কথা বলা শিষ্টাচার। এ শিক্ষা আজকাল বাতিল শিক্ষা। অন্যকে কথা বলতে না দেওয়া, তার কথায় বাধা দেওয়াই এ কালের শিক্ষা।

কথা বলার সময় দাঁত খোঁচানো, নাকে হাত দেওয়া, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা এসব তো ডাল-ভাত। রাস্তায় থুতু ফেলা, সর্দি-কাশি ফেলা, কাগজের টুকরো ছুড়ে মারা এগুলো নিত্যকার ব্যাপার।

আমাদের ছেলেবেলায় বাসগুলোতে মহিলাদের জন্য আলাদা সিট থাকত। তারপরও দেখেছি মহিলা সিট ফিলআপ হওয়ার পর যদি কোনো অসুস্থ, অন্তঃসত্ত্বা মহিলা বা কোনো বৃৃদ্ধ-বৃদ্ধা বা যার হাতে অনেক জিনিসপত্র আছে এমন মানুষ বাসে উঠতেন পুরুষরা সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাদের বসতে দিতেন। বাসে এখনো মহিলা সিট আছে। কিন্তু মহিলাকে নিজের সিট ছেড়ে দেওয়ার মতো ব্যাপার আজকাল খুবই কম চোখে পড়ে। বরং বিপরীত উচ্চারণ শুনি, ‘সারাক্ষণ সমঅধিকার সমঅধিকারের কথা বলে, বাসে এলেই অবলা হয়ে যান।’ আর পাবলিক বাস বা ট্রেনে বুঝিনি বুঝিনি করে মেয়েদের শরীরের স্পর্শকাতর অংশে হাত দেওয়া তো নৈমিত্তিক ঘটনা। মেয়েরাও লজ্জায় কিছু বলতে পারে না।

বাড়িতে  অতিথি এলে তাকে সমাদরের সঙ্গে গ্রহণ করা, দরজা খুলে এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দিয়ে ভিতরে নিয়ে যাওয়া, আন্তরিকতার সঙ্গে বসতে দেওয়া এসবও আজকাল উঠে যাচ্ছে। বেল বাজাবার পর দরজা খুলতেই বেশকিছু সময় পার হয়ে যায়। হ্যাঁ, আজকাল নিরাপত্তার ব্যাপার একটা বড় বিষয় মানি। কিন্তু চেনা-জানা মানুষ হলেও আগের সেই আন্তরিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। আজকাল মানুষ মানুষের শরীর আর মন বুঝে কথাও বলে না। দেখা যায় একজন অসুস্থ মানুষের শয্যার পাশে বসে ইউরোপ-আমেরিকার গল্প করতে থাকে কিংবা হাসপাতালে পেসেন্টের পাশে বসে ছেলের বিয়ের গল্প জুড়ে দেয়। মৃতের কুলখানি বা চল্লিশায় গিয়ে শাড়ি গয়নার গল্প শুরু হয়। এতে যিনি অসুস্থ বা যার বাড়িতে স্বজন মারা গিয়েছে তারা কতটা আহত যে হন এটা বোঝার মতো বোধবুদ্ধিও হারিয়েছে আজকালের অনেক মানুষ।

আর এক অত্যাচার টেলিফোন। সকাল নেই, সন্ধ্যে নেই, ফোন বাজছে তো বাজছেই। বাড়িতে অসুস্থ রোগী থাকতে পারে, শিশু থাকতে পারে, তাদের ঘুম ভেঙে যেতে পারে। সে চিন্তা যিনি ফোন করছেন তার নেই। আর ফোনের সময় জ্ঞানও নেই। চলছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এটা কি খাবার সময় না ঘুমানোর সময় নাকি অফিসের সময় সে চিন্তাও কারো নেই। যাকে ফোন করা হয়েছে তিনি হয়তো লজ্জায় কিছু বলতে পারছেন না, অথবা দু-একবার বলার চেষ্টা করেছেন, ভাই এখন আমি একটু ব্যস্ত... কিন্তু তার কথা শোনার ধৈর্য ওপারের ভদ্রলোক/ভদ্রমহিলার হচ্ছে না। তিনি বলেই চলেছেন।

আর সব শেষ যন্ত্রণা ফেসবুক। এটা আধুনিক প্রযুক্তি। আগের দিনের মানুষ হলেও আপনি কতটা আর পিছিয়ে থাকবেন। ফেসবুক থেকে আপটুডেট নিউজ পাওয়া যায়, সময়ও কাটে ভালো, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা যায় এই ভাবনা থেকে আপনি একটা অ্যাকাউন্ট করেছেন। রক্ষণশীল না হয়ে অচেনা কিছু মানুষকে বন্ধুও করেছেন সামাজিক যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য। আর যেই করেছেন সেই মরেছেন। ফেসবুকে বসতে না বসতেই শুরু হবে, হাই হুই, নানা রকমের প্রস্তাব। ম্যাসেঞ্জারে কল আসবে আপনার কাছে। আপনি ব্লক করতে শুরু করবেন। কিন্তু কয়জনকে করবেন?

এই অবস্থাতেই আছি আমরা। আমাদের ছেলেবেলায় এতকিছু ছিল না। স্মার্টফোন ছিল না, ট্যাব নোটবুক ভাইভার টুইটার কিছুই ছিল না। কিন্তু আমরা কি খুবই খারাপ ছিলাম। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো একবার? নির্মল বিনোদনের অজস্র উপকরণ ছিল তখন। পাড়ার সব ঘরই ছিল নিজের ঘর। সবাই সবার আত্মীয়। আজ আমরা আধুনিকতার বড়াই করি, প্রযুক্তির বড়াই করি, শিক্ষা-দীক্ষার বড়াই করি। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, নৈতিকতা আর শিষ্টাচারের শিক্ষাই বড় শিক্ষা। ওই শিক্ষা না থাকলে কখনো একজন সম্পূর্ণ মানুষ হওয়া যায় না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads