• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
কৃতজ্ঞ কুকুর ও অকৃতজ্ঞ মানুষের কথা

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

কৃতজ্ঞ কুকুর ও অকৃতজ্ঞ মানুষের কথা

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ০১ ডিসেম্বর ২০১৮

কুকুরের প্রভুভক্তির বিষয়টি নতুন নয়। প্রাণিকুলের মধ্যে কুকুর অত্যন্ত প্রভুভক্ত, বিশ্বস্ত ও কৃতজ্ঞ। চতুষ্পদ এ প্রাণীটি মনিবের জন্য যে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে দ্বিধা করে না- এর বহু প্রমাণ রয়েছে। কুকুর যে গৃহে পালিত হয়, সে গৃহের মানুষগুলোর প্রতি সে থাকে কৃতজ্ঞ। বিভিন্ন সময়ে এ প্রাণীটি প্রভুভক্তি, বিশ্বস্ততা কিংবা কৃতজ্ঞতার জন্য সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছে।

বছর পাঁচেক আগে তেমনি একটি খবর বেরিয়েছিল পত্রিকায়। খবরটি ছিল প্রভুর জন্য একটি কুকুরের জীবনদানের ঘটনার। ঘটনাটি ঘটেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার একটি শহরে। খবরে বলা হয়েছিল, এক ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেফতার করে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে তার পোষা কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করে পুলিশকে বিরত রাখতে চায়। কিন্তু পুলিশ তাতে কর্ণপাত না করায় কুকুরটি আক্রমণ করে পুলিশকে। সে তাদের হাত কামড়ে দেয়। একপর্যায়ে একজন পুলিশ কর্মকর্তা কুকুরটিকে গুলি করলে ওটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এ দৃশ্য দেখে কুকুরটির মালিকও হাউমাউ করে কেঁদেছে বলে খবরে বলা হয়েছে। (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৪ জুলাই ২০১৩)

কুকুরের এ ধরনের প্রভুভক্তির গল্পের অভাব নেই।  আমার জানা এ ধরনের তিনটি গল্পের কথা এখানে উল্লেখ করব।  ছেলেবেলায় সম্ভবত ক্লাস থ্রি’র বাংলা বইয়ে একটি গল্প পড়েছিলাম। গল্পটি এরকম- পালিত কুকুরসহ জাহাজে ভ্রমণ করছিল এক বালক। হঠাৎ পা ফসকে সে সাগরে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তার কুকুরটি লাফিয়ে পড়ে সাগরে। বালকের জামা কামড়ে ধরে প্রাণপণ সাঁতরাতে থাকে জাহাজের দিকে। জাহাজের ক্যাপ্টেন জাহাজ থামিয়ে দেন। ওই সময় একটি হাঙ্গর দ্রুত ছুটে আসতে থাকে বালক ও কুকুরের দিকে। ক্যাপ্টেন তার বন্দুক দিয়ে গুলি ছোড়েন। হাঙ্গরের মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। জাহাজের খালাসিরা ছোট বোট নিয়ে উদ্ধার করে আনে বালক ও তার কুকুরকে।

দ্বিতীয় গল্পটি পড়েছিলাম প্রায় চল্লিশ বছর আগে। লেখকের নাম মনে নেই। সম্ভবত গল্পটির শিরোনাম ছিল ‘হিসাব’। ডিএফপি প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা মাসিক পূর্বাচল-এ (বর্তমানে লুপ্ত) প্রকাশিত হয়েছিল গল্পটি। একটি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের পরিবারে মোট সদস্য চারজন। তিনি নিজে, ছোটবেলা থেকে আদর-স্নেহে বড় করে তোলা এক যুবক, যাকে অনাথ অবস্থায় কুড়িয়ে পেয়ে পুত্রস্নেহে লালন-পালন করে ওই স্কুলেই দফতরির চাকরি দিয়ে রেখেছেন, একটি বিড়াল এবং একটি কুকুর; যেটি রাতে তার কামরাতেই থাকত। এ তিনজনকেই খুব ভালোবাসতেন প্রধান শিক্ষক।

প্রতিরাতে খাওয়ার পর তিনি বিড়ালটিকে একবাটি করে দুধ খেতে দিতেন। একদিন রাতে খেতে গিয়ে দেখেন পাতিলে দুধ নেই। বুঝলেন বিড়ালটি চুরি করে দুধ খেয়ে ফেলেছে। রাগে, দুঃখে প্রধান শিক্ষক বিড়ালটিকে খুব মারলেন। বিড়ালটি বাসা ছেড়ে চলে গেল। কয়েকদিন পর স্কুল কম্পাউন্ডে বিড়ালটিকে দেখে তিনি ‘মিনি’ বলে ডাকলেন। বিড়ালটি একবার তাকিয়েই ভোঁ দৌড় দিল উল্টোদিকে। শিক্ষক মন খারাপ করে চলে গেলেন অফিসে।

এর কয়েকদিন পরেই ঈদের ছুটি হলো। স্কুল থেকে বেতন-বোনাস পেয়ে রাতে দফতরি ছেলেটিকে কিছু টাকা দিলেন। সে বাড়ি যাবে। বাকি টাকা বালিশের নিচে রেখে প্রধান শিক্ষক ঘুমিয়ে পড়লেন। মাঝরাতে ঘরের মধ্যে ধস্তাধস্তির আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় তার। উঠে আলো জ্বালেন তিনি। দৃশ্য দেখে আঁৎকে উঠলেন। দেখলেন কুকুরটি দফতরির একটি হাত কামড়ে ধরেছে আর দফতরি একটি ধারালো চাকু দিয়ে কুকুরটিকে এলোপাতাড়ি কোপাচ্ছে। দফতরি সজোরে কুকুরটির বুকে চাকু বসিয়ে দিতেই সেটা নিস্তেজ হয়ে পড়ল, আর সে সুযোগে দুর্বৃত্ত দফতরি পালিয়ে গেল। শিক্ষক আহত কুকুরটিকে নিয়ে হাসপাতালে গেলেন কিন্তু বাঁচাতে পারলেন না। তীব্র মনোকষ্ট নিয়ে স্কুল কম্পাউন্ডের এক কোণে কুকুরটিকে মাটিচাপা দিয়ে অশ্রুসজল নয়নে ঘরে ফেরেন তিনি। গল্পটির শেষ ক’টি লাইন ছিল এরকম- ‘তারপর অঙ্কের শিক্ষক ওয়াজিউল্লাহ (পাঠক, গল্পের শিক্ষকের নামটি মনে নেই, তাই আমার একজন প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের নামটি ব্যবহার করলাম) অঙ্ক কষতে বসলেন। হিসাব কষলেন- ‘কৃতজ্ঞতার পূর্ণমান যদি ১০০ হয়, তাহলে কুকুর পাবে ১০০, বিড়াল পাবে ৫ (যেহেতু ডাক দেওয়ার পর একবার ফিরে তাকিয়েছে), আর মানুষ পাবে শূন্য।’ গল্পটি এখানেই শেষ। গল্পটিতে লেখক কী মেসেজ দিতে চেয়েছেন তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার দরকার পড়ে না।

কুকুরের প্রভুভক্তির তৃতীয় যে গল্পটির কথা আমি উল্লেখ করতে যাচ্ছি সেটা নিছক গল্প নয়, সত্যি ঘটনা। বরেণ্য সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই’-এ ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। তার পিতা তখন ময়মনসিংহ জেলার কোনো এক থানার ওসি। বাসভবন হিসেবে পেয়েছেন পুরনো কোনো এক জমিদার বাড়ি। চারদিকে ঝোপজঙ্গল। এক দুপুরে হুমায়ূন আহমেদ ভাই-বোন নিয়ে উঠোনে খেলছিলেন। দালানের সিঁড়িতে বসে ছিল তার সবচেয়ে ছোটভাই আহসান হাবীব (বর্তমানে প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট ও লেখক)। হঠাৎ একটি গোখরো সাপ বেরিয়ে এসে ফণা তুলে হাবীবকে ছোবল মারতে উদ্যত হয়। সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হুমায়ূন আহমেদের বাবার একটি পোষা কুকুর ছিল। কালবিলম্ব না করে সেটি হুংকার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাপটির ওপর। কামড়ে ধরে উদ্যত ফণা সমেত মাথা। কামড়ে ওটাকে ছিঁড়ে ফেলে। সাপের নিশ্চল দেহ পড়ে থাকে সিঁড়িতে। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায় শিশু আহসান হাবীব।

তিন দিন পর কুকুরটির দেহে সাপের বিষক্রিয়া দেখা দিতে শুরু করে। নিস্তেজ হয়ে পড়তে থাকে ওটা। একপর্যায়ে শরীরে ঘা হয়ে যায়। তীব্র যন্ত্রণায় দিন-রাত কাতরাতে থাকে কুকুরটি। সপ্তাহ খানেক এ দৃশ্য দেখে আর সহ্য করতে পারলেন না ওসি ফয়জুর রহমান আহমেদ। নিজের ব্যক্তিগত বন্দুক দিয়ে গুলি করে মেরে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিলেন কুকুরটিকে। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন— ‘মৃত কুকুরটিকে মাটিচাপা দেয়ার পর তাঁর পিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, যে আমার পুত্রের জীবন রক্ষা করল, আমি তাকে নিজ হাতে হত্যা করলাম!’

এখানে হুমায়ূনের পিতার কোনো অপরাধ নেই। যদিও তিনি অপরাধবোধে তখন ভুগছিলেন। প্রিয় কুকুরটিকে অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতেই তিনি ওটাকে হত্যা করেছিলেন। এখানে যদি কেউ তার ‘অকৃতজ্ঞতা’ খুঁজতে যান, তাহলে ভুল করবেন। এক্ষেত্রে ওসি ফয়জুর রহমান আহমেদের সে সময়ের মানসিক অবস্থার বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারলেই আর কোনো সমস্যা থাকবে না।

মানুষ ও কুকুরের মধ্যে পার্থক্য আকাশ-পাতাল। আকৃতিগত পার্থক্য তো আছেই, জীবনাচারেও রয়েছে বিশাল ব্যবধান। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আর কুকুর পশুকুলের মধ্যে নিকৃষ্টদের অন্যতম। এখনো অনেকে কুকুর দেখলে ঘৃণায় রি রি করে ওঠেন। যদিও ইউরোপ-আমেরিকার সাহেব-মেমসাহেবরা অতিযত্নে কুকুর পুষে থাকেন।

সেই অবহেলিত ঘৃণিত কুকুরও অনেক সময় মানুষের জন্য শিক্ষা গ্রহণের প্রতীক হয়ে দাঁড়াতে পারে। মানুষ একে অপরকে ‘কুকুরছানা’ বা ‘কুত্তার বাচ্চা’ বলে গালি দিলেও অনেক সময়ই তারা কুকুরের মতো প্রভুভক্তি কিংবা দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে নিষ্ঠার পরিচয় দিতে পারে না। আমার প্রায় ছয় দশকের জীবনে বহু অকৃতজ্ঞ মানুষের দেখা পেয়েছি, যারা উপকারীর বা সাহায্য-সহায়তাকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন দূরে থাক, উল্টো তার ক্ষতি করতেও দ্বিধা করেনি। আর সেজন্যই বাংলা ভাষায় ‘কৃতঘ্ন’ (যে উপকারীর ক্ষতি করে) শব্দটির প্রচলন হয়েছে।

পারিবারিক কিংবা সমাজ জীবন তো বটেই, এমনকি রাজনৈতিক অঙ্গনেও এ ধরনের অকৃতজ্ঞ বা কৃতঘ্ন ব্যক্তির সন্ধান হরহামেশাই মেলে। যারা ব্যক্তিগত স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটায় কিংবা স্বার্থোদ্ধারের সম্ভাবনা নষ্ট হওয়ায় দীর্ঘদিনের লালন-পালনকারী দল বা নেতৃত্বকে এক লহমায় ত্যাগ করে চলে যায়। কথায় বলে চোখ উল্টানো। নির্দ্বিধায় অস্বীকার করে দল ও নেতৃত্বের সব অবদান।

এমন অনেক উদাহরণ আমাদের সামনে আছে যা দেখে বিস্মিত হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। দল ও নেতৃত্বের দেওয়া সব সুযোগ-সুবিধা চেটেপুটে ভোগ করে স্বার্থের কারণে ঘুরে দাঁড়ায় শানিত তরবারি নিয়ে দল ও নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। নিমগ্ন হন কীভাবে দল ও নেতৃত্বের ক্ষতিসাধন করা যায় সে চিন্তায়।

নবাব সিরাজউদ্দৌলা চলচ্চিত্রে নবাবরূপী অভিনেতা আনোয়ার হোসেনের একটি ডায়ালগ অনেকেরই মনে থাকার কথা। মীর জাফরের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন- ‘জনাব জাফর আলী খাঁ, আপনি শুধু সিপাহসালার নন, আপনি আমার আত্মীয়। বিপদের দিনে মেরুদণ্ড সোজা করে, শির উঁচিয়ে যে পাশে এসে দাঁড়ায়, সে-ই না পরম আত্মীয়।’ কিন্তু অনেক সময়ই আমরা দেখি তার বিপরীত চিত্র। স্বার্থ হাসিলের সময় যিনি আচরণ করেন পরমাত্মীয়ের, স্বার্থ ক্ষুণ্ন হলে তিনি বনে যান চরম দুশমন। নবাব সিরাজউদ্দৌলার আত্মীয় মীর জাফরও তার ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্যই নবাবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে দ্বিধা করেনি।

এটা নির্দ্বিধায়ই বলতে চাই— কুকুরের সঙ্গে কিছু কিছু মানুষের পার্থক্য এখানেই। কুকুর তার প্রভু বা উপকারী বন্ধুর বিপদের দিনে চুপচাপ বসে থাকে না, বিরুদ্ধাচরণ করে বিপদকে বাড়িয়ে তোলে না। বরং বিপদ থেকে বাঁচাতে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর অকৃতজ্ঞ মানুষেরা করে উল্টোটা। স্বার্থের জন্য উপকারী ব্যক্তিটির বুকে ছরি বসাতেও এরা দ্বিধা করে না। তবে প্রভু কিংবা উপকারী ব্যক্তিকে রক্ষার জন্য জীবন বাজি রেখে প্রতিরোধ লড়াই, এমনকি জীবনদানের ঘটনার নজির মানুষের মধ্যে নেই এটা বলা যাবে না।

কুকুরের প্রভুভক্তির আলোচনা করতে গিয়ে অনেক কথাই বলে ফেললাম। এতে কেউ কেউ রুষ্ট হতে পারেন, তাতে আপত্তির কিছু নেই। সব কথায় সবাই সন্তুষ্ট হবে এমন কোনো কথা নেই। আমরা মহান আল্লাহতায়ালার সৃষ্টির সেরা জীব। আমাদের বলা হয় আশরাফুল মাখলুকাত। সেই আমাদেরই মধ্য থেকে কিছু মানুষ যখন সৃষ্টির নিকৃষ্ট জীবের চেয়েও জঘন্য কাজে লিপ্ত হয়, তখন নিজে নিজেই লজ্জা পেতে হয়। ভাগ্যিস পশুপাখিরা কথা বলতে পারে না, আর আমরা ওদের ভাষা বুঝি না। তা না হলে যেসব ঘটনা কিছু মানুষ সমাজে ঘটায়, তাতে পশুপাখিরাও আমাদের নিন্দাবাদ দিত, উপহাস করত। হয়তো খারাপ উদাহরণের ক্ষেত্রে ‘মানুষ’ শব্দটি ব্যবহার করত!

 

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

e-mail: mohon91@yahoo.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads