• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রভাব

আষাঢ় শেষে শ্রাবণের শুরুতে উত্তরাঞ্চলের সীমান্তঘেঁষা জেলা কুড়িগ্রামের অবস্থা ভয়াবহ

ছবি: সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রভাব

  • আবদুল হাই রঞ্জু
  • প্রকাশিত ২৬ জুলাই ২০১৮

ছয় ঋতুর বাংলাদেশে আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল। আষাঢ় পেরিয়ে শ্রাবণ এলো, কিন্তু বৃষ্টির দেখা মিলল না। উল্টো প্রচণ্ড রোদের তাপে ভ্যাপসা গরমে জনজীবনের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। শ্রাবণের শুরুতে গভীর সমুদ্রে লঘুচাপের কারণে দেশের দু-চারটি এলাকায় ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হলেও এখনো রোদের তীব্রতা অব্যাহত রয়েছে। আবহাওয়া অফিস বলছে, সামনের দিনগুলোতে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে (যদিও বিগত ৩-৪ দিন ধরে সাগরে লঘুচাপের কারণে টানা বর্ষণ চলছে)। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রকৃতিতে পরিবর্তন এসেছে। বেশ ক’বছর ধরে আবহাওয়ার এ রকমই চিত্র দেখা গেছে। বিশেষ করে আষাঢ় শেষে শ্রাবণের শুরুতে উত্তরাঞ্চলের সীমান্তঘেঁষা জেলা কুড়িগ্রামের অবস্থা ভয়াবহ। এখানে গত মাস জুড়েই ছিল তীব্র রোদ আর ভ্যাপসা গরম। গত ১৯ জুলাই/৪ শ্রাবণ দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে কুড়িগ্রামের রাজারহাটে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও তাপমাত্রা কমবেশি হলেও এ রকমই থাকে। মূলত অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণের কারণে গোটা বিশ্বেই এখন উষ্ণতা বেড়ে চলছে। আর বৈশ্বিক উষ্ণতা যত বাড়বে তত বেশি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বাড়বে। ফলে অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, অসময়ে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডোর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েই চলেছে।

এরই মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত বাংলাদেশের মানুষকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফসল নষ্ট হচ্ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটছে, খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে, পানিবাহিত রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী এখন চরম দৈন্যদশার মুখোমুখি। এমনকি কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ৪ ডিগ্রি পর্যন্ত বৃদ্ধি পেলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বাড়বে, তাতে বিশ্বের ৭৬ কোটি মানুষের বসতবাড়ি তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরিত হচ্ছে, তা যদি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখা সম্ভব হয়, তাহলেও বিশ্বের ১৩ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, বিশ্বে দারিদ্র্যসীমার নিচে ৭০ কোটি মানুষ বসবাস করছে, যা মোট জনগোষ্ঠীর ৯.৬ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ স্টেফান হেলগেট বলেছিলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমানোর পাশাপাশি দারিদ্র্য নির্মূলের কৌশলও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেল ইউএনএফসিসির কাছে দেওয়া ‘জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় জাতীয়ভাবে অনুমিত অঙ্গীকার (আইএনডিসি)’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, মোট কার্বনের ২৩.৭৫ শতাংশ নিঃসরণ একাই করে চীন। দ্বিতীয় দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ১২.২ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ করে। আর অর্থনৈতিকভাবে উদীয়মান দেশ ভারত ৫.৭৩ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ করে। উল্লিখিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, যেখানে উন্নত দেশগুলো ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কার্বন নিঃসরণ করছে, সেখানে বাংলাদেশের কার্বন নিঃসরণের মাত্রা মাত্র ১.১৭ শতাংশ। অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য উন্নত দেশগুলো দায়ী হলেও বাংলাদেশের মতো সমুদ্র উপকূলবর্তী উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তার মাশুল গুনতে হচ্ছে। এ কারণে উন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু তহবিল গঠনের জন্য চাপ দিলেও প্রতিশ্রুতি যেভাবে আসে, সে অনুযায়ী তহবিল সংগৃহীত হয় না। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবেলায় বার বার জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ঠিকই, কিন্তু আলোচনার মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকে। কার্যত কাজের কাজ কিছুই হয় না। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে দুই কোটি মানুষ জলবায়ুতাড়িত হয়ে বাস্তুচ্যুত হবে। তাদের দায়দায়িত্ব জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী দেশগুলোকে নিতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, শিল্পোন্নত দেশগুলোর ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল না হয়ে বরং নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী তহবিল গঠন করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত আমাদেরকেই মোকাবেলা করার উদ্যোগ নিতে হবে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পরনির্ভরশীলতার বদলে নিজস্ব অর্থায়নে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবেলার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে আড়াই হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছিলেন, যা তিনি অতিসম্প্রতি জাতীয় সংসদে পুনর্ব্যক্ত করেছেন। অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর এ উদ্যোগ যথার্থ, সময়োচিত এবং প্রশংসনীয়। প্রতিবছর জাতীয় বাজেটে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবেলার জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি করে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না হলে এর বিরূপ প্রভাবে আমাদের যে পরিমাণ ক্ষতি হবে, তা পুষিয়ে নেওয়া কঠিন হবে।

অতিসম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকীয়তে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের প্রকৃত চিত্র চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ওই সম্পাদকীয়তে বলা হয়, পরিবেশ ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের মানুষকে নিত্যনতুন অস্বাভাবিক আবহাওয়ার মুখোমুখি হতে হবে। মূলত শিল্প থেকে নির্গত কার্বনের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। যেহেতু আবহাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই, সেহেতু এক দেশের বৈরী আবহাওয়ার প্রভাব অন্য দেশে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের দেশে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা অতি সামান্যই। এরপর বৈরী আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব আমাদের জনজীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার নদ-নদী, খাল-বিল, ডোবা শুকিয়ে যাওয়ায় পানির অভাবে জলীয়বাষ্পও সেভাবে তৈরি হচ্ছে না। ফলে অনাবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন আমাদের নিত্যসঙ্গী। আবার উজানের বন্যা ও বর্ষণের কারণে আমাদের দেশেও অসময়ে বন্যা এসে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে। আর ফসলের ক্ষতি মানে আমাদের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়া। হচ্ছেও তাই। এ বছরও সাধারণ মানুষকে চড়া দামে চাল কিনে খেতে হচ্ছে। চলছে শ্রাবণ মাস। খাল-বিল আবাদি জমি শুকিয়ে কাঠ হওয়ার মতো অবস্থা। তারই মাঝে কয়েক দিনের অতিবৃষ্টিতে আবার বন্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। মূলত আমন মৌসুমে প্রকৃতির দেওয়া বৃষ্টিতেই চাষিরা চাষাবাদ করে থাকেন। কিন্তু এ বছরের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমন চারা রোপণের সময় পার হয়েই যাচ্ছে। এতদিন আমন চাষাবাদ শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু চাষিরা পানির অভাবে চারা রোপণ করতে পারছেন না।

কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ বৃষ্টি না হলে হয়তো শেষ পর্যন্ত বোরো চাষাবাদের ন্যায় আমনেও সেচ দিয়ে চারা রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের পর অসময়ে বৃষ্টি কিংবা বন্যার কবলে যদি পড়তে হয়, তাহলে আমন ফসল নষ্ট হবে। আর আমন ধানের ক্ষতি হলে শেষ পর্যন্ত চারার অভাবে নতুন করে চাষিরা আমন ধান লাগাতেও পারবেন না। তাহলে আমনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না এবং ফলে সাধারণ ভোক্তার কষ্ট বাড়তেই থাকবে।

মোদ্দা কথা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত এখন বাংলাদেশের জীবন-জীবিকার জন্য মারাত্মক হুমকি। এজন্য দায়ী ধনী দেশগুলো। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবেলার সক্ষমতা ধনী দেশগুলোর আছে, যা সত্য। কিন্তু আমাদের মতো দেশগুলোর সে সক্ষমতা নেই বললেই চলে। ফলে মনুষ্যসৃষ্ট এ সমস্যাকে সম্মিলিতভাবেই মোকাবেলা করা উচিত। আর তা করতে না পারলে এর বিরূপ প্রভাব গোটা বিশ্বের মানুষের বেঁচে থাকার পথে বড় অন্তরায়, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads