• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
প্রিয় ঢাকা নগরীর কিছু খণ্ডচিত্র

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

প্রিয় ঢাকা নগরীর কিছু খণ্ডচিত্র

  • গোলাম কাদের
  • প্রকাশিত ১৯ নভেম্বর ২০১৮

দেখতে দেখতে ঢাকায় যাপিত জীবন ৪০ বছর। কত উত্থান-পতন, হাসিকান্না, আন্দোলন-সংগ্রাম আর ঢাকার রূপ যৌবন থেকে বিবর্ণ, জৌলুসে ভরা আমার প্রিয় নগরী মেগা প্রকল্পের ভারে এখন ন্যুব্জ। ঢাকা নগরী এখন নির্মল শুদ্ধ বায়ু সেবনের জায়গাটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। শৈনঃ শৈনঃ উন্নয়ন আমাদের ঊর্ধ্বগামী করেছে। আমরা এখন অনেক তকমার অধিকারী। ঢাকা নগরী এখন শুধু বাংলাদেশিদের নয়, বিদেশিদেরও আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কয়েক দশকের অভাবনীয় পরিবর্তনের ফল দেশবাসীই নয়, আমরা ঢাকাবাসীরা ভোগ করেছি, উপভোগ করছি। দুঃখ-সুখ, কান্না ও বেদনার নগরীর আরেক নাম ঢাকা নগরী। ‘কহর পড়ে গেলেও শহর ছেড় না’ এই নীতিতে অনেকেই ঢাকা নগরীতে ঢুকে আর বেরোয়নি। বেরোতে পারেনি। লালসায় ভরা আমার ঢাকা নগরী প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে এখানকার বাসিন্দারা। সাম্প্রতিককালে ঢাকা নানাভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, আলোচিত হচ্ছে- আজ সেই রকম কয়েকটি খণ্ডচিত্র নিয়ে কথা বলি।

যানজট

যানজটে নাকাল নগরবাসী। ঢাকা নগরীর আকাশচুম্বী দালানে ঘেরা রাস্তাঘাট খানাখন্দকে ভরপুর উন্নয়নের ডামাডোলে ফ্লাইওভার, মেট্রোরেলের খনন কাজ নয় শুধু, নিয়মিত পরিচর্যার অভাবে রাস্তাঘাটের অবস্থা বেহাল। বেহাল রাস্তার জন্যই নয়, ভিআইপিদের চলাচল, গাড়ির অপ্রতুলতা এবং সাম্প্রতিককালে পাঠাও, উবারের মোটরসাইকেল চালকদের হর্ন এবং দ্রুতগতির বাহন সব মিলিয়ে ঢাকার রাস্তাঘাট প্রায় অচল। মিরপুর থেকে রওনা দিলে মতিঝিল পৌঁছতে ২-৩ ঘণ্টা। যাতায়াতে প্রায় প্রতিদিন মানুষের ৪ শ্রমঘণ্টা জীবন থেকে শেষ। বিগত এক দশকেও এ অবস্থার উন্নয়ন হয়নি। আশার আলো ছিল মেট্রোরেল, তাও শ্লথগতির কারণে এখনো দৃশ্যমান হয়নি। পাঠাও-উবারে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হয়েছে। কিন্তু দুর্ঘটনা তুলনামূলকভাবে বেড়ে গেছে। পঙ্গু হাসপাতাল পরিদর্শনে গেলে টের পাওয়া যায় প্রযুক্তির দুর্ঘটনা কত, যেমন- মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা এবং মোবাইলে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হওয়ার দুর্ঘটনাজনিত কারণে রোগীর সংখ্যা অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। ঢাকা শহরে ঢাকাবাসীর জন্য ভালো কোনো পার্ক নেই। শুধু হাতিরঝিল পরিবেশবান্ধব এবং রমনা পার্ক। রমনা পার্কে ঢুকলে এখন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। গাছগাছালি আর পাখপাখালির কুহু স্বরে মনে হয় ঢাকা শহরের ভেতর একটি ছোট্ট গ্রাম। যদিও লেকের অবস্থা সন্তোষজনক নয়।

 

গ্যাস, বিদ্যুৎ

ইদানীং হঠাৎ হঠাৎই বিদু্যুৎ যাচ্ছে। লোডশেডিং। ৫-৬ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ার পরও বিদ্যুৎকেন্দ্রের রেন্টাল সুবিধা আমরাও পাচ্ছি। রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরাও পয়সা হাতিয়ে নিয়ে কলাগাছ হচ্ছে। তারপরও ইদানীং একটু বিদ্যুৎ বেশিই যাচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সৌরশক্তির তোড়জোড় একটু ভাটা পড়েছে অজানা কারণে।

আর বাসা-বাড়িতে শীত না আসতেই গ্যাস সঙ্কট দেখা দিয়েছে। একটি ডিম পোচ হতে আধাঘণ্টা লেগে যায়। অর্থাৎ গ্যাস নেই। ডিম পোচটি খাওয়ার উপযোগী করতে চুলায় কাগজ পোড়াতে হয়। এই সুযোগে সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এবং যত্রতত্র গ্যাস বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে। এগুলো মনিটর করার কেউ নেই বললেই চলে। চাল আছে ঘরে, রেঁধে খাওয়ার গ্যাস নেই। একেই বলে উন্নয়ন।

 

তফসিল

হঠাৎ আকাশ ভেঙে মেঘ নামার মতো নির্বাচনী তফসিল ঘোষণায় মানুষ, নির্যাতিত মানুষ বেরিয়ে এসেছে। ঘরে বন্দি শিশু দুয়ার খোলা পেলে যে রকম আনন্দে হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসে, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলে বিপুল সাড়া পড়ে যায়। আনন্দবেদনার জোয়ার বয়ে যায়। সরকারি দল থেকে বিরোধী নির্যাতিত দল- সবার ভেতরই নির্বাচনী উৎসবে নগর জেগে উঠেছে। মানুষ ঢাকামুখী। ঢাকামুখী মানুষের ঢল নেমে এসেছে। ফরম কেনার জন্য হোক আর নেতাদের দিকনির্দেশনার জন্যই হোক দলীয় কার্যালয়গুলো পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। হঠাৎ করেই প্রিয় ঢাকা নগরী গা-ঝাড়া দিয়ে জেগে উঠেছে। আমার প্রিয় নগরী জেগে থাক।

 

ঢাকার হোটেল-রেস্তোরাঁ

ক’দিন ধরেই দেখছি খাবার দোকানগুলোতে উপচেপড়া ভিড়। পরীক্ষার ফল প্রকাশ পেলে মিষ্টির দোকানগুলো যেরকম পরিপূর্ণ থাকে ক্রেতাসাধারণে, তার চেয়েও পরিপূর্ণ হোটেলগুলো। প্রিয় নগরী বাইরে থেকে আসা মানুষকে আপ্যায়নের জন্য যেন তৈরি হয়ে ছিল। পিঁপড়ের মতো সারি সারি মানুষ হাজির বিরিয়ানি, নান্নার বিরিয়ানির দোকানে উপচে পড়েছে। মানুষ বিরিয়ানির প্যাকেট সংগ্রহ করে রোড সাইডেই বসে পড়ছে খাওয়ার জন্য। এত বেচাবিক্রি, তার পরও কারো কারো ডাকের গলা থামছে না। এই ভিড়ের মধ্যেই ডাকছে হাজির বিরিয়ানি, নান্নার বিরিয়ানি- আসুন আসুন। এটাই হলো বাণিজ্য। এই সময়ে ঢাকার হোটেল রেস্তোরাঁগুলো বেচাবিক্রিতে জমজমাট।

 

পুলিশের নগরী

সম্প্রতি নয়, বেশ আগে থেকেই পুলিশ নিয়ে নানা কথা। কথকতা। সম্প্রতি ডিএমপি থেকে বলা হয়েছে, মাথায় হেলমেট, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট- এগুলো ছাড়া ডিউটি করা যাবে না। কথা সত্য, ইদানীং সব পুলিশ সদস্যকে সুবোধ বালকের মতো হেলমেট, জ্যাকেট পরে মোড়ে মোড়ে সারি সারি চেয়ার, বেঞ্চ পেতে বসে থাকতে দেখা যায়। কারো কারো চেহারার দিক তাকালে মায়াও হয়, মলিন চেহারা দেখে। কখনো কখনো তারা নড়েচড়ে বসে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা ভিআইপিদের মুভমেন্টে। কোথাও কোথাও মানুষের চেয়ে পুলিশের মুভমেন্ট বেশি পরিলক্ষিত হয়। পুলিশের সমালোচনা করে লাভ নেই। অনেক মানবিক গুণসম্পন্ন পুলিশ আছে যারা দেশ ও সমাজের জন্য অতিরিক্ত কাজ করে। অবশ্য এর মধ্যে বড় দু’দলে দেখা দিয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়। মোহাম্মদপুরে দুজন নিহত হয়েছে শো-ডাউন দেখাতে গিয়ে। আবার নয়াপল্টনও রণক্ষেত্র হয়েছে পুলিশ ও দলীয় কর্মীদের সঙ্গে। দু’জায়গায়ই পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিবেশ শান্ত হয়েছে।

 

বন্যেরা বনে সুন্দর

শিশুরা মাতৃক্রোড়ে

নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর ঢাকা শহরে আলোচনার ঝড় উঠেছে। শিল্পী, ক্রীড়াবিদ, নানা শ্রেণি-পেশার লোকের নমিনেশন ফরম কেনাকে কেন্দ্র করে। কিনছে তো কিনছেই, আগে অনেকেই কখনো দলীয় কাজে অংশগ্রহণ করেনি, দলের কাছে তারা যায়নি। কৃষকের কাছে যেমন ব্যাংক এগিয়ে গিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়ে ঋণ দিচ্ছে, সেই রকম দল ক্রীড়াবিদ, শিল্পী, নানা শ্রেণি-পেশার লোকদের কাছে যাচ্ছে তাদের গ্রহণযোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে যদি পাস করিয়ে আনা যায়। তবে এমপির দল ভারী হবে। এতে তৃণমূলের ত্যাগী যারা তারা ক্ষুব্ধ হবে। এ ছাড়া টাকার ভারে ন্যুব্জ যারা, সেই সব ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ব্যক্তিদের নমিনেশন দিয়ে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে পাসের স্বার্থে। প্রধানমন্ত্রীর কথায় ‘এবার নির্বাচন কঠিন হবে।’ আমরা দেখেছি অমিতাভ বচ্চন, শত্রুঘ্ন সিনহা, অরুণা ইরানী, নায়ক গোবিন্দ যারাই নির্বাচন করেছেন জিতেছেন। তারা তেমন করে তাদের স্ব-স্ব ক্ষেত্রে আর ফিরে আসেননি। আমাদের দেশেও কমবেশি এ রকম দেখা গেছে, যেমন নায়িকা কবরীসহ আরো অনেকে।

এবারই সম্ভবত সব দল থেকে ফেসভেল্যুর ক্রিকেটার, শিল্পী অভিনেতারা মনোনয়ন নিচ্ছেন। কিন্তু যারা মাঠে ছক্কা মেরে দেশ-বিদেশের কোটি জনতার হূদয় হরণ করেন, তারা তার এলাকার রাজনীতিতে কতটা সফল হবেন বলা মুশকিল। সে জন্যই বলা, ‘বনেরা বনে সুন্দর-শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।’ যারা মাঠ আলোকিত করে দেশ ও জাতির সেবা করছেন, তারা কি নির্বাচিত হয়ে দেশকে ওই মাত্রায় পৌঁছাতে পারবেন?

আট টুকরো লাশ

দেশব্যাপী আনন্দ উল্লাস। স্লোগান, কারাবন্দিদের মুক্তি- এ আওয়াজ আজ নগর ছাপিয়ে গ্রামগঞ্জে পৌঁছে গেছে। নির্বাচনী আলোচনায় প্রিয় ঢাকা নগরীর হোটেল-রেস্তোরাঁ ও ফুটপাতের স্টলগুলো সরগরম হয়ে উঠেছে। এর ভেতরও ‘বন্দুক যুদ্ধ’ থেমে নেই। অপহরণ থেমে নেই। এমনকি খাগোশি হত্যার মতো মাথাবিহীন দেহের ৮ টুকরো লাশের খোঁজ পাওয়া গেছে সাভারে। আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায়। ঢাকা নগরীর আশপাশেই এ রকম ভয়ঙ্কর কাণ্ড কারখানা ঘটছে। কয়েক দিন আগে ঢাকার পাশেই চার যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেছে। সবকিছুই চলমান। চলছে প্রিয় ঢাকা নগরীতে আনন্দ-বেদনা আর ভয়ঙ্কর সব কাণ্ড। সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হয় কোন সময় কোন অঘটন ঘটে যায়। আমার প্রিয় ঢাকা নগরী সব অপচ্ছায়ার করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হয়ে হেসে উঠুক। হেসে উঠুক বিশ্বদরবারে।

লেখক : কবি সাংবাদিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads