• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
সম্ভাবনাময় বাই-প্রোডাক্ট

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

সম্ভাবনাময় বাই-প্রোডাক্ট

  • প্রকাশিত ০৪ নভেম্বর ২০১৮

পোশাক তৈরির পর অব্যবহূত বর্জ্য থেকে দৈনন্দিন ব্যবহার উপযোগী পণ্য উৎপাদন করে বিদেশে রফতানির মাধ্যমে ইতোমধ্যে অনেকেই সাফল্য পেয়েছেন। কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ বা সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা ছাড়াই কিছু উদ্যমী মানুষ এক্ষেত্রে কাজ করছেন। সরকারিভাবে ঋণ সুবিধা এবং সামাজিক নিরাপত্তা পেলে এই শিল্প থেকে কয়েকগুণ বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।

শিল্প পোশাক কারখানাসমৃদ্ধ গাজীপুরে অসংখ্য ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা নিজেদের আবাসস্থলের পাশে ছোট্ট একটি কামরার মধ্যে এসব পণ্য উৎপাদন করেন। অনেকে ছোটখাটো কারখানাও বানিয়ে নিয়েছেন। যদিও উন্নত দেশের মতো বাই-প্রোডাক্ট শিল্প ততটা উন্নত নয়। যেমন চীনে মোবাইল ফোনের বহিরাবরণ (কভার) ও গাড়ির কিছু যন্ত্রাংশ তৈরি হয় পোশাক শিল্পের হার্ড ওয়েস্ট (ডেনিম জাতীয় কাপড়ের ঝুট) থেকে।  প্রক্রিয়াকরণের জন্য এমন আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের দেশে এখনো আসেনি। তবে অব্যবহূত বর্জ্য থেকে সরাসরি তৈরি করা যায় এমনসব পণ্য ঠিকই হচ্ছে। টুকরো কাপড় থেকে টুপি, ক্যাপ, হাতব্যাগ, শিশুদের খেলনা, রান্নাঘরে ব্যবহূত পাউটা (গরম হাঁড়িপাতিল ধরার মোটা কাপড় বিশেষ), শিশুদের জামাকাপড়সহ প্রায় শতরকমের জিনিস তৈরি হয়। এসবের কিছু কিছু আবার উদ্যোক্তারা নিজেদের চেষ্টায়ই বিদেশে রফতানি করছেন। আবার অতি ক্ষুদ্র টুকরো কাপড় মেশিনে ভেঙে তুলা বানানো হচ্ছে। কাপড়ের তুলা বিদেশে রফতানি হয়। চীন ও ভারত বাংলাদেশ থেকে কাপড়ের তুলা আমদানি করে তা থেকে পুনরায় সুতা উৎপাদন করে। পাশাপাশি দেশীয় বাজারেও কাপড়ের তুলার চাহিদা আছে।

আমাদের দেশ থেকে যে পোশাক রফতানি হচ্ছে, তার শতভাগ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদেশি ক্রেতারা তাদের চাহিদামতো কাঁচামাল সরবরাহ করেন। সেক্ষেত্রে আমাদের দেশের কারখানা মালিকরা শুধু তৈরির মজুরি পাচ্ছেন। পোশাক তৈরির পর অতিরিক্ত কাপড়, টুকরো কাপড়, সুতা, বোতাম, হুক, পলিথিন, ট্যাগ, কার্টন, টুকরো কাগজ বর্জ্য আকারে পাওয়া যায়। রফতানির পর অবশিষ্ট বর্জ্য আকারে পাওয়া বস্তু থেকে ব্যবহার উপযোগী উৎপাদিত পণ্যই বাই-প্রোডাক্ট। বাই-প্রোডাক্ট শতভাগ লাভজনক। বর্জ্য পোশাক কারখানার মালিক বড় ঝুট ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেন। ঝুট ব্যবসায়ীর হাত থেকে তা বাছাইকারী কিনে নেন। বাছাইকারী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। এরা ওই ধরনের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, যারা বর্জ্য থেকে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করেন। 

দেশের অন্যতম তৈরি পোশাক কারখানাসমৃদ্ধ এলাকা গাজীপুর ও টঙ্গীতে এমন অসংখ্য বাই-প্রোডাক্ট কারখানা গড়ে উঠেছে। সরেজমিনে তার কয়েকটি ঘুরে সত্যিই মুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না। প্রকৃতপক্ষে এসব উদ্যমী মানুষের কারণেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কৃষক যেমন মাটির শক্তি শুষে মানবের শক্তির জোগান দেয়, এসব উদ্যোক্তা তেমনি ফেলনা বস্তুকে নিজেদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় মানুষের ব্যবহার উপযোগী পণ্যে পরিণত করেন। তেমনি একজন সফল উদ্যোক্তা রফিক শেখ ও তার সাফল্যের কাহিনী বলছি। মো. রফিক শেখ গাজীপুরের টঙ্গীর এরশাদ নগর এলাকায় ভাড়া বাড়িতে ঝুট থেকে সাহেবি টুপি তৈরির পর ফেরি করে বাজারে বাজারে বিক্রি করতেন। সামান্য পাঁচ হাজার টাকার পরিত্যক্ত কাপড় ও একটি সেলাই মেশিন তার প্রাথমিক পুঁজি। ১৯৯৮ সালে স্ত্রীর ভাই (শ্যালক) পিন্টুর পরামর্শে তিনি শাওন রিপা ক্যাপ হাউজ নামে প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যবসা শুরু করেন। মাত্র ১৩ বছরে তার নিজের বাড়ি হয়েছে। প্রথমে দেশের বাজারে বিক্রি করলেও বর্তমানে শতভাগ টুপি বিদেশে রফতানি হয়। এখন নিজ বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন কারখানা। তিনিসহ পরিবারের সদস্য স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ে ও ১২ কর্মচারী সর্বক্ষণ তার কারখানায় কাজ করছেন। বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের টুপি তার কারখানায় তৈরি করেন। ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী নাইকি, রিবক, ফিলা, পলো, লোকল ফুপু, প্লেন ক্যাপ, সান ক্যাপ ইত্যাদি। মূলত ভারতের বিভিন্ন ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী তিনি এসব ব্র্যান্ডের টুপি তৈরি করে দেন। টঙ্গী ও গাজীপুরের বিভিন্ন পোশাক কারখানা থেকে পরিত্যক্ত কাপড় (ঝুট) টুপি তৈরির কাজে ব্যবহার করেন। বিশেষ করে ওভেন (ডেনিম কাপড় দিয়ে তৈরি পোশাক) জাতীয় কারখানার ঝুট টুপি তৈরিতে ব্যবহার হয়। তা ছাড়া বাজার থেকে ১৬/১২ গেভারডিন কাপড় টুপির ভেতরের দিকে কটন (বখরম) কাপড়, বাটন, ভাইজার, বেলকো, কাটা, সুতা প্রভৃতি কাঁচামাল চকবাজার থেকে সংগ্রহ করেন। রফিক শেখের সাফল্যে উৎসাহী হয়ে ইতোমধ্যে এই এলাকায় গড়ে উঠেছে এমন আরো ২০-২৫টি কারখানা। আবদুল লতিফ, মো. শুক্কুর, মো. নজরুল, মো. নাসির, মো. হালিম, মো. আফজাল, মো. ফেরদৌসসহ অনেক যুবকই এরশাদ নগর বস্তির বিভিন্ন বাড়িতে টুপি তৈরির কারখানা গড়ে তুলেছেন। তারা সবাই এখন টুপি তৈরিতে ব্যস্ত। কয়েকজন বিদেশে রফতানি করেন। বাকিরা দেশের বাজারে টুপি সরবরাহ করে থাকেন।

কথা হয় ঝুট রফতানিকারকদের সঙ্গে। তারা জানান, টঙ্গীতে তিন শতাধিক কারখানা মিলে প্রতি মাসে প্রায় ৭ হাজার টন বিভিন্ন ধরনের ঝুট উৎপাদন হচ্ছে। কারখানা কর্তৃপক্ষ সরাসরি ঝুট সরবরাহকারীর কাছে বিক্রি করেন। সব সরকারের আমলেই রাজনৈতিক নেতারা কারখানার ঝুট সরাসরি নামমাত্র দামে কেনেন। তবে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা অর্থলগ্নি করেন। শুধু কারখানার ঝুট বাজারে এনেই প্রথম ক্রেতা হিসেবে নেতারা ও লগ্নিকারী বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকা আয় করেন। কারখানা থেকে কয়েক হাত ঘুরে রফতানিকারকের কাছে আসে। একজন রফতানিকারক প্রতি কেজি ঝুট চীন বা ভারতে গড়ে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি করেন। এতে করে এই খাত থেকে মাসে টঙ্গীতে কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। এই খাতে টঙ্গীতে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকাণ্ডে ৩ লাখ লোক জড়িত। সম্ভাবনাময় এই শিল্পে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে গবেষণার মাধ্যমে ঝুট থেকে অন্যান্য সামগ্রী তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। মূলত সিংহভাগ ঝুট চীন ও ভারতে রফতানি হয়। ঝুট রফতানি না করে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দেশের ভেতরেই বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে ঝুট থেকে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করে বাজারজাত করা সম্ভব। তা ছাড়া বর্তমানে চীন ও ভারত ঝুট আমদানি কমিয়ে দেওয়ায় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকার ঝুট গুদামে নষ্ট হচ্ছে। ক্রেতাদের এটা একধরনের কারসাজি। আমদানি কমিয়ে ঝুটের বাজারদর কমিয়ে নেয়। কারণ কয়েক মাস রফতানি না হলেই ঝুট গুদামের ধারণক্ষমতা থাকে না। তখন খোলা আকাশের নিচে নষ্ট হয়। বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ীরা কম দাম রফতানি করেন। সেক্ষেত্রে  দেশের ভেতরে বাই-প্রোডাক্ট উৎপাদনের পর্যাপ্ত সুযোগ থাকলে এ অবস্থা হতো না। বরং উৎপাদিত পণ্য রফতানি করে কয়েকগুণ বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব হবে। এটা তো শুধু দেশের একটি অঞ্চলের চিত্র তুলে ধরেছি। সারা দেশের শিল্প-কারখানা থেকে যে পরিমাণ ঝুট বা কারখানা বর্জ্য উৎপন্ন হয়, তা থেকে অনায়াসে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব। 

বিজিএমইএ সূত্র জানায়, ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে বা ঝুট নিয়ে সরকারের আলাদাভাবে কোনো নীতিমালা নেই। ঝুট ব্যবসায়ীদের নেই কোনো সমন্বয় বা সংগঠন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ঝুট থেকে বাই-প্রোডাক্ট উৎপাদনের মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার আয় করা সম্ভব। তৈরি পোশাকের ঝুট এবং বাই-প্রোডাক্ট সম্ভাবনাময় খাত। একটি পণ্যের জীবনচক্র লক্ষ করলে কী পাই? প্রাকৃতিকভাবে তুলা উৎপাদন হয়। তুলা থেকে সুতা। সুতা দিয়ে কাপড়। কাপড় থেকে মানুষের ব্যবহার্য জিনিস। আমাদের মতো অনুন্নত দেশে এ পর্যন্তই প্রাকৃতিক তুলার ব্যবহার সীমাবদ্ধ। কিন্তু উন্নত বিশ্বে মানুষের ব্যবহার্য কাপড় প্রক্রিয়া করে পুনরায় তুলা উৎপাদন করা হয়। এভাবেই চলতে থাকে পণ্যের জীবনচক্র। কখনো কখনো এক পণ্যের জীবনচক্রে উৎপাদন হয় অন্য নতুন কোনো পণ্য। যেমন মোবাইল কভার, গাড়ির যন্ত্রাংশ বা খেলনা।

আমাদের দেশে সেই সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে আমাদের তুলার উৎপাদন নেই বললেই চলে। পাট উৎপাদনেও পিছিয়ে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক শিল্পে বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদনকারী। এখান থেকে পর্যাপ্ত ঝুট তথা বর্জ্য পাওয়া যাচ্ছে। এখন প্রয়োজন ঝুট বা বর্জ্য থেকে বাই-প্রোডাক্ট উৎপাদন করা।

 

শতাব্দী আলম

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads