• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

ভাসমান বেডে সৌর প্যানেল

সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

  • আবদুল হাই রঞ্জু
  • প্রকাশিত ১০ ডিসেম্বর ২০১৮

সভ্যতার বিকাশ, তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধন, মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে বিদ্যুতের চাহিদা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। অথচ চাহিদার তুলনায় কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্বব্যাংকের দেওয়া তথ্য মতে, ২০০৯ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ৪ হাজার মেগাওয়াট থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। যদিও সরকারের তরফে দাবি করা হচ্ছে, ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এখন উৎপাদন হচ্ছে। পরিমাণ কমবেশি যাই হোক না কেন, প্রকৃত অর্থে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের খাতকে যে অগ্রাধিকার দিয়েছে, তা স্বীকার করতেই হবে। সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লাভিত্তিক মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এসব প্রকল্পের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়েও চলছে। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে প্রকল্পগুলো চালু হলে হয়তো বিদ্যুৎ সঙ্কট থাকবে না। তবে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিরোধ ও পরিবেশগত কারণে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যায়ক্রমে বন্ধ করছে, তখন আমরা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথেই হাঁটা শুরু করেছি। যদিও বাংলাদেশে এখনো কার্বন নিঃসরণের মাত্রা উন্নত দেশগুলোর তুলনায় যৎসামান্যই, তবুও বাংলাদেশের পরিবেশ প্রকৃতিও ধীরে ধীরে উষ্ণ হয়ে উঠছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশও জলবায়ুজনিত অভিঘাত যেমন- অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, খরা, ঘূর্ণিঝড় কিংবা মাত্রাতিরিক্ত শীতের প্রকোপে জনজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে। এমনকি চাষাবাদের সঙ্কট, জীবনহানির মতো ঘটনা প্রায়শই লক্ষ করা যাচ্ছে। এমতাবস্থায় মানুষের বাসযোগ্য পৃথিবীর জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির পথেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে গুরুত্ব দিতে হবে।

সম্প্রতি ডেনমার্কের জ্বালানি খাত ব্যবস্থাপনা সহায়তা কর্মসূচির অর্থায়নে পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভাসমান সৌর প্যানেল ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। সৌরবিদ্যুৎ এখন গোটা বিশ্বেই অবদান রাখতে শুরু করেছে। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় ১৭৫ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে ভাসমান সৌর বিদ্যুৎ প্রযুক্তির যাত্রা শুরু। এরই মধ্যে চীনও সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের গুরুত্ব দিচ্ছে। বর্তমানে চীনের একটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র, চীনই নয়, এর বাইরে নরওয়ে, জাপান, মালদ্বীপ, ভারত, ইতালি, ইন্দোনেশিয়া, পর্তুগাল, মালয়েশিয়া, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া ও হংকংয়ের মতো দেশ ভাসমান প্রযুক্তিতে সৌরশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধারা অব্যাহত থাকলে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ৪ লাখ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। যেহেতু ছোট্ট ভূখণ্ডের বাংলাদেশে জনসংখ্যার আধিক্য বেশি এবং চরাঞ্চল ব্যতীত খোলা জায়গার পরিমাণও কম, সেহেতু সমুদ্র ও উপকূলীয় সুবিশাল স্থানে ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের দেশে উৎপাদিত মোট বিদ্যুতের ৬৬ শতাংশ আসে প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে। নতুন কোনো গ্যাস ফিন্ড আবিষ্কার না হলে আগামী ২০২০ সালের মধ্যে দেশের গ্যাসের মজুত শেষ হয়ে যাবে। এ অবস্থায় তরল জ্বালানি থেকে বিদ্যুতের উৎপাদন ৯ বছরে ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২২ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। আর নাবয়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আসছে মাত্র ৪৬১ মেগাওয়াট, যা মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্র দেড় শতাংশ। অবশ্য দেশের গ্রিড বহির্ভূত নিভৃত পল্লী কিংবা চরাঞ্চলে একমাত্র ভরসা সৌরবিদ্যুৎ। যে সৌরবিদ্যুতের ওপর ভর করে গুমোট অন্ধকারাচ্ছন্ন এলাকাগুলো রাত হলেই বিদ্যুতের আলোয় কিছুটা হলেও আলোকিত হয়। এখন শুধু গ্রামাঞ্চল কিংবা চরাঞ্চলই নয়, উপজেলা, মফস্বল শহর থেকে শুরু করে নগর মহানগরগুলোকেও সৌরবিদ্যুতের আওতায় আনতে হবে। তা না হলে প্রয়োজন অনুযায়ী বিদ্যুৎ প্রাপ্তি নিকট ভবিষ্যতে কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাংক ও এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক সহায়তায় সরকারের প্রতিষ্ঠান ইনফ্রাস্টাকচার ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড বা ইডকল দেশের ৪০ লাখ পরিবারে সৌর প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছে।

বিশ্বব্যাংকের উল্লিখিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ভূমি ব্যবহার করে সৌর ও বায়ু থেকে ৩ হাজার ৬৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির মতে, গোটা দেশের নগর-মহানগরের বহুতল ভবনের ছাদ ব্যবহার করে আরো ২ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভবপর হবে। এমনকি সৌরশক্তি ও বায়ু থেকে সব মিলে ৬ হাজার ২৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব বলে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। যেহেতু গ্যাস ফুরিয়ে আসছে এবং দেশে শিল্প কলকারখানা স্থাপন করতে হলে গ্যাসের প্রয়োজন পড়বে, সেহেতু নবায়নযোগ্য জ্বালানির পথেই আমাদেরকে এগুতে হবে। যদিও মেরিন ফিশারিজ একাডেমির ভিজিটিং লেকচারার সমুদ্রবিজ্ঞানী হাসিবুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, পর্যাপ্ত জমি না থাকায় বাংলাদেশে সৌরশক্তি ও বায়ুশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হবে না। তবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, বিশাল সমুদ্রসীমা সৌরবিদ্যুৎ ও বায়ু শক্তি উৎপাদনে সম্ভাবনার প্রতীক হয়ে উঠতে পারে। এমনকি বঙ্গোপসাগরে সোলার প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমে আগামীতে দেশের বিদ্যুতের চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ করা যেতে পারে। অবশ্য এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার আগে বড় ধরনের সমীক্ষা পরিচালনা প্রয়োজন বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

অবশ্য বাস্তব এ অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে সরকার ফেনীর সোনাগাজীর সৌরপার্কে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পে ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ (ইজিসিবি) মোট ৮ কোটি ৯৯ লাখ ডলার ব্যয় করবে। এ প্রকল্পের আওতায় ১৭০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। পুরো জমিতে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। আমরাও মনে করি, সৌরশক্তি ও বায়ুশক্তিতে কাজে লাগিয়ে গোটা দেশে পর্যায়ক্রমে চরাঞ্চলের পতিত জায়গায় সোলার প্যানেল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। অর্থাৎ পরিকল্পিতভাবেই নবায়নযোগ্য জ্বালানির খাতকে সমৃদ্ধ করতে পারলে অনেকাংশেই স্বল্প দরে ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

লেখক : সমাজকর্মী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads