• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
১২ নভেম্বর : উপকূল দিবস হোক

সংগৃহীত ছবি

সম্পাদকীয়

১২ নভেম্বর : উপকূল দিবস হোক

  • প্রকাশিত ১২ নভেম্বর ২০১৮

আজকের বর্তমান, আগামীতে ইতিহাস; ইতিহাস যুগ যুগ ধরে তথা অনন্তকাল ধরে মানুষ লালন করে থাকে। আবার কখনো কখনো ইতিহাস দিবস হিসেবে পালন করে স্মরণে রাখে। কিছু কিছু দিবস সরকারিভাবে এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে পালিত হয়ে থাকে। আমরা জানি, মানুষ ইতিহাস থেকেই শিক্ষা নেয়, অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করে। আর দিবস থেকে মানুষ অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করে এবং প্রতিবছর দিবসের মাধ্যমে পূর্বের ইতিহাসকে স্মরণ করে। আমরা এও জানি, অনেক সময় মানুষ না চাইতে পেয়ে যায়, আবার চাইলেও পাওয়া যায় না। তেমনি একটি চাওয়া হলো ‘উপকূল দিবস’। একটি দিবসের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে আজো স্বীকৃতি পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ একটি নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ। দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে জনশক্তি। স্বাধীনতা-উত্তর এ দেশের উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রায় ২০ কোটি মানুষের এ দেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ও বিভিন্ন পেশার মানুষ রয়েছে। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ এখন এক সমৃদ্ধিশালী দেশ। এখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে শামিল হওয়ার চেষ্টা রয়েছে। আর সেই উন্নত রাষ্ট্রের সঙ্গে শামিল হতে যে কয়টি পারস্পরিক সম্পর্ক বা সহযোগিতা থাকে বা থাকতে হয়, তার মধ্যে রয়েছে অর্থনীতি, জনশক্তি, উন্নয়ন, বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখা ও কূটনৈতিক সম্পর্ক। প্রায় ২০ কোটি মানুষের মধ্যে উপকূলে বাস অর্ধেকেরও বেশির। দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখা সিংহভাগ জনশক্তি হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ।

স্বাধীনতার ৪৭ বছরে বাংলাদেশ। মাঝে এসেছে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ ও নেতৃত্বের সঙ্কট। জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। তারপরও পিছিয়ে নেই দেশ। এ সময়ে দারিদ্র্যের হার ৮২ থেকে নেমে এসেছে ২৪ শতাংশে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১২ গুণের বেশি, ৫০০ গুণের বেশি বেড়েছে বাজেট। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশের বেশি হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশকে মডেল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। বর্তমানে খাদ্য চাহিদার উল্লেখযোগ্য অংশই উৎপাদন হচ্ছে দেশে। যার সিংহ ভাগই উপকূলে। বিশেষ করে সমুদ্রের মৎস্য সেক্টর হচ্ছে উপকূলকেন্দ্রিক। বিদেশ নির্ভরতা অনেক কমেছে, কমেছে বাজেট বাস্তবায়নেও। বাজার মূল্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ৪৭ বছরে ৪ হাজার ৯৪৫ কোটি থেকে দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৭৫ হাজার ৮১৫ কোটি টাকায়। দেশে এখন নিবন্ধিত কোম্পানি প্রায় চার লাখ। এখানে আত্মকর্মসংস্থানে যুক্ত আড়াই কোটি মানুষ। প্রায় এক কোটি প্রবাসীও বড় অবদান রাখছে দেশের অর্থনীতিতে। এ ছাড়া উপকূলের মৎস্যজীবী এবং চাষিদের অবদানও উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের সক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় যেমন কমেছে দরিদ্রতা, তেমনি নিজস্ব অর্থায়নে বিশ্বের অন্যতম বড় পদ্মা সেতু নির্মিত হচ্ছে। সাবমেরিনের পর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটও সম্পন্ন হয়েছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটার হাউজকুপারস তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ পরিণত হবে বিশ্বের ২৩তম অর্থনীতির দেশে। আর ২০৩০ সালে হবে ২৮তম। বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশের সারিতে দাঁড়ানোর সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। ২০৩০ সাল নাগাদ ‘নেক্সট ইলেভেন’ সম্মিলিতাবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২৭টি দেশকে ছাড়িয়ে যাবে, যার অন্যতম বাংলাদেশ। লন্ডনের পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, ২০৫০ সালে প্রবৃদ্ধির বিচারে বাংলাদেশ পশ্চিমা দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে। আর বাংলাদেশের কলকারখানার পাশাপাশি উপকূলের মৎস্য সেক্টরসহ উপজেলার জনশক্তি দেশের অর্থনীতিতে অনেক ভূমিকা রাখছে। কিন্তু দেশের অন্যান্য স্থানে কলকারখানা যেভাবে গণমাধ্যমে গুরুত্ব পাচ্ছে, উপকূলের শ্রমশক্তি, মৎস্য সেক্টর সেভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে না।

উপকূলের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত বহুমুখী দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস করেন। কিন্তু স্বাভাবিক সময়েও তাদের জীবন যে কতটা অস্বাভাবিক, সে বিষয়ে খুব একটা খোঁজ রাখা হয় না। উপকূলের প্রান্তিকের তথ্য যেমন কেন্দ্রে পৌঁছায় না, ঠিক তেমনি কেন্দ্রের তথ্য মাঠে পৌঁছাচ্ছে না বহুমুখী কারণে। উপকূলের ভয়াবহতা উপকূলবাসীই কেবল বুঝবে। ১২ নভেম্বরের ঘটনা উপকূলবাসী আজো ভুলে যায়নি। এটাই উপকূলবাসীর কাছে সবচেয়ে বেশি স্মরণীয় দিন। কারণ, ’৭০ সালের এই দিনে উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল গোটা উপকূল। প্রাকৃতিক দুর্যোগও এ অঞ্চলের ওপর দিয়ে বেশি বয়ে যায়। প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলাসহ নানা দুর্যোগের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েছে বেড়িবাঁধ। তার পরে নার্গিস, রেশমা, গিরি, রোয়ানু তো রয়েছেই। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর দক্ষিণাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়ায় এ যাবৎকালে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় সিডরে এই জনপদের বিশাল বেড়িবাঁধের প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে ব্যাপক ক্ষতি হয় ৩৬৬ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের। অল্প ক্ষতি হয় ২ হাজার ১৪ কিলোমিটার। ২০০৯ সালে উপকূলে আবারো আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আইলা। বড় ধরনের দুটি ঘূর্ণিঝড়ের এসব এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ দ্রুত মেরামত না হওয়ায় বিস্তীর্ণ এলাকা এখন প্লাবিত হয়ে আরো ভেতরে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করছে।

১৯৭০ সালের ভোলা ঘূর্ণিঝড় (ইংরেজি : Bhola cyclone) ছিল একটি শক্তিশালী ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়, যা ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশের) দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে। এ পর্যন্ত উইকিপিডিয়ার রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড়সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় এবং এটি সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ঙ্করতম প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। যার অধিকাংশই গাঙ্গেয় বদ্বীপের সমুদ্রসমতলের ভূমিতে জলোচ্ছ্বাসে ডুবে মারা যান। এটি ১৯৭০-এর উত্তর ভারতীয় ঘূর্ণিঝড় মৌসুমের ষষ্ঠ ঘূর্ণিঝড় এবং মৌসুমের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ছিল। এটি সিম্পসন স্কেলে ‘ক্যাটাগরি ৩’ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল। ঘূর্ণিঝড়টি বঙ্গোপসাগরে ৮ নভেম্বর সৃষ্ট হয়ে ক্রমশ শক্তিশালী হতে হতে এটি উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১১ নভেম্বর এর গতিবেগ সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটারে (১১৫ মাইল) পৌঁছায় এবং সে রাতেই তা উপকূলে আঘাত করে। জলচ্ছ্বাসের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপসমূহ প্লাবিত হয়। এতে ওইসব এলাকার বাড়িঘর, গ্রাম ও শস্য স্রোতে তলিয়ে যায়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ছিল তজুমদ্দিন উপজেলা, সেখানে ১৬৭০০০ অধিবাসীর মধ্যে ৭৭০০০ জনই (৪৬ ভাগ) প্রাণ হারায়।

বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় ১৯৮৮ সালে সংঘটিত হয়। এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে দেশে যে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সর্বনাশা বন্যা হিসেবে পরিচিত। ২১ নভেম্বর মালাক্কা প্রণালিতে এই ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি হয়েছিল। শুরুতে এটি পশ্চিমগামী ছিল, এরপর গভীর নিম্নচাপ থেকে ক্রমান্বয়ে আন্দামান সাগরে এসে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়। নভেম্বর ২৬ তারিখে, এটি তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয় এবং উত্তরদিকে ঘুরে যায়। ধীরে ধীরে, এর গতি তীব্রতর হয়ে ২৯ নভেম্বর বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের স্থলভূমিতে আঘাত করে। এই গতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শক্তিশালী অবস্থা ধরে রাখে এবং এটি ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের মধ্যবর্তী অঞ্চলে মাঝারি ঘূর্ণিঝড় হিসেবে সক্রিয় ছিল। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সর্বমোট ৬,২৪০ জনের মৃত্যু ঘটে, এর মধ্যে বাংলাদেশের ৫,৭০৮ জন এবং পশ্চিমবঙ্গের ৫৩৮ জন। অধিকাংশ মৃত্যু ঘটে প্রচণ্ড ঝড়ের কারণে, বাড়ি ভেঙে পড়ে এবং আক্রান্ত অঞ্চলের বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে তড়িতাহত হয়। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে নিহতের সংখ্যা বিচারে স্মরণকালের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে এটি একটি। এটি ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশে দক্ষিণ-পূর্ব চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ২৫০ কিমি/ঘণ্টা বেগে আঘাত করে। এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ৬ মিটার (২০ ফুট) উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত করে এবং এর ফলে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ নিহত হয় এবং প্রায় ১ কোটি মানুষ তাদের সর্বস্ব হারায়। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডর বাংলাদেশের পাথরঘাটায় বলেশ্বর নদের কাছে উপকূল অতিক্রম করে। সে সময় বিশ্ব ঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন না থাকলে পাথরঘাটাসহ উপকূলের কোনো চি‎হ্ন থাকত না। প্রায় ৯,৬৮,০০০ ঘরবাড়ি ধ্বংস এবং ২১,০০০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছিল, ২,৪২,০০০ গৃহপালিত পশু এবং হাঁসমুরগি মারা গেছে। এ কারণে সাফির-সিম্পসন স্কেল অনুযায়ী একে ক্যাটাগরি-৫ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। ১৮ নভেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত সরকারিভাবে ২ হাজার ২১৭ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছিল সরকার। এ ছাড়া আইলা, নার্গিস, রোয়ানুসহ ছোট ছোট নানা দুর্যোগসহ প্রতিনিয়ত উপকূলের বাসিন্দারা দুর্যোগ মোকাবেলা করছে। বিগত বছরে যত ঘূর্ণিঝড় হয়েছে বেশিরভাগই নভেম্বর মাসে। এত কিছুর পরও উপকূলকে তেমন কোনো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। 

আগেই বলেছি ইতিহাস থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়, দিবস থেকে মানুষ অভিজ্ঞতা অর্জন করে এবং দিবসের ইতিকথা স্মরণে রাখে। ঠিক তেমনি মনে রাখার মতো একটি দিন ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর। উপকূলে যে ভয়াবহতা হয়েছে তা মনে হয় এ প্রজন্মের মানুষ জানে না। হয়তো এই দিনটিকে দিবস হিসেবে পালন করলে এ প্রজন্মের মানুষ মনে রাখত। ২০১৭ সাল থেকে উপকূল দিবসের দাবি তুলছে দেশের বিভিন্ন সংগঠন।

তাই আমরাও চাই একটি দিবস। যার নাম হবে ‘উপকূল দিবস’।

 

শফিকুল ইসলাম খোকন

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক

msi.khokonp@gmail.com 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads