• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
একটি ভারসাম্যযুক্ত অর্থনীতিই প্রয়োজন

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

একটি ভারসাম্যযুক্ত অর্থনীতিই প্রয়োজন

  • প্রকাশিত ২০ নভেম্বর ২০১৮

হারুন-আর-রশিদ

পত্রিকায় এসেছে (০৭.১১.১৮) প্রাণ-আরএফএল পণ্য উৎপাদনকারী গ্রুপটির বার্ষিক টার্নওভার সব মিলিয়ে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে শিল্প গ্রুপটির ব্যাংক ঋণ আছে ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ হিসাবে শিল্প গ্রুপটির কাছে ব্যাংকগুলোর ঋণ দাঁড়িয়েছে ব্যবসার প্রায় আড়াইগুণ। ব্যাংকাররা বলেছেন, ঋণের সম্প্রসারণে রশি টেনে ধরা উচিত। ঋণ না বাড়িয়ে পরিশোধের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। জনগণের আমানতের টাকা ঋণ নিয়ে বার্ষিক টার্নওভার বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু ঋণের টাকা ফেরত যে পরিমাণে দেওয়া প্রয়োজন, তার চেয়ে আড়াইগুণ কম হারে গ্রুপটি ঋণ পরিশোধ করেছে। এসব ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোনো জবাবদিহি আছে বলে মনে হয় না। শাসকগোষ্ঠী উন্নয়নের ডামাডোল বাজাচ্ছে কিন্তু ব্যাংকগুলো যে বার্ষিক লভ্যাংশ হারাচ্ছে, সেদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো দৃষ্টি আছে বলে মনে হয় না (সূত্র : বণিক বার্তা, ৭ নভেম্বর ২০১৮ বুধবার)। আর্থিক খাতে যে অনিয়ম যা বহু বছর ধরে চলছে, সেই ছিদ্রপথ বন্ধ তো করা যায়ইনি; বরং তা আরো সম্প্রসারিত হয়েছে। ৩৬ কোটি হাত দিয়ে ৫৬ হাজার বর্গমাইলবেষ্টিত বাংলাদেশকে মালয়েশিয়া শুধু নয়, ভিয়েতনাম কিংবা মিয়ানমারের ধারেকাছেও আমরা পৌঁছাতে সক্ষম হইনি।

সরকার বলছে দেশ উন্নয়নে সাগরে ভাসছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ দেশের অর্থনীতির যে অগ্রগতি, তার সুফল পাচ্ছে না। দেশের মোট জনশক্তির বড় অংশ প্রবৃদ্ধির সুফল থেকে বঞ্চিত। উন্নয়ন হলে প্রবৃদ্ধি বাড়বে এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। জিডিপির প্রবৃদ্ধি যে হারে বাড়ছে, সে অনুসারে বাড়ছে না কর্মসংস্থান। দেশে যে আর্থিক বৈষম্য বিরাজমান রয়েছে তা অর্থনীতি, পরিবেশ, সমাজ ও গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। অন্যদিকে শিক্ষার ক্ষেত্রে যে বৈষম্য রয়েছে, তার প্রভাব পড়ছে সার্বিক কর্মসংস্থানের ওপর। প্রায় এক কোটি প্রবাসী বাঙালি যদি আর্থিক খাতে সব লেনদেন বন্ধ করে দেয়, তাহলে বাংলাদেশের এক থেকে দুই মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হতো না।

আমাদের দেশে মানহীন শিক্ষা কর্মসংস্থানে রাষ্ট্রের উন্নতির বড় বাধা। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে বিশিষ্ট জনদের বক্তৃতায় এসব কথা উঠে আসে। আমাদের বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিকদের মতে, দেশের অর্থনীতিতে বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। এটি শুধু সম্পদের ক্ষেত্রে নয়, আয় ও ভোগের ক্ষেত্রেও বাড়ছে এই বৈষম্য। সম্প্রতি যোগ হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসুবিধা ও আঞ্চলিক বৈষম্য। তারা আরো বলেছেন, বছরে ৯৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। বাড়ছে খেলাপি ঋণ। বাজারব্যবস্থায় আয় অনুপাতে ব্যয় বাড়ছে। অর্থাৎ সবক্ষেত্রেই বৈষম্য বাড়ছে। একটি ইতিবাচক দিক হলো শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে একটি বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র গড়ে তোলা। বাংলাদেশের বয়স ২০২১ সালে ৫০ বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েলথএক্সের সর্বসাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে হয়, গত পাঁচ বছরে বিশ্বে ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির হারের বিবেচনায় সবচেয়ে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যয়ের বোঝা বেড়েছে আর কমেছে আয়ের বোঝা। এক কথায় টাকা এখন ব্যাগে করে নিয়ে যাবেন আবার ওই ব্যাগেই পণ্য কিনে ঘরে ফিরবেন। আমাদের অর্থনীতির মূল কাঠামোটা এমনভাবে গড়ে উঠেছে, তাতে মনে হচ্ছে দেশের চেহারার চেয়ে মানুষের চেহারার পরিবর্তন দ্রুতগতিতে বাড়ছে। আজ বাংলাদেশে গত এক মাস থেকে প্রায় কয়েক শতাধিক প্রকল্প অনুমোদনের যে হিড়িক পড়েছে তা পৃথিবীর কোনো দেশে হয় বলে জানা নেই। নির্বাচনকে টার্গেট করে জনসমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে এসব প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) কাজই হলো নতুন নতুন প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া। পদ্মা সেতু প্রকল্পটি শেষ হতে এখনো এক থেকে দেড় বছর সময় লাগবে। অর্থাৎ একটি প্রকল্প শেষ হতেই সময় লাগছে যেখানে ৪ থেকে ৫ বছর, সেখানে দেশে মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নে কত সময় লাগবে, তা ৫০-এর উপরের বয়সী মানুষ চোখে দেখে যেতে পারবে না।

নভেম্বর ২০১৮ সালে খোলা বাজারে এলপি গ্যাস কিনতে হচ্ছে ১২ লিটার (যার অর্ধেকই হাওয়া) ১২৫০ টাকায়। তিন মাস আগে ছিল এর দাম ১০০০ টাকা। দুই মাসের ব্যবধানে বেড়ে গেল ২৫০ টাকা। নালিশ করার জায়গাটা পর্যন্ত এখন খোলা নেই। বুকের ব্যথা শুধু বুকের মধ্যে চেপে রাখা ছাড়া কোনো বিকল্পও জানা নেই। ৭ নভেম্বর ২০১৮, এক মন্ত্রীর কথা পত্রিকায় উঠেছে এভাবে, ৩৮ বছরের কাজ ৭ বছরে করেছি। বর্তমান অর্থনীতির আকার ২৭৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নতি হয়েছে, যা ৩৮ বছরের সরকারেরা পারেনি। কিন্তু বাস্তবে জনগণ এসব উন্নয়নের কতটুকু অংশীদার হতে পেরেছে এবং এদের শতাংশ হার কত— এসব বিবেচনায় রাখতে হবে। সরকার বলছে, প্রায় ১ হাজার ৮০০ মার্কিন ডলার মাথাপিছু গড় আয় ২০১৮ সালে অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। ঘুষখোর, লুটেরা এবং দুর্নীতিবাজদের টাকা যোগ করলে মাথাপিছু গড় আয় যথার্থ বলা যায়। কিন্তু তাদের টাকা বাদ দিলে ৭০০ ডলার মাথাপিছু গড় আয় হবে বলে মনে হয় না। আয়-রোজগার ভালো হলে ঢাকা ও অন্যান্য শহরে ভিক্ষুকের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে কেন? এখন তো পরিবহন সেক্টরে এদের যন্ত্রণায় থাকা যায় না। এর পাশাপাশি হকারদেরও জ্বালাযন্ত্রণা বাড়ছে। বর্তমানে সরকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে সফল হয়েছেন কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে সেই হিসাবে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা তাকিয়ে থাকেন প্রতিবছর বেতন কত বেড়েছে। যদি দেখেন ২০ শতাংশ বেতন বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তখন ব্যবসায়ীরা যৌথ উদ্যোগে পরামর্শ করে বাজারে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দেন। এর সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট সুবিধাভোগী মহল জড়িত থাকে বিধায় অসৎ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না।

৭ নভেম্বর ২০১৮ একটি দৈনিকে ছাপা হয়েছে, আমদানি ব্যয় যেভাবে বেড়েছে, রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় সেভাবে বাড়েনি। ফলে গত দুই বছরে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এর ধাক্কা লেগেছে ব্যালান্স অব পেমেন্টে। ফলে ক্রমবর্ধমান রিজার্ভ কমতে শুরু করেছে। আমদানিতে ব্যয় হচ্ছে বেশি, রাষ্ট্রের রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের তুলনায় অনেক দিন ধরে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স সরকারের ঘাটতি বাণিজ্য নিয়েই চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের আমদানি ব্যয় হয়েছে ৫৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের জুলাই ও আগস্টে আমদানিতে ৮ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে। এ হিসাবে, প্রতিমাসেই দেশের আমদানি ব্যয় হচ্ছে গড়ে প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার। গত সেপ্টেম্বর ২০১৮-তে রফতানি থেকে আয় হয়েছে ২ হাজার ৫৬৯ মিলিয়ন ডলার। ওই সময়ে আমদানি ব্যয় হয়েছে রফতানি আয়ের প্রায় দ্বিগুণ অর্থাৎ ৪ হাজার ৭৪৫ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার। চলতি হিসাবের দীর্ঘদিনের এই ঘাটতি নেতিবাচক ধারায় নিয়ে গিয়েছিল ব্যালান্স অব পেমেন্টের। অর্থনীতির এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা অর্থাৎ বাড়া এবং কমে যাওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ন্ত্রণ করে।

সম্প্রতি সরকারি রাজস্ব বিভাগ আয়কর বাড়ানোর জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মাইকিং করে জনগণের বাসাবাড়িতে জানান দিচ্ছে যে, বিদেশ থেকে আর ঋণ গ্রহণ নয়, নিজের আয়ে দেশ চালাবো। কর দিলে ঋণ কমবে, মানুষ স্বচ্ছন্দে জীবনযাপন করতে পারবে। সাধারণ মানুষের যে আয়, সে তো আয়করের আওতায় পড়ে না। কর যারা দেবেন, তারা দিচ্ছেন কর ফাঁকি। এদের ধরুন। কর ফাঁকি দেওয়ার নানা ফন্দিফিকির এরাই করছেন। উপার্জিত কালো টাকা তারা কোথায় বিনিয়োগ করছেন তা অনুসন্ধান করুন। কর মেলা করে কর ফাঁকি রোধ করা সম্ভব নয়। উদীয়মান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে করের আওতায় আনুন। অবৈধ আয়ের উৎসগুলো বন্ধ করুন এবং কালো টাকার ওপর কর ধার্য করুন। আমদানি ও রফতানির মধ্যে ভারসাম্যযুক্ত একটি অর্থনীতি দেশের জন্য অতীব জরুরি। সেদিকে নজর দিন। তাহলেই বাংলাদেশ অর্থনীতিতে এগিয়ে যাবে।

 

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক

harunrashidar@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads