• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
মাধ্যমিক থেকে ঝরে পড়ছে কন্যাশিশুরা

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

মাধ্যমিক থেকে ঝরে পড়ছে কন্যাশিশুরা

  • রহিমা আক্তার মৌ
  • প্রকাশিত ৩০ নভেম্বর ২০১৮

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত শিক্ষা তথ্য প্রতিবেদনের এক তথ্যে উঠে এসেছে- শিক্ষা খাতে উপবৃত্তি, বিনামূল্যে পাঠ্যবই, শুকনো খাবার ও নাশতা বিতরণের মতো কর্মসূচির সুবাদে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ এখন প্রায় শতভাগ। তবে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে না পারায় এসব শিক্ষার্থীকে পরবর্তী পর্যায়ে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। প্রাথমিকে ভর্তি হওয়া শিশুদের ২০ শতাংশই পঞ্চম শ্রেণি শেষ করার আগেই ঝরে পড়ে। মাধ্যমিকে গিয়ে ঝরে পড়ার এ হার দাঁড়ায় ৪০ শতাংশেরও বেশি। আর উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন না করেই ঝরে পড়ছে প্রায় ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ হিসাব অনুযায়ী দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ঝরে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি মাধ্যমিক পর্যায়ে।

দেশে শিক্ষায় মাধ্যমিক স্তর শেষ করার আগেই প্রায় অর্ধেক মেয়ের শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে যায়। এটা আগেও ছিল আর বর্তমানেও আছে। নারীশিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে এ প্রবণতাকে মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। সরকারি হিসেবেই ২০১৫ সালে ৪৫ দশমিক ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী মাধ্যমিক স্তর থেকে ঝরে পড়ছে। ২০০৮ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ৬৫ শতাংশেরও বেশি। ২০১৫ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায় অষ্টম শ্রেণিতে উঠে সবচেয়ে বেশি ২১ দশমিক ০৭ শতাংশ স্কুলছাত্রী ঝরে পড়ে। এরপর দশম শ্রেণিতে ১৮ দশমিক ৫২ শতাংশ মেয়ের পড়ালেখা বন্ধ হয়। হিসাবটি তিন বছর আগের হলেও এই কয়েক বছরে পরিবর্তন হয়নি কিছুই। তার প্রমাণ তুলে ধরেছে আমাদের গণমাধ্যমগুলো।

শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় ২০১৮ সালের জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় ১১১ ছাত্রী পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। বাল্যবিয়ে হওয়ায় তারা পরীক্ষায় অংশ নেয়নি বা নিতে পারেনি। তাহলে মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, সারা দেশের অবস্থা কী হতে পারে। বাঞ্ছারামপুর উপজেলার উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে বলা হয়, এবারের জেএসসি (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট) পরীক্ষায় পাঁচ হাজার ৫৯৪ ও জেডিসি (জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট) পরীক্ষায় ৬১২ জন শিক্ষার্থী নিবন্ধন করে। তাদের মধ্যে গত তিন পরীক্ষায় জেএসসিতে ১৭২ জন অনুপস্থিত থাকে। ১৭২ জনের মধ্যে ১০৬ জনই ছাত্রী এবং ৮৯ জন ছাত্র।

অন্যদিকে জেডিসি পরীক্ষায় ৬১২ শিক্ষার্থী নিবন্ধন করে। তাদের মধ্যে নয় শিক্ষার্থী অনুপস্থিত। নয়জনের মধ্যে পাঁচজন ছাত্রী এবং চারজন ছাত্র। বাঞ্ছারামপুর এসএম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আতিকুর রহমান জানান, তার স্কুলের কেন্দ্রে ৫০ ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হওয়ার কারণে অনুপস্থিত।

রূপসদী বৃন্দাবন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নূর মোহাম্মদ জমাদ্দার বলেন, আমাদের কেন্দ্রে ২৯ ছাত্রী অনুপস্থিত। তাদের সবারই বাল্যবিয়ে হয়ে যাওয়ায় অনুপস্থিত। রূপসদী খোদাইবাড়ী আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষ আবদুস সাত্তার বলেন, আমাদের মাদরাসার দুই ছাত্রীর বিয়ে হয়ে যাওয়ায় অনুপস্থিত রয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আবু তৌহিদ বলেন, জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় গত তিন পরীক্ষায় ১৮১ পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত। তাদের মধ্যে ৯৩ ছাত্র এবং ১১১ জন ছাত্রী। ১১১ ছাত্রীর বেশিরভাগ ছাত্রীর বিয়ে হয়ে যাওয়ার কারণে অনুপস্থিত বলে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘মাধ্যমিকে এসেই আমাদের হোঁচট খেতে হয়। তার বড় কারণ হলো ৯৭ ভাগ মাধ্যমিক স্কুল বেসরকারিভাবে পরিচালিত।’ আর্থসামাজিক অবস্থাও এর কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রবণতাটি একধরনের অশনিসংকেত। আমাদের, বিশেষ করে আমাদের সমাজের জন্য। প্রায় অর্ধেকের মতো মেয়েরা ঝরে পড়ছে, মাধ্যমিক সমাপ্ত করতে পারছে না। আর উচ্চশিক্ষার দিকে যাওয়ার ক্ষেত্রে সেটা তো একটা নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করছেই।’

মূলত অভিভাবকদের নিম্ন আয়, বাল্যবিয়ে ও দারিদ্র্যই শিক্ষা থেকে কন্যাশিশুর ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ। এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘বর্তমানে শুধু উপবৃত্তির টাকা দিয়ে পড়াশোনার ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হয় না। কারণ কোচিং-প্রাইভেটসহ অন্যান্য খরচ রয়েছে। এছাড়া সামাজিক ও আর্থিক বাস্তবতার কারণেও অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে।’

একদিকে পরিবারের হাল ধরতে, পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা করতে মেয়েশিশুরা লেখাপড়া থেকে সরে যায়। অন্যদিকে অল্প বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেয় পরিবারগুলো। এর ফলে ওদের ভবিষ্যৎ যে শেষ হয়ে যায় তা পরিবারগুলো বোঝেই না। বিয়ের বয়স কম বা বেশি নয়, মেয়েদের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার কথা ভাবতে হবে, পথ দেখাতে হবে। পরিবারগুলোকে বুঝতে ও বোঝাতে হবে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। নেপোলিয়নের সেই উক্তি, ‘আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি দেব।’

 

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads