• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
বিশুদ্ধ নদী, খাল, বনভূমির আকাঙ্ক্ষা

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

বিশুদ্ধ নদী, খাল, বনভূমির আকাঙ্ক্ষা

  • গোলাম কাদের
  • প্রকাশিত ০৪ নভেম্বর ২০১৮

আদি সৃষ্টির মধ্যে একটি বৃক্ষ। আদম-হাওয়াকে সৃষ্টির পূর্বে আমাদের রব সৃষ্টি করছেন গন্ধম বৃক্ষ। সৃষ্টির আদিতে এই পৃথিবীকে সুন্দরতম করে সাজানো হয়েছে  বৃক্ষ দিয়ে। পৃথিবী সুন্দরতম করে সাজানোর শ্রেষ্ঠতম উপকরণগুলোর মধ্যে বৃক্ষ একটি। তাই আমাদের নবীজি (স.) বলেছেন, যদি দেখ কেয়ামত হচ্ছে, তখন হাতের কাছে যদি বৃক্ষ থাকে তা লাগাও। পৃথিবীর ধ্বংসোন্মুখ সময়েও বৃক্ষরোপণের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু গাছের প্রাণ খুঁজে পেয়েছেন আর লোকমান হেকিম গাছের সঙ্গে কথা বলতেন। মানব সভ্যতার উষালগ্ন থেকে বৃক্ষ মানুষকে এ পর্যন্ত এগিয়ে এনেছে। বনৌষধি বা বৃক্ষকেন্দ্রিক ওষুধ। বা ভেষজ ওষুধ এখন এই আধুনিকতার চূড়ান্ত লগ্নে মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এখনো যতই দিন যাচ্ছে ভেষজের গুণাবলি শুধু আবিষ্কৃতই হচ্ছে। আর এই বনজ সম্পদ দিন দিন পৃথিবীতে, বাংলাদেশে সঙ্কুচিতই হচ্ছে। কোনো দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় মোট ভূমির ২৫ শতাংশ থাকতে হয় বনভূমি। সেই তুলনায় বনভূমি উজাড় হতে হতে বাংলাদেশে এখন এসে ঠেকেছে ১৭ শতাংশে। পৃথিবীর দেশে দেশে এ হার ক্রমান্বয়ে কমছে। এবং পৃথিবীব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনও এর অন্যতম কারণ। বন উজাড় করে আমরা আমাদের বিপর্যয় ডেকে আনছি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং আমাদের প্রাণের নান্দনিক সৌন্দর্যের আধার সুন্দরবন দুটি বৃহৎ বনাঞ্চল। পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সুন্দরবন এলাকার বাইরে আছে মধুপুর গড় এলাকা, গারো পাহাড় এবং আরো ক্ষুদ্র বনাঞ্চল।

আমাদের এই সব বনাঞ্চল এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে ঠেকেছে। নিয়ত অবহেলার শিকার হচ্ছে। বন বিভাগের কর্মকর্তাগণ এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। অতীতে বন কর্মকর্তাদের বা বৃক্ষভুক কর্মকর্তার কেলেঙ্কারি জাতি ভুলে যাবে না। বন বিভাগ সেই সব কেলেঙ্কারি ঘোচাতে তৎপরও নয়। বৃক্ষকর্তন আর বদলি বাণিজ্য, বৃক্ষরোপণ এবং পরবর্তী পরিচর্যা না করা এখন এ বিভাগের গুণাবলি হয়ে উঠেছে। কিছু কিছু ভালো কর্মকর্তা আছেন বলেই এখনো আমরা বনের কাছে যেতে পারি। আরো পারি এ কারণে যে, বনদস্যুরা পুলিশের তৎপরতায় আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে বলে বন কিছুটা নিরাপদ হচ্ছে পর্যটক এবং বাওয়ালি বা মৌয়ালদের জন্য। বনের যে একটি অর্থকরী দিক আছে তাকে আরো গবেষণা করে জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ করতে হবে। কাঠ, মাছ, মধু, কাঁকড়া সম্পদে ভরপুর নানা জীববৈচিত্র্যে আমাদের বনাঞ্চল সমৃদ্ধ। একে বাড়াতে হবে। দুঃখের বিষয়- আমাদের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে বনাঞ্চল শুধু সঙ্কুচিতই হচ্ছে না, হারিয়েও যাচ্ছে তা থেকে অনেক কিছুই।

সুন্দরবনের কথাই ধরা যাক। বিশ্বের সুন্দরতম ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবন ছোট হয়ে আসছে। যদিও ১৯৯৭ সালে সুন্দরবন ইউনেস্কোর ‘বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বাংলাদেশ এবং ভারতের বিস্তৃত এলাকাজুড়ে সুন্দরবন বিস্তার লাভ করেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সুন্দরবন আয়তনে বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ ছিল। ক্রমাগত মানুষের চাপে এ বন সঙ্কুচিত হতে হতে এখন বাংলাদেশে মোট ভূমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ১৪৩ বর্গকিলোমিটার এবং নদী ও খালসহ বাকি জলধারারের আয়তন ১২ হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটার।

সুন্দরবনের বনজ বৈচিত্র্যের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে সুন্দরী, গেওয়া, গরান এবং কেওড়া। ১৯০৩ সালের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, সর্বমোট ২৪৫ শ্রেণির এবং ৩৩৪ প্রজাতির বৃক্ষ রয়েছে এই বনে। সুন্দরবনের ১১ শতাংশ এলাকা জুড়েই আছে সুন্দরী বৃক্ষ। আর বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এ জন্য এর নাম করা হয়েছে সুন্দরবন। এ বনে রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার প্রজাতির সম্পূরক উদ্ভিদ, ১৯৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ১২৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫৭৯ প্রজাতির পাখি, ১২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ৩০ প্রজাতির চিংড়ি মাছ। সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যা ১ লাখ। নোনা পানির কুমির একমাত্র সুন্দরবনেই দেখা যায়। এ বন থেকে বনজীবীরা বছরে প্রায় দেড় হাজার টন কাঁকড়া সংগ্রহ করে। এখানে চার প্রজাতির ছয় হাজার ডলফিন আছে। এখানে স্তন্যপায়ী ভোঁদড়ের সংখ্যা হিসাব করে বলা কষ্ট। রয়েছে বাংলাদেশ খ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এই টাইগার রয়েছে প্রায় ৫০০। এটি ২০০৪ সালের হিসাব। ২০১১ সালে এ হিসাব এসে ঠেকেছে ৩০০টিতে। এখানে মাছ আছে প্রায় ৩০০ প্রজাতির।

প্রাণী বৈচিত্র্যে ভরপুর সুন্দরবনকে রক্ষা করা বা আমাদের বনাঞ্চলকে রক্ষা করা এবং নতুন নতুন বনাঞ্চল সৃজন করা না গেলে আমরাই নই শুধু, পৃথিবী বিপর্যের মুখে পড়বে। পাশের দেশ ভুটান। লোকসংখ্যা তিন লাখ। ভুটানের রাজা জিগমে থেসর পিয়াল ও রানী জেটসুন প্রেমার ঘরে প্রথম সন্তান জন্ম নেওয়া উপলক্ষে দেশের জনগণ ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সেই দেশে। তারা ফলদ বৃক্ষের চারা রোপণ করেছে ১ লাখ ৮ হাজার এবং তা এক দিনে। এর আগের বছর ১ ঘণ্টায় তারা ৫৯ হাজার ৬৭২টি বৃক্ষ রোপণ করে বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টি করেছে। ভুটান ছোট দেশ হলেও ফলদ ও বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ। ভারতের বিহার অঞ্চলে প্রচলিত আছে কন্যাসন্তান জন্ম নিলে ১৯টি ফলদ বৃক্ষ রোপণ করা, বিশেষ করে আমগাছ। এর অর্থ হলো মেয়ে যখন বিবাহযোগ্য হবে, তখন কন্যা পাত্রস্থ করতে পিতার বেগ পেতে হবে না। ১৯টি আম গাছের ফল বিক্রি করে প্রতিবছর যে টাকা সঞ্চয় হবে তা দিয়ে কন্যা পাত্রস্থসহ সংসার নির্বাহও হয়।

আমাদের দেশে সম্প্রতি একটি শুভ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ৩০ লাখ শহীদকে স্মরণ করে ৩০ লাখ বৃক্ষ রোপণ করা। সরকারিভাবে এ ধরনের উদ্যোগ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। এটি গেল উদ্যোগের কথা। এ রকম উদ্যোগের পাশাপাশি বৃক্ষরোপণে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং বনভূমির অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে বাঁধ ও রাস্তার পাশে, সরকারি খাসজমি জেগে ওঠা চরাঞ্চলে বনভূমি সৃজন এবং পরিচর্যার মাধ্যমে বনভূমি সৃষ্টি করা। অসাধু বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদচ্যুত করা। একজন কৃষক একজন বৃক্ষপ্রেমিক বৃক্ষের প্রতি যতটা দরদি, অনেক সময় একজন বন কর্মকর্তার ভেতর সেই রকম বৃক্ষপ্রেম দেখা যায় না। বৃক্ষ কর্তন করে অবৈধ রোজগারের জন্য তদবির করে পোস্টিং নেওয়া বন বিভাগের একটি ওপেন সিক্রেট। শেষ কথা বলতে চাই, আমরা শিল্প-বাণিজ্যে, রেমিট্যান্সে এবং নতুন নতুন শিল্পপণ্যে আর ত্যাগী কৃষককুলের জন্য আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। সেই রকম আমাদের বনভূমি, সম্পদের সমাহারে ভরপুর জীববৈচিত্র্যের আধার সুন্দরবনের প্রতি কোনোক্রমেই যেন অবহেলা না করি। আমাদের এগিয়ে চলার পাশে আমরা যেন বিশুদ্ধ নদী, খাল আর বনভূমি নিয়ে এগিয়ে যেতে পারি। আমাদের এই চলমান জাতিসত্তার ভেতর এখন বিশুদ্ধ নদী, খাল, বনভূমির আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলতে হবে। বিশুদ্ধ নদী ও খাল যদি না থাকে, তবে বনভূমি থাকবে না; নানা দূষণে মানুষ অকাল মরণের কবলে পড়বে। আমাদের নদী ও খাল নাব্যতায় ঢাকা পড়ে গেছে। এগুলোকে প্রতিনিয়ত খনন করে প্রবহমান রেখে বিশুদ্ধ জলের আধার করে তুলতে হবে। নদী, খাল, বনাঞ্চল ঘিরেই সভ্যতা গড়ে উঠেছে। মানুষ সভ্য হয়েছে। আমরা এদের হনন করে যাতে অসভ্য হয়ে না যাই। আমাদের নদীগুলো এখন নানা বর্জে দূষিত। মানুষের সুস্থতার মতো এগুলোকে ড্রেজিং করে বিশুদ্ধ করে তুলতে হবে। মানুষের সঙ্গে সঙ্গে নদী, খাল, বনভূমির দিকে অধিকতর নজর দিতে হবে। আর এগুলো নির্মল হলে আমরাও নির্মল মানুষ হয়ে উঠব।

লেখক : কবি, সাংবাদিক, বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads