• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও ৩৫তম রায়

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও ৩৫তম রায়

  • প্রকাশিত ২৭ নভেম্বর ২০১৮

বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (Tribunal constituted under section 6 (1) of the Act No. XIX of 1973) গঠন হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৩৫টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষিত রায়ে ৮৫ আসামির মধ্যে পাঁচজন বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছেন এবং বাকি ৮০ জনের সাজা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৫৩ যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ রায় এসেছে।

গত ৫ নভেম্বর ২০১৮ সোমবার ঘোষিত রায়টি ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ৩৫তম রায় (মামলা নম্বর ICT-BD [ICT-1] Case No. 05 of 2016). রাষ্ট্রপক্ষে এ মামলার প্রসিকিউটর ছিলেন রানা দাশগুপ্ত ও রেজিয়া সুলতানা চমন এবং পলাতক দুই আসামির পক্ষে রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী ছিলেন গাজী এমএইচ তামিম। অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১৬ সালের ১ নভেম্বর লিয়াকত আলী ও আমিনুল ইসলামের বিচার শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আইনজীবীদের প্রারম্ভিক বক্তব্য উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে ওই বছরের ৪ ডিসেম্বর শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ এবং ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর আসে চূড়ান্ত রায়। রায়ে বলা হয়, একাত্তরে লিয়াকত আলী ও আমিনুল ইসলাম হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিভিন্ন এলাকায় অপহরণ, নির্যাতন, লুটপাট, হত্যা ও গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট সাতটি অভিযোগ আনা হয় এবং প্রতিটি অভিযোগে আলাদা আলাদাভাবে মৃত্যুদণ্ডের রায় এসেছে আদালতে। রায়ের বিস্তারিত বিবরণ https://www.ict-bd.org/ict1/judgments.php লিংকে পাওয়া যাবে।

আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত পঞ্চম অভিযোগটি ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর থানার ফান্দাউক গ্রামের বাচ্চু মিয়াকে অপহরণ এবং রঙ্গু মিয়াকে অপহরণ ও হত্যা মামলাটি। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ১৯৭১ সালের ভাদ্র মাসের প্রথম সপ্তাহে আনুমানিক সকাল ১০ ঘটিকায় অভিযুক্ত রাজাকার কমান্ডার লিয়াকত আলী ও আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে ১০-১২ জনের রাজাকার ও আলবদরের একটি দল বাচ্চু মিয়া ও রঙ্গু মিয়াকে ফান্দাউক বাজারের পোস্টঅফিসের সামনে থেকে অপহরণ করেন। তারা দুজনই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন। তাদের অপহরণ করে হাত-চোখ বেঁধে ফান্দাউক কমিউনিটি হলে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যান। রাজাকার ক্যাম্পে রাতভর তাদের নির্যাতন করে পরের দিন সকাল আনুমানিক ১০ ঘটিকায় নৌকাযোগে নাসিরনগর থানায় চালান দেওয়া হয় এবং সেখান থেকে দুজনকে দুই দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। ওইদিন বেলা ১২টায় নাসিরনগর থানার ডাকবাংলোর পশ্চিম দিকে দত্তবাড়ীর খালের ধারে এক নির্জন জায়গায় রঙ্গু মিয়াকে নিয়ে অমানসিক নির্যাতন, বেয়নেট দিয়ে মাথায় আঘাত ও পরে তাকে হত্যা করে মৃতদেহ দত্তবাড়ী খালে ফেলে দেওয়া হয়। এদিকে বাচ্চু মিয়াকে হাত-পা-চোখ বেঁধে ফেলে রাখা হয় এবং অমানসিক নির্যাতন করা হয়। খবর পেয়ে বাচ্চু মিয়ার মামা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মো. টকু মিয়া নাসিরনগর থানা রাজাকার বাহিনীর কনভেনর চোয়াব আলী চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। যোগাযোগের একপর্যায়ে জানতে পারেন রঙ্গু মিয়াকে হত্যা করা হয়েছে এবং বাচ্চু মিয়াকে হাত-পা-চোখ বেঁধে হাওরে নৌকায় রাখা হয়েছে কিন্তু সে বেঁচে আছে। কথার একপর্যায়ে চোয়াব চৌধুরী টাকার বিনিময়ে বাচ্চু মিয়াকে খালাসের আশ্বাস দেন। তাৎক্ষণিক টকু মিয়া আনুমানিক ৫০ হাজার রুপির বিনিময়ে আপন ভাগ্নেকে প্রায় মুমূর্ষু অবস্থায় রাজাকারদের হাত থেকে মুক্ত করেন।

দেশি-বিদেশি নানামুখী চক্রান্ত, চাপ ও অনুরোধ সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন। নিরপেক্ষতা ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সব ক্যাটাগরিতে উত্তীর্ণ এই ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত ঘোষিত সব রায় ছিল সাধারণ মানুষ তথা নির্যাতিত ও শহীদ পরিবারগুলোর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশার প্রতিফলন। ট্রাইব্যুনালের রায়ের মাধ্যমে রাজাকার, আলবদর, আলশামস তথা পাক-হানাদার বাহিনীর দোসর কর্তৃক নির্যাতিত ও শহীদ পরিবারগুলো সান্ত্বনার জায়গা ফিরে পেয়েছে, দেশ ও জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে, শহীদদের আত্মা শান্তি পেয়েছে। এদেশের কিছু মানুষ যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী এ রায় মেনে নিতে পারেনি, তারা নানাভাবে এ রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত শক্তহাতে তাদের প্রতিহত করেন এবং শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও তিনি আদালতের দেওয়া রায়কে কার্যকর করেন। ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশ যেমন উন্নয়নের মহাসড়কে ঠিক তেমনি দেশ আজ কলঙ্কমুক্ত।

বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং এর বিচারকার্য যেমন ইতিহাসের অংশ ঠিক তেমনি ৩৫তম রায় এবং পঞ্চম অভিযোগটি গঠনের মাধ্যমে আমাদের পরিবারও আজ ইতিহাসের অংশ হয়েছে। ১৯৭১ সালে রাজাকার কর্তৃক অপহূত ও নির্মমভাবে নির্যাতিত মো. বাচ্চু মিয়া আমার বাবা এবং অপহূত, নির্যাতিত ও নিহত মো. রঙ্গু মিয়া আমার চাচা। সেদিন অন্যত্র থাকায় এবং বিরাট অঙ্কের টাকার বিনিময়ে আমার বাবা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেলেও সেই ঘাতকচক্র, রাজাকার, দালাল ও তাদের দোসররা আমার বাবাকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি এবং ১৯৮৪ সালের এপ্রিল মাসের ৭ তারিখে তাকে হত্যা করা হয়। বাবা ছিলেন ফান্দাউক ইউনিয়নের ১৯৭২-১৯৮৪ পর্যন্ত নির্বাচিত চেয়ারমান, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও তৎকালীন রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান, নাসিরনগর থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। ১৯৮৬ সালে তৎকালীন সামরিক আদালতে আমার বাবা হত্যা মামলার আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছিল। সেদিন এবং আজো আমরা কৃতজ্ঞ মহান আল্লাহর কাছে এবং তৎকালীন সরকারের প্রতি আমাদের ন্যায়বিচার উপহার দেওয়ার জন্য।

দীর্ঘ ৪৭ বছর পর ট্রাইব্যুনাল ঘোষিত ৩৫তম (ফাঁসির আদেশ) রায়ে সব শহীদ পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিবারও খুশি ও আনন্দিত। এ রায়ে উল্লেখিত এলাকার মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে এবং বিরাজ করছে আনন্দের বন্যা। দীর্ঘদিন পরে হলেও তারা ন্যায়বিচার পেয়েছে। আবারো ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনাকে, যিনি শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছেন এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় এনেছেন। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা মামলাসংশ্লিষ্ট সবাইকে, যাদের সহযোগিতায় নির্যাতিত ও শহীদ পরিবারগুলো ন্যায়বিচার পেয়েছে। এখন নির্যাতিত ও শহীদ পরিবারগুলো এবং এলাকাবাসী দ্রুত আদালতের রায়/আদেশ বাস্তবায়ন দেখতে চায়। দণ্ডিত পলাতক আসামি লিয়াকত আলী ও আমিনুল ইসলামকে গ্রেফতার করে দ্রুত আদালতের রায় বাস্তবায়নের দাবি নির্যাতিত ও শহীদ পরিবারগুলোর।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন, বিচার প্রক্রিয়া শুরু থেকে রায় কার্যকর প্রতিটি বিষয় বাঙালি জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। প্রতিটি রায় নির্যাতিত ও শহীদ পরিবারগুলোকে সান্ত্বনা দিয়েছে, উজ্জীবিত করেছে, জুগিয়েছে শক্তি ও প্রেরণা। পরিবারগুলো আজ একসুতায় বাঁধা একটি ইতিহাস। ৩৫তম রায়ের মাধ্যমে নির্যাতিত ও শহীদ পরিবার হিসেবে আমরাও আজ এ ইতিহাসের অংশ। বাবা, চাচা তোমাদের আত্মার শান্তি ও মাগফিরাত কামনা করছি। দীর্ঘদিন পরে হলেও এ জাতি কলঙ্কমুক্ত হলো, আমরা এখন প্রতীক্ষায় আছি দ্রুত এ রায় বাস্তবায়নের আশায়।

ড. মোহাম্মদ আলমগীর কবীর

লেখক : অধ্যাপক ও সাবেক প্রভোস্ট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads