• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
পেটি বুর্জোয়ার অবস্থান

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

পেটি বুর্জোয়ার অবস্থান

  • সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
  • প্রকাশিত ২৯ জুন ২০১৮

পেটি বুর্জোয়াদের প্রসঙ্গটা বার বার আসছে। আসাটা স্বাভাবিক। কারণ তাদের প্রভাব রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে সুবিস্তৃত। আগেও ছিল, এখনো আছে। সাহিত্যে তাদের উপস্থিতি ব্যাপক এবং সেটা তদানীন্তন সমাজবাস্তবতারই প্রতিচ্ছবি। দেখা যাবে এক প্রান্তে আছেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অপর প্রান্তে সমর সেন। সুধীন্দ্রনাথ কেবল নরকই অবলোকন করেননি, জনতাকে দেখে উক্তিও করেছেন, ‘সহে না সহে না প্রাণে/ জনতার জঘন্য মিতালী।’ সমর সেনও পেটি বুর্জোয়াই। পুরুষানুক্রমে তিনি কলকাতাবাসী। তার কবিতায় বৈদগ্ধ্য থাকে, থাকে বিদ্রূপ। তার অসন্তোষ ওই পেটি বুর্জোয়াদের নিয়েই। তিনিও মেলাতে চান এলিয়েট ও পাউন্ডকে, তার নিজের চিন্তা প্রকাশের জন্য। কিন্তু সে চিন্তা দ্রুতই চলে গেছে মার্কসবাদের অভিমুখে। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েই যাচ্ছিলেন; নিবৃত্ত হয়েছেন কমিউনিস্টদের মতো শ্রেণিচ্যুত হতে পারবেন না- এই আত্ম-উপলব্ধি থেকে। ধিক্কার দিয়েছেন তিনি বঙ্কিমচন্দ্রকে, আনন্দমঠ লেখার জন্য; নিজেকে দেখেছেন মেকলের বিষবৃক্ষের ফল হিসেবে। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে যে কবিতা লিখবেন সেটা পারলেন না। থেমে যেতে হলো। কবিতা লিখেছেন মাত্র ১২ বছর, তারপর ঘোষণা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। হয় তো দেখেছেন বুদ্ধি এগিয়েছে, কিন্তু পেটি বুর্জোয়া হূদয় পেছনে পড়ে থাকছে এবং অভিজ্ঞতার সীমা যে ওই পেটি বুর্জোয়া বৃত্তের বাইরে প্রসারিত হবে তেমন সম্ভাবনা নেই। কবিতা ছাড়লেন, তবে মার্কসবাদের চর্চা ছাড়লেন না। বামপন্থি ইংরেজি সাপ্তাহিক বের করলেন ফ্রন্টিয়ার নামে। বাকি জীবন অসামান্য দৃঢ়তায় এবং বুর্জোয়া শাসকদের সব প্রতিকূলতা ও সব ধরনের নির্যাতন সহ্য করে পত্রিকাটিকে টিকিয়ে রেখেছিলেন। বেশ বড় একটা কাজ বটে। তবে ঠিক মেহনতি পাঠকদের জন্য নয়, বুর্জোয়া ও পেটি বুর্জোয়াদের জন্যই। সমর সেনের সমস্যাটা মার্কসবাদী বিষ্ণু দে’র জন্যও দেখা দিয়েছিল। উটপাখি না, তিনি ‘ঘোড়সওয়ার’ই হতে চান; কারণ “জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার,/ হূদয়ে আমার চড়া/ চোরাবালি আমি দূর দিগন্তে ডাকি—/ কোথায় ঘোড়সওয়ার?” পুঁজিবাদের উত্থানের কালে রেনেসাঁপন্থি মেকিয়াভেলি খুঁজেছেন রাজপুত্রকে, একালের মার্কসবাদী কবি খোঁজেন ঘোড়সওয়ারকে। খোঁজেন, কিন্তু খুঁজে পাওয়াটা তো দুষ্কর।

বিশ্বযুদ্ধে লাঞ্ছিত হওয়া সত্ত্বেও উদারনীতিকদের পক্ষে মার্কসবাদী হওয়াটা খুব যে সহজ ছিল, তা নয়। ইউরোপে কেউ কেউ সেটা হয়েছেন, কিন্তু আবার ফিরে গেছেন উদারনীতির কাছেই। স্ট্যালিনের গৌরবোজ্জ্বল কালেই। ‘ঈশ্বরের পতন ঘটেছে,’ এই ধ্বনি তুলে। কেউ কেউ গেছেন রক্ষণশীলতার আশ্রয়ে, সিআইএর দ্বারস্থ যে হননি এমনো নয়। বাংলায় দেখছি আধুনিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত একই সঙ্গে বেদেদের নিয়ে উপন্যাস এবং রামকৃষ্ণ পরমহংসকে নিয়ে গদ্যে মহাকাব্য লিখছেন। নতুন গণদেবতার খোঁজ পাওয়া সত্ত্বেও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেসের রাজনীতিকেই সমর্থন করছেন।

ব্যতিক্রমও ছিলেন। যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি পদ্মানদীর মাঝিদের খবর নিলেন, আবার দেখলেন অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা মানুষদের পুতুলনাচ, কিন্তু অচিরেই এই উপলব্ধিতে পৌঁছে গেলেন যে, অর্থনীতিই হচ্ছে আসল নিয়ন্ত্রক এবং সেই নিয়ন্ত্রণ ভেঙে ফেলে মানুষকে মুক্ত করতে হলে প্রয়োজন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের। পেটি বুর্জোয়া গণ্ডি ভেঙে এবং বিদ্রোহ করেই বের হয়ে গিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। সর্বহারাদের পক্ষে দু’হাতে কবিতা লিখেছেন। যেমন লিখেছেন সুকান্ত ভট্টাচার্য। কিন্তু সুকান্ত তো বেঁচেছিলেন মাত্র একুশ বছর। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তাকে অব্যাহতি দেয়নি, রাজরোগ যক্ষ্মার আক্রমণ ঘটিয়ে দ্রুত সরিয়ে দিয়েছে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। সরিয়ে দিয়েছে নজরুলকেও। রোগ, দারিদ্র্য, শোক, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অনগ্রসরতা, সবকিছু একসঙ্গে এসে তার কণ্ঠরোধ করল। অসামান্য কবি জীবনানন্দ দাশ; নজরুলের ক্ষমতাকে তিনি জানতেন, প্রথম জীবনে তার রচনা দ্বারা প্রভাবিত পর্যন্ত হয়েছেন। তবে নজরুলের মতো বিপ্লবী ছিলেন না। ছিলেন বরং বিষণ্ন ও বেদনাকাতর এবং নিঃসঙ্গ। পেটি বুর্জোয়া বৃত্তেরই মানুষ, কিন্তু তার ভেতর থেকেই অত্যন্ত সচেতন ছিলেন পুঁজিবাদী বিশ্বের অসুখ সম্পর্কে। ব্যবস্থাটির গভীরে ভীষণ অসুখের খবর রাখতেন বলেই তার কালের অন্যসব আধুনিক কবিকে ছাড়িয়ে গেছেন তিনি।

আমাদের বাংলাদেশেও ষাটের দশকে তরুণ কবিদের অসহায় বিষণ্নতাতে পেয়েছিল। নিজেদের তারা স্যাড ও অ্যাঙরি বলে ঘোষণা দিয়েছেন, কিন্তু ধরতে পারেননি আসল অসুখটা কী। এরা কয়েকটি পত্রিকা বের করেছেন, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল কণ্ঠস্বর। কণ্ঠস্বরের ম্যানিফেস্টোটি ছিল এই রকমের : “যারা সাহিত্যের সনিষ্ঠ প্রেমিক, শিল্পে উন্মোচিত, সৎ, অকপট, শব্দতাড়িত, যন্ত্রণাকাতর; যারা উন্মাদ, অপচয়ী, বিকারগ্রস্ত, অসন্তুষ্ট, বিবরবাসী; যারা তরুণ, প্রতিভাবান, অপ্রতিষ্ঠিত, শ্রদ্ধাশীল, অনুপ্রাণিত; যারা পঙ্গু, অহংকারী, যৌনতাস্পৃষ্ট, কণ্ঠস্বর তাদেরই পত্রিকা। প্রবীণ মোড়ল, নবীন অধ্যাপক, পেশাদার লেখক, মূর্খ সাংবাদিক, ‘পবিত্র’ সাহিত্যিক, এবং গৃহপালিত সমালোচক এই পত্রিকায় অনাহূত।” ১৯৬৫ সালে শেষের দিকে কণ্ঠস্বর-গোষ্ঠী যখন এ ধরনের বিদ্রোহ ঘোষণা করছে, তখন আইয়ুব খানের স্বৈরশাসন চরমে উঠেছে। মানুষ বিক্ষুব্ধ। সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন প্রবল হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন পণ্ড করে দিয়েছে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা। জাতীয়তাবাদীরা ফুঁসছেন। সমাজতন্ত্রীরা মতাদর্শ নিয়ে ভাবছেন, বিতর্ক করছেন, দলিল তৈরি করছেন পথযাত্রার এবং পাশাপাশি আন্দোলনের জন্য সংগঠিত হচ্ছেন। দুটোই বিদ্রোহ; কিন্তু দুই বিপরীত প্রান্তের এবং পরস্পরবিরোধী। আইয়ুব খানরা কিন্তু চাচ্ছিলেন তরুণরা ‘কণ্ঠস্বর’ধর্মী বিবরমুখী তৎপরতায় মগ্ন থাকুক।

ঠিক ওই সময়েই মোহাম্মদ মোর্তজা কিন্তু এদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের কাজ করছেন। অন্য ধরনের প্রবন্ধ লিখছেন, লিখছেন উপন্যাসও, উপন্যাসের নাম চরিত্রহানির অধিকার। উপন্যাস হিসেবে বড় কিছু নয়, কিন্তু বক্তব্যের দিক থেকে খুবই পরিষ্কার। কাহিনীর নায়ক মালেক চৌধুরী অসাধারণ মেধাবী এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মুখপাত্র। তার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট তরুণী রোকেয়া ইসলাম। মালেক এসেছে পেটি বুর্জোয়া শ্রেণি থেকে, রোকেয়া তার বুর্জোয়া বাবার একমাত্র সন্তান। বুর্জোয়া রোকেয়া নিজের শ্রেণিচরিত্রের হানি ঘটিয়ে মালেকের হাত ধরতে চাইছে, কারণ সে জানে তার সমাজে কোনো ‘বীর’ নেই, অধিকাংশই ভাঁড়; বীর আছে বাঙালি জাতীয়তাবাদী মালেক চৌধুরীর ভেতরে, যে বীর তাকে মুক্তি দিতে পারে। কিন্তু বিচ্ছেদ ছিল অবধারিত, কারণ জাতীয়তাবাদী মালেক চৌধুরীর পক্ষে অধঃপতিত বুর্জোয়াদের সঙ্গে মৈত্রী গড়া অসম্ভব। তাই বলে সে যে মেহনতিদের দলে চলে যাবে সেটাও পারবে না। সেখানে সে অক্ষম নিজের শ্রেণিচরিত্রের কারণে। উপন্যাসের শেষে তাই দেখা যায় ঘুঘু-ডাকা এক দ্বিপ্রহরে বেদনার্ত রোকেয়া বিদায় নিচ্ছে, কিন্তু তাতে মালেক চৌধুরী যে হাঁফ ছেড়ে বাঁচছে তা মোটেই নয়। তার মনে হচ্ছে জীবনটা তার শূন্যতায় ভরপুর। “তক্ষুনি যতদূর সে ভাবতে পারল তাতে ভবিষ্যতে তার জীবনে একটি বিরাট শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই নজরে পাড়ল না।” ঔপন্যাসিক বলেননি, কিন্তু ইঙ্গিত দিয়েছেন যে এই শূন্যতার কারণ শ্রেণিচ্যুত হয়ে সমাজবিপ্লবী রাজনীতিতে যোগদানে অপারগতা। তার ছোটাছুটি নিজের শ্রেণির ভেতরেই।

মোর্তজা উপন্যাসটি শেষ করে সন্তুষ্ট হতে পারেননি; একটি পরিশিষ্ট যোগ করে ঘটনার পটভূমিটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন। সেই পটভূমিতে আছে মালেক চৌধুরীর শ্রেণিগত জাতীয়তাবাদী অবস্থানের ব্যাখ্যা। সে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। মোর্তজা লিখেছেন, “রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনই পাকিস্তানী বাঙালী মুসলমান সুবিধাভোগীদের প্রথম সচেতন দাবী, যার মর্মবাণী ছিল ‘আমাদেরকেও দিতে হবে’ ”; অর্থাৎ সম্পদের হিস্সা আমরাও চাই। স্মরণীয় যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের দাবি ছিল বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার; আওয়াজটা ছিল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, উর্দু বাংলা ভাই ভাই।’ পরিষ্কার ভাগাভাগির দাবি। আশ্চর্য পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে এই তরুণ লেখক ১৯৬৫ সালে লিখেছেন, “পশ্চিম পাকিস্তানী সুবিধাভোগীদের দূর পর্যায়ের ও সর্বশেষ স্বার্থের খাতিরেই ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলা তাদের দরকার; অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানী সুবিধাভোগীদের সঙ্গে একটা ভারসাম্যে আসা তাদের উচিৎ। নইলে, বলা যায় না, একেবারে ভরাডুবি ঘটতে পারে।”

মিটিয়ে ফেলতে পারেনি, ফলে ভরাডুবি ঘটেছে। তবে মোর্তজা ভরাডুবিটা দেখে যেতে পারেননি। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর আলবদর ঘাতকরা তাকে তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায় এবং তিনি আর ফিরে আসেননি। মোর্তজা জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারাতে ছিলেন না, তার যোগ ছিল পিকিংপন্থি গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। উল্লেখ্য যে, একাত্তরে আলবদরদের হাতে যে বুদ্ধিজীবীরা শহীদ হয়েছেন তারা ছিলেন হয় সমাজতন্ত্রী নয়তো উদারনৈতিক, আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের কারোই যোগাযোগ ছিল না। মোর্তজা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন সহকারী মেডিকেল অফিসার, কিন্তু আলবদররা তাকে চিনত, জানত তিনি লেখেন এবং তার বাসাতে আনাগোনা চলে গোপন পার্টির কর্মী ও নেতাদের। আলবদরদের চোখে তিনি জাতীয়তাবাদীদের চাইতেও ভয়ঙ্কর শত্রু ছিলেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়াতে পেটি বুর্জোয়াদের একাংশ ধনদৌলতে বুর্জোয়া হওয়ার পথ পেয়ে গেছে এবং নিজেদের বাঙালিত্ব ভুলেছে। ওদিকে প্রাণ দিয়েছে অসংখ্য সাধারণ মানুষ, যাদের ভেতর জাতীয়তাবাদীরা ছিলেন, তবে বামপন্থিরাই ছিলেন অধিক সংখ্যায়। বামপন্থিদের বিপদ ছিল দু’মুখো, তারা হানাদার ও হানাদারদের স্থানীয় অনুচরদের দ্বারা যেমন; তেমনি মুজিব বাহিনীর দ্বারাও আক্রান্ত হয়েছে। ওদিকে মোর্তজাকে যখন আলবদররা খুঁজছে, ঠিক সেই সময়েই বিপন্ন অবস্থায় কণ্ঠস্বর সম্পাদক ও তার এক সাহিত্যিক বন্ধুর যে-অভিজ্ঞতা সেটা সম্পাদকের ভাষাতে এ রকমের : ‘বিমানযুদ্ধের মধ্যে বসে আত্মবিস্মৃতের মতো সারাদিন কালিদাসের কুমারসম্ভব পড়ে চলেছি, মত্ত আত্মবিস্মৃত আবেগে।’ বাইরে তখন প্রলয় চলছে।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে অবাঙালি ও বাঙালিদের ভেতর বিরোধ হিসেবে সীমিত না রেখে সারা পাকিস্তানের জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের আন্দোলনে পরিণত করার কথা বায়ান্নতেই কিন্তু কমিউনিস্টরা বলেছিল। বায়ান্ন সালের ২ ফেব্রুয়ারিতে প্রচারিত ইশতাহারে তাদের পার্টির দাবি ছিল,

পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী জাতি, যেমন বাঙালী, পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধী, বেলুচী— প্রত্যেকেই নিজ নিজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অনুযায়ী উন্নতি লাভ করুন, সমস্ত ভাষা, যেমন উর্দু, বাংলা, পুস্তু, পাঞ্জাবী, সিন্ধী সমস্ত ভাষাকেই রাষ্ট্রে সমান অধিকার দেওয়া হোক— ইহাই পাকিস্তানবাদী সকল জাতির কাম্য।

পার্টির প্রস্তাব ছিল যে স্লোগানটা হওয়া দরকার, ‘পাকিস্তানের সকল ভাষার সমমর্যাদা চাই।’ পার্টি আরো যা বলতে চেয়েছে তা হলো, বাংলা ভাষার দাবিকেও পেটি বুর্জোয়াদের সীমার ভেতর না-রেখে সকল শ্রেণির মানুষের দাবিতে পরিণত করা হবে। বায়ান্ন সালের ১১ ফেব্রুয়ারিতে প্রচারিত তাদের ইশতাহারে বলা হয়েছে, আন্দোলনের প্রধান দুর্বলতা এই যে, অবাঙালিরা মনে করছে এটা তাদের বিরুদ্ধে। তাই, ‘আমাদের আন্দোলন পাকিস্তানের প্রত্যেক জাতি যাহাতে নিজ নিজ মাতৃভাষায় রাষ্ট্রের কাজ পরিচালনা করার অধিকার পায় তাহারই জন্য, তাহা খুব ভালো করিয়া বাঙালী-অবাঙালী সকলকেই বুঝাইতে হইবে।’

এরপরেই বলা হয়েছে,

এই আন্দোলনের আর একটি বিশেষ দুর্বলতা এখনো রহিয়া গিয়াছে। কারণ এই আন্দোলন এখনও পূর্ববঙ্গের জনসাধারণের ব্যাপক অংশের মধ্যে প্রসার লাভ করে নাই। রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন এখনও প্রধানত শহরে ছাত্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকিয়া যাইতেছে। পাকিস্তানের মজুর ও কৃষক শ্রেণী...যাহাতে এই আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে এবং আন্দোলনকে সঠিকপথে নিয়ে যাওয়ার জন্য আগাইয়া আসিতে পারে তার জন্য আমাদের পার্টির তরফ হইতে বিশেষ প্রচেষ্টা নেওয়া দরকার।

মোহাম্মদ তোয়াহা তখন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। তিনি স্মরণ করেছেন যে ভাষার গুরুত্ব বিষয়ে তিনি সচেতন হন স্ট্যালিনের Marxism and Problems of Linguistics নিবন্ধটি পড়ে। সেখান থেকে তিনি সকল ভাষার সমানাধিকারের ধারণাটি পান এবং ১৯৫০ সালে ঢাকায় গণতান্ত্রিক সংবিধানের দাবিতে যে মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তার কয়েক দিন আগে ওই চিন্তার ভিত্তিতে লেখা একটি প্রবন্ধ দৈনিক ইনসাফে প্রকাশ করেন। চেষ্টা ছিল মহাসম্মেলনের প্রস্তাবাবলিতে সকল ভাষার সমান অধিকারের দাবিটি অন্তর্ভুক্ত করার, কিন্তু সমর্থন পাওয়া যায়নি। সে সময়ে অনেকেরই ধারণা ছিল যে, উর্দু পশ্চিম পাকিস্তানের সব মানুষেরই ভাষা।

 

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads