• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
বেচাকেনার রাজনীতি

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

বেচাকেনার রাজনীতি

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ০৮ ডিসেম্বর ২০১৮

বিশিষ্ট লেখক ও রাজনৈতিক গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি তার এক লেখায় আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন কোষাধ্যক্ষ ইয়ার মোহাম্মদ খানের স্ত্রীর একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। তিনি লিখেছেন, আওয়ামী লীগকে নিয়ে একটি গবেষণা কাজের প্রয়োজনে কয়েক বছর আগে ইয়ার মোহাম্মদ খানের স্ত্রীর সঙ্গে খুলনায় তার বাড়িতে গিয়ে দেখা করে কথা বলেন। উল্লেখ্য, ইয়ার মোহাম্মদ খানের ঢাকায় অনেক বাড়ি ছিল এবং সেগুলোর একটি কারকুনবাড়ি লেনের (ঢাকা জজ কোর্টের উল্টোদিকে) বাড়িতে আওয়ামী লীগের প্রথম অফিস স্থাপন করা হয়। ইয়ার মোহাম্মদ খানের স্ত্রী মহিউদ্দিন আহমেদকে বলেছেন, ‘ইয়ার মোহাম্মদ খানের ঢাকায় অনেক বাড়ি ছিল। তিনি বাড়ি বেচেছেন আর রাজনীতি করেছেন। এখন তো মানুষ রাজনীতি বেচে বাড়ি করে।’ (প্রথম আলো, ২ ডিসেম্বর, ২০১৮)

বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান বাস্তবতায় কথাটি যে কতটা নির্মম সত্য তা বোধকরি বলার প্রয়োজন পড়ে না। রাজনীতিকে যে একশ্রেণির মানুষ অর্থ-বিত্ত কামাইয়ের অন্যতম মাধ্যমে পরিণত করেছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। দেশের কল্যাণ এবং জনসেবার উদ্দেশ্য নিয়ে এখন কতজন রাজনীতি করেন তা গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে। মুখে সবাই দেশ, জাতি আর মানবসেবার কথা বললেও কাজেকর্মে তার প্রমাণ পাওয়া যায় খুব কম। অথচ দেশ ও জনগণের কল্যাণে ভূমিকা রাখার সবচেয়ে ভালো মাধ্যমই হলো রাজনীতি। কিন্তু আজ তা কিছু লোকের আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষ এখন আর রাজনীতির প্রতি আগ্রহ দেখায় না। রাজনীতিকদের সম্মানের চোখে দেখে না। কারণ তারা দেখেছে যাকে সম্মান করেছে, শ্রদ্ধার চোখে দেখেছে, সময়ের ব্যবধানে বেরিয়ে এসেছে তার অপকর্মের নানান কাহিনী। সৎ, নির্লোভ, মানবপ্রেমী বলে সবাই যাকে জেনেছে, তিনি তার কোনোটাই নন। বরং তার বাইরের আবরণের ভেতরে বসবাস করে এক কুৎসিত মানুষ, যার চিন্তা-চেতনার কোথাও মানুষের কল্যাণচিন্তা নেই ।

রাজনীতি কোনো পেশা নয়, ব্রত। মানুষের সেবা করার জন্যই অনেকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। আমাদের এই উপমহাদেশে অনেক বরেণ্য রাজনীতিকের আবির্ভাব ঘটেছিল, যারা দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করার জন্যই রাজনীতিকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। আজ রাজনীতির ধরন এবং কায়দায় পরিবর্তন এসেছে। রাজনীতি এখন কারো কারো কাছে লাভজনক ব্যবসায়। বড় ধরনের বিনিয়োগ চলে এখানে। কেউ বিনিয়োগ করে সরাসরি, আবার কেউ করে পরোক্ষভাবে। আজকাল রাজনীতিতে বেচাকেনার যেন ধুম লেগেছে। একদিকে নেতাকর্মী বেচাকেনা হচ্ছে, অন্যদিকে চলছে দলের পদ-পদবি এবং নির্বাচনে মনোনয়ন বিক্রি। নীতি-আদর্শের বালাই নেই এই ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই বেচাকেনার হাট বেশ জমে উঠেছে। বেশকিছু রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন বিক্রির অভিযোগ উঠেছে প্রকাশ্যেই। এমনকি মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগে জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ কে এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরে যেতে হয়েছে তার পদ থেকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তিনি দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে প্রায় সত্তর কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। জাতীয় পার্টির নতুন মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেছেন, উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একটি দলের শীর্ষস্থানীয় একজন নেতার বিরুদ্ধে যখন এ ধরনের অভিযোগ ওঠে এবং তার ভিত্তিতে তাকে দলীয় পদ হারাতে হয়, তখন রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠাকে অসঙ্গত বলে মনে হয় না। শুধু জাতীয় পার্টি কেন, অন্য দুটি বড় দলও কি অভিযোগের বাইরে? বিএনপিতেও অভিযোগ উঠেছে মনোনয়ন বাণিজ্যের। দলটির কিছু নেতা কেন্দ্রীয় ও চেয়ারপারসনের অফিসে বসে এবার রমরমা মনোনয়ন বাণিজ্য করেছেন বলে শোনা যায়। পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মারফত তা অবগত হয়েছেন সবাই। এর ফলে দলটির দুঃসময়ের অনেক নেতা বঞ্চিত হয়েছেন মনোনয়ন থেকে। আবার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢেলেও অনেকে মনোনয়নের সোনার হরিণ ধরতে পারেননি। আওয়ামী লীগের ভেতরের খবর খুব একটা বাইরে আসেনি, কারণ দলটি ক্ষমতায় আছে। ফলে যা ঘটেছে, ভেতরে ঘটেছে; বাইরে তার প্রচার হয়নি। রাজনীতিতে এই যে বেচাকেনার ধারা চলছে, তা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে- এমন প্রশ্নের কোনো সোজাসাপ্টা জবাব হয়তো নেই। তবে একটি কথা স্বীকার্য যে, অবক্ষয়ের এই ধারা আমাদের রাজনীতিকে কলুষিতই করছে।

রাজনীতিকে যারা পণ্য বানিয়ে দেদারছে বাণিজ্য করছে, তারা কারা? তারা তো রাজনীতিরই লোক। অথচ এই রাজনীতি আমাদের দিয়েছে আত্মপরিচয়, দিয়েছে একটি স্বাধীন সার্বভৌম আবাসভূমি। আজ আমাদের যে উন্নতি-অগ্রগতি, তার পেছনে মূল ভূমিকা রাজনীতির। একসময় রাজনীতি ও রাজনীতির মানুষেরা সবার কাছে সম্মানীয় ছিলেন। কিন্তু কিছু বিপথগামী রাজনৈতিক নেতার কারণে গোটা রাজনীতিই আজ প্রশ্নবিদ্ধ। আর সেজন্যই আমরা যখন রাজনীতি বা রাজনৈতিক নেতাদের সমালোচনা করি, তখন এটা ভুলে যাই যে, দেশ ও জাতির জন্য সর্বস্ব খোয়ানো নেতার অভাবও আমাদের দেশে নেই। যারা সারা জীবন রাজনীতির জন্য উদারভাবে দিয়েছেন, বিনিময়ে পাননি বা নেননি কিছুই। তবে তাদের সংখ্যা অল্প। তারা আমাদের প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব, পথিকৃৎ।  ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে তাদের সম্পর্কে জানা যাবে।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে ক’জন রাজনীতিক শীর্ষস্থানীয় বলে গণ্য, তাদের মধ্যে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী অন্যতম। তিনি আজীবন কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের জন্য রাজনীতি করেছেন। যাপন করেছেন অত্যন্ত সাদামাটা জীবন। রাজনৈতিক ক্ষমতা, অর্থ-বিত্তের কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার ছিল না। বসবাস করে গেছেন কুঁড়েঘরে। তিনি রাজনীতিতে যেন দিতেই এসেছিলেন, নিতে নয়।  আমাদের সমকালীন রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক ও আলোচিত দুজন ব্যক্তিত্বের একজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অন্যজন জিয়াউর রহমান। একজন এসেছিলেন একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে রাজনীতির সন্তান হয়ে। অপরজনের আবির্ভাব ঘটেছিল বিশেষ পরিস্থিতিতে। তাদের মধ্যে ব্যবধান অনেক। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও জিয়াউর বহমানের তুলনামূলক আলোচনা করতে যাওয়া আমার বিবেচনায় মূর্খতা ভিন্ন কিছুই নয়। বঙ্গবন্ধু রাজনীতিকে ধ্যান-জ্ঞান মনে করে রাজনীতির মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। আর জিয়াউর রহমান দেশের এক সঙ্কটময় মুহূর্তে হাল ধরে সময় এবং সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সহজেই উঠে এসেছিলেন রাজনীতির পাদপ্রদীপের আলোয়। বঙ্গবন্ধুর যারা সমালোচক তারা বলে থাকেন, তিনি গণতন্ত্র হত্যা করে একদলীয় শাসন কায়েম করেছিলেন, তার আমলে সংঘটিত অপরাধ-দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছিলেন ইত্যাদি। আর জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধবাদীরা তাকে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেওয়া, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করার জন্য অভিযুক্ত করে থাকেন। এ সবই রাজনৈতিক অভিযোগ ও বিতর্কের বিষয়। তবে তাদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ বা সমালোচনাই থাকুক না কেন, ব্যক্তিগত জীবনে তারা ছিলেন প্রশ্নাতীতভাবে সৎ ও দুর্নীতির ঊর্ধ্বে। রাজনীতিকে ব্যবহার করে ব্যক্তিগত বিত্ত-বৈভব গড়ার কথা তারা কখনো ভাবেননি। 

তবে এটা ঠিক যে, শুধু আমাদের দেশের রাজনীতিকরাই দুর্নীতি করেন এমন নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজনীতিকদের দুর্নীতির খবর মাঝে মধ্যেই বিশ্ব মিডিয়ার অন্যতম খবর হয়ে আসে। অনেক দেশের মন্ত্রীদের দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে সরে যেতে বাধ্য হওয়ার নজিরের অভাব নেই। আবার আজীবন রাজনীতি করে রাজধানী বা দেশের কোনো বড় শহরে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে পারেননি এমন রাজনীতিকের উদাহরণও বিরল নয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। টানা বিশ বছর তিনি রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্কসবাদী), যেটাকে সংক্ষেপে সিপিএম বলা হয়, সে দলের নেতা ছিলেন তিনি। বিশ বছর রাজ্য সরকারের শীর্ষ পদে থাকলেও রাজধানী আগরতলায় একটি বাড়িও করতে পারেননি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজেপির কাছে হেরে যায় সিপিএম। মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে বিদায় নেন মানিক সরকার। ছেড়ে দিতে হয় সরকারি বাসভবন। শেষ পর্যন্ত তাকে সস্ত্রীক আশ্রয় নিতে হয় পার্টি অফিসে। আর তার সারা জীবনের সঞ্চিত সম্পদ কয়েক হাজার বই পাঠিয়ে দেন গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে। বর্তমানের এই দুর্নীতির জমানায় একজন মানিক সরকার দুর্লভ উদাহরণ বৈকি! যেখানে আমাদের দেশের মন্ত্রী-এমপিদের আশপাশে থাকা লোকজন বছর না ঘুরতেই বাড়ি গাড়ি নিদেনপক্ষে রাজধানী ঢাকায় একটি ফ্ল্যাটের মালিক বনে যান, সেখানে মানিক সরকারের মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকা বিস্ময়কর নয় কি?

হ্যাঁ, আমাদের কাছে তা বিস্ময়করই বটে! এমনকি অবিশ্বাস্যও। কারণ, আমরা যে উল্টোটা দেখে অভ্যস্ত। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এরাই আবার সততা, দুর্নীতি, নৈতিকতা সম্পর্কে জাতিকে জ্ঞান দেন, উপদেশবাণী শোনান। 

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আমাদের রাজনীতিকদের বিত্ত-বৈভবের কিছুটা বর্ণনা আমরা পেয়েছি। আমরা অবগত হয়েছি আমাদের নেতাদের সহায়-সম্পদের পরিমাণ সম্পর্কে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাত্রা যা-ই থাকুক না কেন, নেতাদের সম্পদের প্রবৃদ্ধির মাত্রা দেখে সবাই বিস্মিত হয়েছেন! গত দশ বা পাঁচ বছরে কারো কারো সম্পদ বেড়েছে দ্বিগুণ থেকে পাঁচগুণ পর্যন্ত! একই সঙ্গে বেড়েছে তাদের স্ত্রী-সন্তানদের সম্পদের পরিমাণ! এসবের পেছনে যে রাজনীতির বেচাকেনার ভূমিকা রয়েছে তা না বললেও চলে। সুতরাং রাজনীতির বেচাকেনা নিয়ে মরহুম ইয়ার মোহাম্মদ খানের স্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন, তার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে কি?

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads