• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
সমাজ পরিবর্তনের অন্তরায় বাল্যবিয়ে

বর্তমানে বহুল আলোচিত একটি সামাজিক সমস্যা হচ্ছে বাল্যবিয়ে

ছবি: প্রতীকী

সম্পাদকীয়

সমাজ পরিবর্তনের অন্তরায় বাল্যবিয়ে

সমাজ পরিবর্তনের অন্তরায় বাল্যবিয়ে

  • মিজান মনির
  • প্রকাশিত ২৭ জুলাই ২০১৮

বর্তমানে বহুল আলোচিত একটি সামাজিক সমস্যা হচ্ছে বাল্যবিয়ে। বাল্যবিয়ের অনেক কারণ রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য— অশিক্ষা, মেয়েদের বোঝা মনে করা, ইভটিজিং, দারিদ্র্য, সামাজিক অসচেতনতা, যৌন হয়রানি, কুসংস্কার ইত্যাদি। বখাটেদের উৎপাত থেকে মুক্তি দিতেই বাবা-মায়েরা কম বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিতে বাধ্য হন। স্কুল এবং কলেজপড়ুয়া মেয়েদের নিয়ে বাবা-মা চিন্তায় পড়ে যান। অনেকেই সমাধানের সহজ পথ হিসেবে মেয়েদের বিয়ে দেন কম বয়সেই। অর্থাভাবের কারণে বাবা-মা তাদের কোমলমতি মেয়েকে কৈশোর পার হওয়ার আগেই বিয়ে দিতে বাধ্য হন। বাল্যবিয়ের ফলে আঁধারে হারিয়ে যায় কোমলমতি কিশোরীর স্বপ্নেভরা সুন্দর এক আগামীর স্বপ্ন। বিয়ে মানব জীবনের জন্য অপরিহার্য হলেও স্বল্প বয়সে বিয়ে নারী ও পুরুষ উভয়েরই সমাজ ও ব্যক্তিজীবন নানা ক্ষেত্রে সঙ্কটময় করে তোলে। বাল্যবিয়ের ফলে মানুষের মৌলিক চাহিদার তেমন ক্ষতি না হলেও অকালে ঝরে পড়ে একটি শিশুর সোনালি ভবিষ্যৎ। রঙিন স্বপ্নের ঘুড়ি নিমিষেই সুতো ছিঁড়ে যায়; আর চলে যায় অজানা কোনো এক গন্তব্যে।

বর্তমানে বাংলাদেশে বিয়ে আইন থাকার পরও এর কোনো সঠিক প্রয়োগ নেই— ফলে বাল্যবিয়ে দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। নারী উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা বিয়েকে নারী ক্ষমতায়নের পথে অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করেন। নারীর উন্নয়ন ছাড়া দেশ ও জাতির আগামীর ভবিষ্যৎ টেকসই হতে পারে না। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ও আইসিডিডিআর,বি বাল্যবিয়ে প্রসঙ্গে গত বছর যে জরিপ প্রকাশ করেছে, তাতে বাল্যবিয়ের চিত্রটি দেখা যায় সত্যিই ভয়াবহ-দুঃখজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। দেশের শতকরা ৬৪ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছরের আগেই। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত ২৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, ১০ বছরের বেশি বয়সী নারীর মধ্যে এখন ৬৫ দশমিক ৪ শতাংশই বিবাহিত। এ ছাড়া ৯ দশমিক ১ শতাংশ নারীই বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা কিংবা আলাদা থাকেন। এ দুটি সূচকেই ফলাফল আগের বারের চেয়ে পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। আর পুরুষের মধ্যে ৫৯ দশমিক ৯ শতাংশই বিবাহিত। ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সের নারীর মধ্যে যাদের ১৮ বছরের মধ্যে প্রথম বিয়ে হয়, তাদের শতকরা হার হলো ৬৬ শতাংশ। বাল্যবিয়ের কারণে দেশের ৩০ শতাংশ মা এবং ৪১ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভোগে। বিয়ের পরেই স্বামী ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য নতুন মুখ দেখতে চায়। বিয়ের প্রথম বছর বা দ্বিতীয় বছরের মধ্যেই সন্তান না এলে স্বামীর পরিবার কিশোরী মেয়েকে চাপ দেয়। একদিকে সন্তান নেওয়ার চাপ, অন্যদিকে কৈশোরের সোনালি দিন বিসর্জন দিয়ে এক যন্ত্রণার কারাগারে বসবাস করে বাল্যবিয়ের শিকার হওয়া কিশোরী। অপরিণত বয়সে সন্তান জন্মদানের ফলে মেয়ে ও নবজাতক অপুষ্টিতে ভোগে।

জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) গত বছর প্রকাশিত ‘প্রোগ্রেস ফর চিলড্রেন এচিভিং দি এমডিজিস উইথ ইকুইটি’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমাদের দেশে ১৮ বছর বয়সের আগেই ৬৬ শতাংশ মেয়ে-শিশু ও একই বয়সের পাঁচ শতাংশ ছেলে-শিশুর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ৬৯ শতাংশ মেয়ের ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। নিজের ইচ্ছার মূল্য নেই এসব কোমলমতি কিশোরীর। অনেকেরই বেশি বয়সের বরের সঙ্গে বিয়ে হতে দেখা যায়, যা একটি কিশোরীর কোমল হূদয়ে ক্ষতের সৃষ্টি করে যা সাধারণত সংসারের অন্য কেউ বুঝতে চান না। সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ের সংগঠন আপসহীনভাবে বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাচ্ছে কিন্তু বাল্যবিয়ের মাত্রাটা আশানুরূপ হ্রাস পাচ্ছে না; কারণ কুসংস্কার ও আইনের সঠিক প্রয়োগ নেই।

এই বাল্যবিয়ে শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রেই নয়, ছেলেদের ক্ষেত্রেও হয়। ইউনিসেফ জানিয়েছে, ৫ শতাংশ বাংলাদেশি ছেলের বিয়ে হয় শিশুকালে। বাল্যবিয়ের কুপ্রভাব মেয়েদেরই বেশি আক্রান্ত করে থাকে। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখার মান উন্নয়ন চোখে পড়ে কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ালেখায় ছেদ পড়ে যায়। মূলত এসবের জন্য দায়ী অনুপযুক্ত বয়সে বিয়ের ব্যবস্থা করা। আসলেই মূল সমস্যা আমাদের প্রচলিত মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৮ বছরের আগে মেয়েদের শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সন্তান ধারণের মতো একটি কঠিন প্রক্রিয়া পরিপূর্ণরূপে গঠিত হয় না। ফলে প্রসবকালীন খিঁচুনি, ঝুঁকিপূর্ণ মাতৃত্ব, জরায়ুর ক্যানসার ও নবজাতকের বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়।

এক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘনের দায়ে সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় শাস্তি দেওয়া হলেও অনেক জায়গাতেই আইন প্রয়োগ করতে বিভিন্ন ধরনের বাধা রয়েছে। ১৯২৯ সালের (১৯৮৪ সালের সংশোধিত আইন) আইনে উল্লেখ আছে, বিয়ে সংঘটকদের একমাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ১ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। বিয়ে প্রতিরোধে প্রয়োজন সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ করা। আইন প্রয়োগ হলে অনেকক্ষেত্রে বাল্যবিয়ে হ্রাস পাবে। দেশ ও জাতির উন্নয়নে চাই নারীর অংশগ্রহণ। নারীর উন্নয়ন ছাড়া দেশ ও জাতির উন্নয়ন চিন্তা করা একধরনের বাতুলতা মাত্র। তাই তো সাম্যবাদী কবি নজরুল লিখেছেন— ‘বিশ্বে যা কিছু মহান চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’

প্রখ্যাত ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন— ‘আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।’ এই দুই প্রখ্যাত ব্যক্তির মূল্যবান কথা যেন হারিয়ে যাচ্ছে এই চরম সভ্যতা ও সময়ের ভেতরেও বাল্যবিয়ে নামক কুসংস্কারের আঁধারে। বাল্যবিয়ের মাধ্যমে একজন নারীর শিক্ষার দ্বার রুদ্ধ করা হচ্ছে। যে বয়সে একটি মেয়ে নিজেকে গঠন করবে, সেই বয়সে তাকে দায়িত্ব নিতে হয় একটি পরিবারের। সেই নারী কি পারবে নিজেকে এগিয়ে নিতে আর পুরুষের যথার্থ সঙ্গিনী হয়ে কল্যাণকর কাজে নিজেকে যুক্ত করতে? সুতরাং বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে চাই সামাজিক সচেতনতা আর আইনের সঠিক প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন। পাশাপাশি পথপ্রদর্শকের ভূমিকা নিয়ে রাষ্ট্র এবং প্রশাসনকে থাকতে হবে সজাগ। তবেই একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র এগিয়ে যাবে তার নিজ গতিধারায়।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

mizanmonirctg92@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads