• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
সহজে ব্যবসা করার সুযোগ বাড়াতে হবে

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

সহজে ব্যবসা করার সুযোগ বাড়াতে হবে

  • প্রকাশিত ০৯ নভেম্বর ২০১৮

সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে ডুয়িং বিজনেস প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। এর মাধ্যমে কোন দেশে ব্যবসা করা কতটুকু সহজ, তা প্রকাশ পায়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণে এই ডুয়িং বিজনেস সূচকে কোন দেশের কত অবস্থান তা বিবেচনায় রাখে। বিশ্বব্যাংকের ইজি অব ডুয়িং বিজনেস বা সহজে ব্যবসা করার সূচকে মাত্র এক ধাপ উন্নতি হয়েছে বাংলাদেশের। এবারের র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৬তম। যদিও এ সূচকে বাংলাদেশের প্রতিবেশী ও প্রতিযোগী দেশগুলোর লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সালে ডুয়িং বিজনেস সূচককে উন্নয়নের ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে। তখন এ সূচকে আগামী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে দুই অঙ্ক অর্থাৎ কমপক্ষে ৯৯তম অবস্থানে নিয়ে আসার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরপর দু’বার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। গত ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের এক ধাপ অবনতি হয়েছিল, এ বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে এক ধাপ উন্নতি হলেও কার্যত অবস্থান একই রয়েছে। মোট ১০টি ভিত্তির ওপরে বিশ্বব্যাংক ড্রয়িং বিজনেস সূচকের র্যাঙ্কিং করে। এগুলো হলো ব্যবসা শুরুর অনুমোদন, ভবন নির্মাণের অনুমতি, বিদ্যুৎ সংযোগ, সম্পত্তি, নিবন্ধন, ঋণপ্রাপ্তি, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা, কর প্রদান, বৈদেশিক বাণিজ্য চুক্তির বাস্তবায়ন ও দেউলিয়া ঘোষণার প্রক্রিয়া। এর মধ্যে ব্যবসা শুরুর প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ৭ ধাপ পিছিয়ে ১৩৮, অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতিতে ৮ ধাপ পিছিয়ে ১৩৮, ঋণের প্রাপ্যতায় ২ ধাপ পিছিয়ে ১৬১, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় ১৩ ধাপ পিছিয়ে ৮৯, বৈদেশিক বাণিজ্যে ৩ ধাপ পিছিয়ে ১৭৬, ব্যবসা গোটানোর প্রক্রিয়ায় ১ ধাপ পিছিয়ে ১৫৩ অবস্থান পেয়েছে। বাংলাদেশ ৬ ধাপ এগিয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে অবস্থান হয়েছে ১৭৯তম। এ ছাড়া বাংলাদেশ ভূমি নিবন্ধনে ২ ধাপ এগিয়ে ১৮৩তম ও কর পরিশোধে ১ ধাপ এগিয়ে ১৫১তম হয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নের দিক দিয়ে কোনো উন্নতি হয়নি, অবস্থান আগের মতো ১৮৯তম। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, এ দেশে ব্যবসা শুরু করতে সাড়ে ১৯ দিন, নির্মাণের অনুমতি পেতে ২৮১ দিন, বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে ১৪৮ দিন, ভূমি নিবন্ধনে ২৬৪ দিন, চুক্তির বাস্তবায়নে ১ হাজার ৪৪২ দিন ও কোম্পানি গোটাতে চার বছর সময় লাগে।

বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর সহজে ব্যবসা করার সূচকে (ড্রয়িং বিজনেস) আফগানিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের খারাপ অবস্থাকে লজ্জাজনক বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আর এ জন্য অর্থমন্ত্রী দায়ী মনে করেন দেশের আমলাতন্ত্র। বিশ্বব্যাংক যে ডুয়িং বিজনেস প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান আগের বারের চেয়ে এগিয়ে ১৭৬তম হয়েছে। প্রতিবেশী ও প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে ভারত ২৩ ধাপ এগিয়ে ৭৭তম, পাকিস্তান ১১ ধাপ এগিয়ে ১৩৬তম। এবং বাংলাদেশের পেছনে থাকা আফগানিস্তান এক লাফে ১৬ ধাপ এগিয়ে ১৬৭তম হয়েছে। বাংলাদেশের এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার জন্য আমলাতন্ত্রকে দায়ী করে অর্থমন্ত্রী অকপটে বলেছেন, আসলে বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র খুবই শক্তিশালী। আর আমলাদের মানসিকতার তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না। আগে যেমন ছিল এখনো তেমন রয়েছে। সহজে ব্যবসা করার সূচকে বাংলাদেশের যে সামান্য অগ্রগতি হয়েছে তা আসলে কোনো অগ্রগতি নয়। এটা নিঃসন্দেহে হতাশাব্যঞ্জক। একই সময়ে আফগানিস্তানের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ এ ক্ষেত্রে ১৬ ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশের সামনে চলে গেছে। তেমন প্রেক্ষাপটে সবার মনে প্রশ্ন জেগেছে, আমরা কি আসলে সহজে ব্যবসা করার সূচকে এগোতে চাই? বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সালে ডুয়িং বিজনেস সূচকে উন্নতির জন্য যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এ পর্যন্ত কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার করা হয়েছে, তবে এ ক্ষেত্রে আরো কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে তার বিস্তারিত পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাজের অগ্রগতি কম। কেউ কেউ ক্ষমতা হাতছাড়া করতে চায় না।

সহজে ব্যবসা করার সুযোগ বা ইজি অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা আক্ষরিক অর্থেই এক জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের ২০১৯ প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৬তম। এটি এক ধাপ অগ্রগতি এ কারণে যে, গত বছর এই সূচক ছিল ১৭৭, যা তার আগের বছরের চেয়ে দুই ধাপ নিচে। ১০০ নম্বরকে সর্বোত্তম ধরে এবার বাংলাদেশের নম্বর দাঁড়িয়েছে ৪১ দশমিক ৯৭। আগের বছরে ছিল ৪১ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করার তালিকায় এক নম্বরে রয়েছে নিউজিল্যান্ড। দেশটি ১০০ নম্বরের মধ্যে পেয়েছে ৮৬ দশমিক ৫৯। নিউজিল্যান্ডের পরে প্রথম পাঁচটি দেশের মধ্যে রয়েছে সিঙ্গাপুর, ডেনমার্ক, হংকং ও দক্ষিণ কোরিয়া। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কার অবস্থান ১০০তম, ভুটান ৮১তম, নেপাল ১১০তম, মালদ্বীপ ১৩৯তম এবং পাকিস্তানের অবস্থান ১৩৬তম। হতাশার বিষয় হলো, আগের বছরের তুলনায় চলতি বছর বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়ে থাকলেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে। ব্যবসা সহজীকরণের এ সূচকে এক বছর এক ধাপ এগোলেও পরের এক বছর পিছিয়ে যাওয়া যেন অনেকটাই রীতিতে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের।

অন্যদিকে ব্যবসা সহজীকরণের বাধাগুলো দূরীকরণে জাতীয়ভাবে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা সূচক উন্নতির জন্য বেশকিছু সুপারিশও করেছে। সে অনুযায়ী কিছু পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে। এখন প্রয়োজন মাঠ পর্যায়ে এ পরিকল্পনাগুলো কার্যকর বাস্তবায়ন। বাস্তবায়ন কার্যকর করা না হলে র্যাঙ্কিংয়ে উন্নতি হবে না। যে দেশগুলো এ ক্ষেত্রে এগিয়েছে, দিকনির্দেশনাগুলো তারা মাঠ পর্যায়ে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করেছে। বাস্তবায়নের গুণগতমান দক্ষতা ও গতি বাড়াতে পারলেই বাংলাদেশের উন্নতি কোনো কঠিন বিষয় নয়। সুপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রক্রিয়ার আওতায় বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তথা অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটিয়ে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর দক্ষতা কাজে লাগানো গেলে আমাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির স্বপ্ন বাস্তবে রূপলাভ করবে, এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

বিশ্বব্যাংকের একাধিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ব্যবসা করার খরচ বেশি। চলতি বছরের বাজেট বিশ্লেষণ করেও বিশ্বব্যাংক বলেছে, ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করা এবং খরচ কমানোর বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপের কথা বাজেটে বলা হয়নি। অনেক ব্যবসায়ী অনুযোগ করে বলছেন, প্রতিযোগী দেশগুলোয় যে হারে সংস্কার গতি পেয়েছে, বাংলাদেশে তা হয়নি। এ কারণে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশকে এখন খাত ও কাজ নির্দিষ্ট করে সংস্কার আনতে হবে, যেমনটি করেছে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো। ব্যবসার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিনিয়োগ সুরক্ষা, রাজনৈতিক পরিবেশের স্থিতিশীলতা ও ব্যবসাবান্ধব কর কাঠামো। এ ছাড়া ঋণের সহজ প্রাপ্তি, সম্পত্তির মালিকানা লাভের প্রক্রিয়া, আধুনিক প্রযুক্তি, নতুন উদ্ভাবন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার অনুপস্থিতি, দুর্নীতি ও ব্যক্তি স্বাধীনতা ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। আমাদের ব্যবসা করার পরিবেশ সৃষ্টিতে কোনো অগ্রগতি নেই, তাও বলা যাবে না। তবে সেই অগ্রগতি এত নগণ্য যে, সামাজিক পরিবেশ উন্নয়নে তা প্রভাব ফেলতে পারছে না। আমরা ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার স্বপ্ন দেখছি। ২০২১ সালের মধ্যেই ডুয়িং বিজনেস সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দুই ডিজিটে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের সেই লক্ষ্য পূরণ সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টি করেছে সবার মনে। কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ ছাড়া লক্ষ্য পূরণ সম্ভবও নয়। সে ক্ষেত্রে সংস্কারকে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নয়নে আরো অনেক আন্তরিক মনোভাবাপন্ন হতে হবে। বিনিয়োগের বাধাগুলো চিহ্নিত করে তা দ্রুত দূর করতে হবে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও ঘুষ-দুর্নীতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণকারী সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে সুশাসন নিশ্চিত করে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতি, ঘুষ লেনদেন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

বর্তমানে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে প্রায় সব দেশ একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। শুধু বিদেশি বিনিয়োগ নয়, দেশি বিনিয়োগের জন্যও ব্যবসার সহজ পরিবেশ থাকা প্রয়োজন। যাতে দেশি অর্থ দেশেই বিনিয়োগ হয়। সংস্কার কার্যক্রমের মধ্যে বেশকিছু আইনগত পরিবর্তন দরকার। সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে চুক্তি কার্যকরে। এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি উন্নতি করতে হবে। যেকোনো বাণিজ্য বিরোধ নিরসনে আইনের সংস্কার প্রয়োজন। কিছু প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে পরিবর্তন দরকার, বিশেষ করে জমি নিবন্ধন, নির্মাণ অনুমতি, কর প্রদান ও ইউটিলিটি সেবার ক্ষেত্রে। শুধু কেন্দ্রীয় সরকার পর্যায়ে নয়, অনেক বিষয় স্থানীয় সরকার পর্যায়েও আছে। বাস্তবায়ন যখন আরো ত্বরান্বিত হবে, তখন সহজে ব্যবসার সূচকে উন্নতি দেখা যাবে। সব সূচকের ক্ষেত্রেই তিনটি বিষয় দেখা হয়। সহজে ব্যবসার ক্ষেত্রে কাজের প্রক্রিয়া কমিয়ে অহেতুক জটিলতার নিরসন করে ত্বরান্বিত প্রক্রিয়া চালু করা, কালক্ষেপণ না করা ও ব্যয় কমিয়ে আনা। অন্যান্য দেশে তুলনামূলকভাবে প্রক্রিয়া অনেক কম। লক্ষ্য অর্জনে আমাদের সবাইকে সন্মিলিতভাবে একযোগে কাজ করে যেতে হবে। সমন্বয়হীনতা দূর করাসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়সমূহকে এ ব্যাপারে আরো সজাগ হতে হবে। মোটকথা, বিদ্যমান সামগ্রিক অবস্থার উন্নতি প্রয়োজন। আগামী দিনে বাংলাদেশকে প্রকৃত গুণগতমানে উন্নতি করতে হবে। এটি এখন জাতীয় পর্যায়ের প্রয়াস হিসেবে দেখা হচ্ছে। যাতে সহজে ব্যবসা করার জন্য গুণগতমানের পরিবর্তন হয়।

রেজাউল করিম খোকন

লেখক : ব্যাংকার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads