• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
প্রবৃদ্ধি বাড়লেও কমছে না দারিদ্র্য

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

প্রবৃদ্ধি বাড়লেও কমছে না দারিদ্র্য

  • আবদুল হাই রঞ্জু
  • প্রকাশিত ০১ ডিসেম্বর ২০১৮

একসময় বলা হতো দু’মুঠো ভাত আর মোটা বস্ত্র হলেই যথেষ্ট। কারণ সে সময় এমন অভাব ছিল, দু’বেলা পেটপুরে খাওয়ারই কোনো সংগতি ছিল না। মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম নিয়ামক খাদ্যপ্রাপ্তিই ছিল বড় ধরনের সমস্যা। ব্রিটিশ বেনিয়াদের শোষণ-বঞ্চনা, তারপর পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠীর শোষণে নিষ্পেষিত বাঙালির হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও দু’বেলা খাবার জোটানো কঠিন ছিল। স্বপ্ন ছিল, দেশ স্বাধীন হলে বিদেশি শোষকগোষ্ঠীর শোষণ-বঞ্চনা বন্ধ হবে, অন্তত মানুষের খেয়েপরে বেঁচে থাকার গ্যারান্টি নিশ্চিত হবে। দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৬ বছর আগে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাত কোটি। আর সাত কোটি মানুষের খাদ্য সঙ্কট ছিল তীব্র। দেশের অধিকাংশ মানুষকে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাতে হতো। জরিপ অনুযায়ী, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ছিল মাত্র ১২৯ ডলার, যা গত ৪৬ বছরে হয়েছে এক হাজার ৭৫১ মার্কিন ডলার। এখন দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটির ওপর। দীর্ঘ সময়ে মানুষের জীবনমানের উন্নতি হয়েছে সত্য। সুযোগ-সুবিধাও বেড়েছে। তবু এখনো প্রায় চার কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। অধিকাংশ মানুষের ভাতের কষ্ট না থাকলেও অতিদরিদ্র মানুষের তিন বেলা খাবারের পূর্ণ গ্যারান্টি এখনো নিশ্চিত হয়নি। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে ১৯৭৪ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৮২ শতাংশ। আর সংস্থাটির সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুযায়ী, দেশে দারিদ্র্যের হার নেমে এসেছে ২৪ দশমিক ৩০ শতাংশে। গত ৪৬ বছরে দারিদ্র্যের হার ৫৮ শতাংশ কমলেও গরিব মানুষের সংখ্যা কমেছে মাত্র ২ কোটি ৩৯ লাখ। অতিসম্প্রতি পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনা কঠিন হবে আশঙ্কা করে বলেন, অর্থনৈতিক উন্নতির সুবাদে দেশের আর্থ-সামাজিক খাতে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও কিছু কিছু অঞ্চলে দরিদ্রতার হার এখনো বেশি। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে কুড়িগ্রাম জেলা। আর পরের জেলাটি হচ্ছে দিনাজপুর। অথচ এখন উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলাই খাদ্যভান্ডার হিসেবে খ্যাত।

দেশের মোট জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদার সিংহভাগ পূরণ হয় উত্তরাঞ্চলে উৎপাদিত ধান ও সবজি দিয়ে। এরপরও খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলাগুলোয় দারিদ্র্যের হার বেশি। মূলত কৃষিই উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতির মূল চাবিকাঠি। আর যার কারিগর হচ্ছেন কৃষক। সেই কৃষকের নিরন্তর চেষ্টায় বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা অনেকাংশেই নিশ্চিত হলেও মূলত উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্যের অভাবে কমবেশি প্রতিবছরই চাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ফলে ব্যাংকের ঋণ, এনজিও ঋণ কিংবা মহাজনী ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে ধারদেনা করে চাষাবাদ করেন। অতিকষ্টে সে চাষাবাদ করলেও বাড়তি ফলন হলেই কৃষকের কপাল পোড়ে। মূলত কৃষিপণ্যের উপযুক্ত মূল্যের অভাবেই প্রান্তিক চাষিরা গরিব থেকে আরো গরিব হচ্ছেন। পাশাপাশি কৃষি ছাড়া উত্তরাঞ্চলে শিল্প কলকারখানা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। ফলে কর্মসংস্থানের অভাবে কৃষি পরিবারগুলোর সক্ষম হাতগুলোকে অলস বসে থাকতে হয়। উত্তরাঞ্চলে যেমন শিল্প উপযোগী গ্যাসের সঞ্চালন লাইন নেই, আবার এসব অঞ্চলে শিল্প-কলকারখানা সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবেও স্থাপিত হয়নি। একমাত্র কৃষিভিত্তিক শিল্প হিসেবে হাসকিং মিল চাতাল শিল্প গড়ে উঠলেও সরকারি ভ্রান্তনীতি ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সে শিল্পও এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। অথচ এ শিল্পে নিয়োজিত লাখ লাখ নারী-পুরুষ শ্রমিকের কাজের সংস্থান হলেও তারা এখন বেকার। ফলে দরিদ্রতার পরিসংখ্যানে উত্তরাঞ্চলের নাম আগেই চলে আসবে, এটাই স্বাভাবিক।

দারিদ্র্যের অন্যতম আরেক কারণ হচ্ছে বৈষম্য। স্বাধীনতা-উত্তর গত ৪৬ বছরে বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বৈষম্য। বৈষম্যের কারণে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আর্থিক সচ্ছলতা কমতে কমতে তলানিতে চলে এসেছে। আর গুটিকতক মানুষ বিত্ত-বৈভবে সমৃদ্ধ হচ্ছে। অতিসম্প্রতি বিআইডিএসের গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বর্তমানে শীর্ষ ধনী ১০ শতাংশ মানুষের হাতে সম্পদ রয়েছে ৩৮ ভাগ। আর অবশিষ্টাংশ রয়েছে ৯০ শতাংশ মানুষের কাছে। ৯০ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৪ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। বাকি অংশ নানাভাবে আয় উপার্জন করে কোনো রকমে বেঁচে আছে। ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, ধনীদের সম্পদ বাড়লেও একই সময়ে দরিদ্র মানুষের সম্পদ অনেক নিচে নেমে এসেছে। ২০১০ সালে দরিদ্রতম মানুষের হাতে ২ শতাংশ সম্পদ থাকলেও বর্তমানে তাদের মালিকানায় আছে মাত্র ১ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতিনিয়তই দরিদ্র মানুষ আরো দরিদ্র হচ্ছে। দেশে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও দারিদ্র্য নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়— সম্পদের অভাব, সম্পদের উৎপাদনশীলতার অভাব, ব্যাংক ব্যবস্থায় গরিবদের অন্তর্ভুক্তির অভাবের দরুন দারিদ্র্য নিরসন যথাযথভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না। (সূত্র : দৈনিক বাংলাদেশের খবর, ১২ নভেম্বর ২০১৮)

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির গুণগত মান বেড়েছে কিন্তু সেটি খুবই কম। কারণ যে হারে বৈষম্য বেড়েছে, দারিদ্র্য হার সেভাবে কমেনি, আবার কর্মসংস্থানও বাড়েনি। এমনকি দারিদ্র্য নিরসনে সরকার স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তায় তুলনামূলক বিনিয়োগ বাড়ায়নি। আর বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়বে না, এটাই স্বাভাবিক। প্রতিবছর ২০ লাখ কর্মক্ষম মানুষ শ্রমবাজারে ঢোকার যোগ্যতা অর্জন করে। দেখা যায়, এর অর্ধেকেরও কর্মসংস্থান হয় না। ফলে দিন দিন দারিদ্র্যের হার কমার বদলে শুধুই বাড়ছে। এমতাবস্থায় জরুরি হচ্ছে, প্রবৃদ্ধির গুণগত মান ধরে রাখতে হলে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিনিয়োগ বাড়ানো। একমাত্র বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি সাধন করেই কর্মসংস্থানের দ্বারকে সম্প্রসারিত করা সম্ভব। আর তা করতে না পারলে আপেক্ষিক অর্থে হয়তো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চাকচিক্য দেখানো যাবে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দারিদ্র্য কমানো সম্ভব হবে না।

 

লেখক : সমাজকর্মী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads