• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
সাংবাদিকতায় ভয়-ডরের দুরন্তপনা

বিভুরঞ্জন সরকার

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

সাংবাদিকতায় ভয়-ডরের দুরন্তপনা

  • প্রকাশিত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আমি সম্ভবত কয়েক হাজার রাজনৈতিক লেখা লিখেছি; কিন্তু এরশাদ, খালেদা, হাসিনা কারোরই মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারলাম না। তবে হ্যাঁ, একেবারে কারো মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারিনি বললে ভুল বলা হবে।

একবারের একটি ঘটনা বলি। তখন আমি সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে কাজ করি। খালেদা জিয়ার শাসনকাল। ইলিয়াস আলী নামের এক ডাকসাইটে ছাত্রদল নেতার ওপর একটি প্রতিবেদন ছাপা হলো যাযাদিনে।

তখন কাকরাইলে যাযাদি অফিস। একদিন সন্ধ্যায় একটি মাইক্রোবাসে করে কয়েকজন সশস্ত্র যুবক এলেন। যাযাদি অফিসে ঢুকে আমার নাম-পরিচয় জেনে আমাকে টেনেহিঁচড়ে মাইক্রোতে তোলার চেষ্টা শুরু হলো। আমার তো ভয়ে কাপড় নষ্ট হওয়ার জোগাড়। মাত্র কিছুদিন আগে বিয়ে করেছি। একটি কন্যাসন্তানের জন্ম হয়েছে। স্ত্রী-কন্যার মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি মিনমিনে গলায় বললাম, ভাই, আপনারা কারা? আমার দোষই বা কী? বাজখাই গলায় একজন বলে উঠলেন, আমার নাম ইলিয়াস আলী। আমার নাম শুনলে এখন বাংলাদেশে ডরায় না এমন কোনো হালার পুত আছে? তুই ব্যাটা মালাউনের বাচ্চা নাম ভাড়াইয়া আমার বিরুদ্ধে নিউজ লেখস। আজ শালা তোর শেষ দিন। শেষ দিন শুনে আমি চোখ বুজে চুপ হয়ে গেলাম আর অপেক্ষা করতে থাকলাম, একটি গুলির শব্দের। না, সময় গড়ায়। গুলির শব্দ শুনি না।

কেউ একজন বলেন, বস, এই হালা তো এমনিতেই মুইতা দিছে। ওরে মাইরা আপনার সুনাম নষ্ট করার দরকার কী? মহাপ্রাণ, সহূদয় এবং অতি দয়ালু ইলিয়াস আলী তার সঙ্গে একমত হয়ে বললেন, ঠিক কইছস, মশা মাইরা হাত নষ্ট করার কাম নাই।

তারপর আমার চুলের মুঠি ধরে (তখন আমার মাথাভর্তি চুল ছিল) বসিয়ে দুই গালে কষে দুই থাপ্পড় মেরে বললেন, শালার পুত, ইলিয়াস আলীর নামে যদি আর কোনো কিছু লেখার সাহস দেখাস, তাহলে তোর লাশ চিতায় উঠব। তারপর তারা বীরদর্পে মাইক্রোতে চড়ে চলে গেলেন।

আমার বুকের সেই ধুকপুকানি এখনো আছে। কেবল ইলিয়াস আলীকেই যেন কারা বেপাত্তা করে দিলেন! আহা, বেচারা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তার দয়ায়ই তো আমি এখনো দু-চার লাইন লিখে খেতে পারছি!

আমি যে একটা ভীতুর ডিম, তার অনেক উদাহরণ-প্রমাণ আমি দিতে পারব। আমার স্কুলজীবনের বন্ধুদের মধ্যে যারা এখনো জীবিত আছেন, তারা আমার ভয়ের নানা ভয়ঙ্কর গল্প এখনো মনে করতে পারবেন। কত কিছু নিয়ে যে আমি ভয় পেতাম! বাড়ি থেকে বন্ধুদের সঙ্গে দূরে কোথাও যেতাম না, যদি হারিয়ে যাই! পানিতে নেমে গোসল করতাম না, যদি ডুবে যাই। সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতাম না, যদি ‘ছলাকলা’ করে আমাকে ‘নষ্ট’ করে দেয়! গল্প-উপন্যাস পড়তাম না, যদি প্রেমের সংলাপ শিখে ফেলি!

মাথায় তেল দিতাম না, যদি তেলতেলা স্বভাব হয়ে যায়! পেটপুরে খেতাম না, যদি চেহারাটা নাদুসনুদুস হয়। ছোট থেকে ভয়ের কারণে কত কিছু থেকে যে নিজেকে দূরে রাখতাম! জীবনে কোনো দিন ফুটবলে লাথি মারিনি, যদি পায়ে ব্যথা পাই! কত ভয়ের কথা আর বলব!

কথায় বলে যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়। আমিও ভয় বেশি পাই বলে ভয়ও সারাক্ষণ আমার পিছু পিছু চলতে পছন্দ করে। আমি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেওয়ায় কেউ কেউ মনে করেছিলেন, এই নির্বিরোধ পেশায় আমি বুঝি ভালোই করব। এখানে ভয়ডর নিয়ে তটস্থ থাকতে হবে না। ও মা, সাংবাদিকের খাতায় নাম লিখিয়ে শুনি, এ পেশায় নাকি পদে পদে বিপদ, ঝুঁকি। একজন ভালো সাংবাদিকের নাকি কোনো বন্ধু থাকে না। তো, ঠিক করলাম, নিকুচি করি সৎ সাংবাদিকতার! আমি খারাপ সাংবাদিকই হব আর বন্ধুহীন থাকব না। কিন্তু আমি ভয়ের ভয়ে ভালো থাকতে চাইলে কী হবে, ভয় যে আমাকে ছাড়তেই চায় না। যতই হ্যাপামুক্ত থাকতে চাই, ততই হ্যাপা আমাকে জড়িয়ে ধরে!

তখন ১৯৯৬ সাল। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী। আমরা বেজায় খুশি। এতদিন পর বঙ্গবন্ধুর দল ক্ষমতায় এসেছে। আমি যায়যায়দিন ছেড়ে নিজেই প্রকাশক-সম্পাদক হয়ে চলতিপত্র নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করলাম। চলতিপত্রের এক সংখ্যায় ছাত্র রাজনীতিতে সন্ত্রাস-মাস্তানি নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হলো। প্রতিবেদনটি ছিল তথ্যবহুল এবং একেবারেই পক্ষপাতমুক্ত। পত্রিকার ওই সংখ্যাটি বাজারে যাওয়ার পরদিন আমি বিকেলের দিকে অফিসে বসে আছি, পুরানা পল্টন মোড়ে বিএসএসের নিচের দিকে ছিল চলতিপত্র অফিস। বিকেলে আর তেমন কেউ অফিসে ছিল না। আটদশজন তরুণ অফিসে ঢুকলেন। বেশ আদবের সঙ্গে আমাকে সালাম দিলেন। আমার শরীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন। বললেন, তারা আমার ভক্ত, পরিচিত হতে এসেছেন। আমি মনে মনে একটু পুলকিত হলাম। আমাদের ছাত্রকর্মীরা পড়াশোনা করছে জেনে ভালো লাগল। ওদের চা খেতে বললাম। রাজি হলো না। একজন দাঁড়িয়ে বললেন, আজ থাক দাদা, আপনার সঙ্গে আবার হয়তো দেখা হবে। করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে পরিচয় দিয়ে বললেন, আমার নাম পিচ্চি শামিম। আমি ছাত্রলীগের নেতা। আপনার পত্রিকায় যে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, তাতে আমাকে ভয়াবহ সন্ত্রাসী বলে উল্লেখ করা হয়েছে!

আমার শরীর শীতল হয়ে উঠল। তলদেশে চাপ অনুভব করলাম। ওর হাত তখনো আমার হাত চেপে ধরে আছে, ছাড়াতে পারছি না। মুখ দিয়ে আমার কোনো কথাও বের হচ্ছে না।

এবার শামিমের হাত পকেটে ঢুকল। বেরিয়ে এলো একটি পিস্তল। আমার ডান কান বরাবর মাথায় ঠেকিয়ে বললেন, দাদা ট্রিগার টিপলে কোনো শব্দ হবে না। আপনার নিথর দেহটা শুধু চেয়ারে বসে থাকবে। বউদি বিধবা হবে। মেয়েটা এতিম হবে।

আমি বাকরহিত। ইস, কেন যে সাংবাদিক হতে গেলাম! জীবনের শেষ মুহূর্ত ভেবে ঈশ্বরকে স্মরণ করলাম। যদিও কমিউনিস্ট হিসেবে তখন আমার ঈশ্বরবিশ্বাস প্রবল নয়। কয়েক মুহূর্ত কেটেছে বলতে পারব না। শামিম তার অস্ত্রটি পকেটে ঢুকিয়ে সঙ্গীদের বললেন, আজ দাদাকে একটু ভয়ডোজ দিলাম। আবার আমার নাম প্রতিবেদনে এলে বউদির সাদা কাপড় আমিই পৌঁছে দিয়ে আসব। হাত তুলে সালাম দিয়ে চলে গেলেন মূর্তিমান আতঙ্ক পিচ্চি শামিম।

আমি ভাবলাম, কত বড় মনের মানুষ তিনি। সুযোগ পেয়েও আমার মাথা ফুটো করলেন না। এমন অসাধারণ দয়াবান মানুষ নিয়ে কী সব বাজে কেচ্ছা আমরা পত্রিকায় ছাপি!

এই ঘটনার মাস তিনেকের মধ্যেই প্রতিপক্ষের গুলিতে প্রাণ হারান পিচ্চি শামিম। তার অমন করুণ মৃত্যুসংবাদে আমার চোখ গড়িয়ে দু’ফোঁটা পানি পড়েছিল! আহা রে, মানুষের জীবন কত অনিত্য। সেই ভীরু আমি আজো আছি, অথচ নেই তখনকার অতিসাহসী পিচ্চি শামিম।

 

আমি যেসব ভয়ের কথা লিখছি, তাতেও কিন্তু আমার ভয় ভয়ই লাগছে। এসব লিখে আবার কোনো বিপদ ডেকে আনছি না তো! আমার ভয় কাটানোর জন্য আমাদের বাড়িতে নাকি আমার ঠাকুমা বিশেষ পূজার আয়োজন করেছিলেন। পুরোহিতকে যথাযথ সম্মানী দিয়ে পাড়া-প্রতিবেশীদের ভূরিভোজের আয়োজন করে ভক্তিভরে পূজাআর্চা করার পরও ভয় আমার কাটেনি। আমার মা বলেন, ছোট থেকে ঠাকুরদেবতার প্রতি আমার ভক্তিবিশ্বাস নাকি একটু টলটলায়মান। সেজন্য মহামহিম ঈশ্বর আমার শরীরে এমন এক ফুঁ দিয়ে দিয়েছেন, যাতে আমি কোনোদিন ভয়মুক্ত তথা বিপদমুক্ত হতে না পারি।

আজ একটু অন্যরকম ভয়ের গল্প বলি। ১৯৯৬ সালের কোনো একসময়। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ তখন দেশের রাষ্ট্রপতি। তখন তিনি অতি সম্মানিত ব্যক্তি। তার জনপ্রিয়তা যে কোনো রাজনৈতিক নেতার তুলনায় বেশি।

আমি সাপ্তাহিক চলতিপত্রে তাকে নিয়ে একটি লেখা লিখলাম। বেশিটাই প্রশংসা, আবার একটু নিন্দেমন্দের ছিটেও ছিল। একদিন চলতিপত্রের ল্যান্ডফোন বেজে উঠল। মোবাইল সাহেব তখনো দেশে তসরিফ আনেননি। আমিই ফোন তুললাম। ওপাশ থেকে একটি গম্ভীর কণ্ঠ, বিভু সাহেব বলছেন? জি, বলছি। আমি বঙ্গভবন থেকে মহামান্য রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব বলছি। আমার কণ্ঠ রুদ্ধ। খাইছে আমারে। এইবার লেখার শখ মিটে যাবে। সাহাবুদ্দীন সাহেবের মতো মানুষকে নিয়ে আমি ঠাট্টামশকরা করেছি। নিশ্চয়ই সেজন্য বড় কাফফারা দিতে হবে।

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ওপাশ থেকে প্রায় ধমকের মতো ভেসে এলো : আপনি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছেন। আমি মিনমিনে গলায় বলি- জি শুনছি, বলুন। আগামীকাল সকাল এগারোটায় মহামান্য রাষ্ট্রপতি আপনাকে চায়ের দাওয়াত দিয়েছেন। আশা করি আপনার সময়ের সমস্যা হবে না। কী বলে যে ফোন রেখেছিলাম, সেটা আর মনে নেই। তবে ভয়ে যে আমার বুক শুকিয়ে কাঠ হয়েছিল, সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। এটা যে আমার জন্য কত বড় সম্মানের ব্যাপার ছিল, সেটা আমার মাথায় না এসে মাথা ঘুরছে, নিশ্চয়ই ডেকে নিয়ে লেখার জন্য বকুনি প্যাদানি দেবেন!

তাড়াতাড়ি ফোন করলাম মতি ভাইকে। মতিউর রহমান, আমার একসময়ের সম্পাদক, সাংবাদিকতার শিক্ষাগুরু। সব শুনে তিনি বললেন, আরে এত ঘাবড়ানোর কী আছে? রাষ্ট্রপতি তোমাকে চায়ের দাওয়াত দিয়েছেন, এটা তো সৌভাগ্যের ব্যাপার। অনেকে তো চেষ্টা করেও তার সাক্ষাৎকার পাচ্ছেন না।

আমি লেখার প্রসঙ্গ তুললে মতি ভাই বললেন, আরে বোকা, ছোট পাত্র গরম হয় তাড়াতাড়ি। সাহাবুদ্দীন সাহেব অনেক বড় পাত্র। পরদিন যথাসময়ে একটি রিকশা নিয়ে বঙ্গভবনের কোনায় গিয়ে নামলাম। সঙ্গে নিলাম এক তোড়া গোলাপ। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে তার কক্ষে ঢুকে করমর্দনের আগে হাতে দিলাম ফুলের তোড়া। কী সুন্দর নিষ্পাপ শিশুর মতো একটি হাসি দিয়ে বললেন, আবার পয়সা খরচ করছেন ক্যান!

বঙ্গভবনের অফিসিয়াল নিয়ম অনুযায়ী আমাদের ছবি তোলা হলো। তারপর কক্ষে শুধু তিনি আর আমি। আমার জন্য সময় বরাদ্দ ছিল ২৫ মিনিট, প্রেস সচিব সেটা আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন।

টোস্ট বিস্কুট এবং লাল চা দিয়ে আপ্যায়ন হলো। তারপর এ কথা, সে কথা দিয়ে শুরু। সাংবাদিকতা, রাজনীতি, সমাজ, বিচারব্যবস্থা, আইন এবং আইনের ফাঁকফোকর- কত প্রসঙ্গ যে আলোচনায় এলো!

এমনকি শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, এরশাদ প্রসঙ্গও বাদ গেল না। তিনি কজন সম্পাদক সম্পর্কেও আমার মতামত জানতে চাইলেন। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। নির্ধারিত সময় অনেক আগেই শেষ। তার মধ্যাহ্নভোজের সময় হয়েছে। সামরিক সচিব একবার উঁকি দিলে তিনি ইশারায় চলে যেতে বললেন।

তাকে নিয়ে আমার লেখার প্রসঙ্গ একবারও তুললেন না। তবে শেষদিকে বললেন, আপনি ভালো লেখেন। সহজ সরল লেখা আপনার। আমি পড়ি। আমার ভালো লাগে। সচিবকে বলেছি, আপনার লেখার কাটিং নিয়মিত দিতে।

বিদায় দেওয়ার আগে বললেন, আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। আসবেন মাঝে মাঝে। আমার জীবন শৃঙ্খলিত। শুধু একটি অনুরোধ, আপনার সঙ্গে আমার যেসব কথা হবে তা কোথাও লিখবেন না। এগুলো একেবারেই ইনফরমাল কথা। একজন সিনিয়র সাংবাদিক এর মধ্যেই ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন।

বঙ্গভবনে সাহাবুদ্দীন সাহেব যতদিন ছিলেন, ততদিন সব সরকারি অনুষ্ঠানের দাওয়াত আমি পেয়েছি। এখন আর পাই না। তবে সাহাবুদ্দীন আহমদ আমার জীবন থেকে একটি বড় ভয় তাড়িয়ে দিয়েছেন। দেশের প্রধান ব্যক্তির সঙ্গে যে অমনভাবে মেশা যায়, সেটা সাহাবুদ্দীন সাহেবই বুঝিয়েছেন। গিয়েছিলাম তিরস্কৃত হতে, ফিরেছিলাম প্রশংসিত হয়ে।

 

বিভুরঞ্জন সরকার

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads