• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের চেতনায় জেগে উঠুক বাংলাদেশ

সংগৃহীত ছবি

সম্পাদকীয়

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের চেতনায় জেগে উঠুক বাংলাদেশ

  • এ এইচ এম ফিরোজ আলী
  • প্রকাশিত ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮

আজ ১৪ ডিসেম্বর ৪৭তম শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। স্বাধীন বাঙালির জাতীয় জীবনে এক বেদনাবিধুর দিন। বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন দেশের খ্যাতিমান সম্পদ মুক্তচিন্তার উজ্জীবক, মানুষের অধিকারের প্রবক্তা। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যার কারণে বিজয়ের আনন্দ অনেকটা বিষাদে পরিণত হয়। বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর এ দিনটি আমাদের জাতির অস্তিত্বের চেতনায় নাড়া দেয়। বিজয়ের মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে পাক হানাদারদের দোসর আলবদর রাজাকার আলশামসদের সহায়তায় হত্যা করা হয় বুদ্ধিজীবীদের। তারা ছিলেন সুস্থ বিবেকের প্রতিভূ, পথপ্রদর্শক। বুদ্ধিজীবী হত্যা একদিকে বিশ্ব ইতিহাসের বর্বরতম জেনোসাইড, অপরদিকে বিবেক হত্যা। ম্লান হয়ে যায় চেঙ্গিস খান-নাদির শাহের নৃশংস ধ্বংসাভিযান ও নজিরবিহীন একমাত্র তুল্য নিদর্শন জার্মানিতে ইউরোপে নাজি হিটলার যা ঘটিয়েছিল। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ ১৪ ডিসেম্বরকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ঘোষণা করলে ’৭২ সাল থেকে এ দিবসটি পালন করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের তথ্যমতে, বুদ্ধিজীবী নিধন প্রক্রিয়া ’৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত থেকেই শুরু হয়েছিল। ১০ ডিসেম্বর থেকে ছিল হত্যার শেষ পর্ব বা সর্বশেষ প্রতিশোধ। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে পরাজয় অনিবার্য জেনে বাঙালি জাতিকে মেধা বিবেক ও মননশূন্য করে দেওয়ার নীল নকশা অনুসারেই এ বর্বর ও কলঙ্কময় নিধনযজ্ঞ। পাকিস্তানের অপশাসনের বিরুদ্ধে গণজাগরণ তৈরি করা ছিল বুদ্ধিজীবীদের মূল অপরাধ।

গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকে বাংলাদেশের নব-উন্মেষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির সবচেয়ে অগ্রসর অংশটি ছিলেন বুদ্ধিজীবীরা। পাকিস্তান যখন সৃৃষ্টি হয়, তখন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জিডিপি ও মাথা পিছু আয় ছিল প্রায় সমান। বস্তুত পূর্ব পাকিস্তানের জিডিপি পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় অনেকটা বেশি ছিল। ১৯৫০-৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান পাট রফতানি করে ৭৫ কোটি টাকা মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। সে সময় স্বর্ণের ভরি ছিল ৮০ টাকা। এই ৭৫ কোটি টাকা বর্তমান সময়ে অন্তত ১০ লাখ কোটি টাকারও বেশি হবে। ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় পশ্চিম পাকিস্তানের আয় থেকে ৭০ ভাগ কম ছিল। কারণ পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তর করা হয়েছিল। পাট আখ উৎপাদন হতো পূর্ব পাকিস্তানে। আর কাপড়ের কল ও চিনির কল স্থাপন করা হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানের শোষণের ওপর ভিত্তি করেই পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়েছিল। এজন্যই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার জন্য জীবন মরণ সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তান সর্বক্ষেত্রে আমাদের অবহেলিত রেখে ঘৃণার চোখে দেখত। তারা বাঙালিকে অমানুষ বলে বিবেচনা করত। বুদ্ধিজীবীরা তাদের লেখায়-ভাবনায়, চিন্তা-চেতনায় তুলে ধরেছেন সেসব ঘৃণ্য আচরণের তথ্য।

স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে প্রথম থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একক কেন্দ্রীয় ভূমিকা ছিল। যে কারণে পাকিস্তানি শাসকদের দৃষ্টিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল পাকিস্তানবিরোধী বিদ্রোহের মূল কেন্দ্র। পাকিস্তানিরা এ বিশ্ববিদ্যালয়কে পাকিস্তান রাষ্ট্রবিনাশী গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করত। যে কারণে ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ট্যাংক, কামান ও মেশিন গানের গোলায় ক্ষতবিক্ষত হয় প্রাচ্যের খ্যাত এ অক্সফোর্ড। প্রায় তিনশ ছাত্রী ও ৪৬ কর্মচারীকে হত্যা করা হয়। ২০০২ সালে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের তৎকালীন রিপোর্টে বলা হয়, রোকেয়া হলের একটি কক্ষে ছয় ছাত্রীকে ধর্ষণের পর সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়। রোকেয়া হলে ৩০ ছাত্রীকে ধর্ষণ করা হয় এবং ১১ নভেম্বর পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডন-এ সংবাদ প্রকাশ করে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি বইয়ের তথ্যমতে, ৯৫০ ছাত্রীকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার পর রোকেয়া হলে গণকবর খনন করে ২৫টি মাথার খুলি ও হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়। স্বাধীনতা পেলেও বাঙালি যাতে চিরতরে মেধাহীন পঙ্গু হয়ে যায়, ভিক্ষুক থাকে, সেই মনোবাসনা পূরণ করতেই বুদ্ধিজীবী হত্যা।

ইতিহাসের সাক্ষ্যমতে, ২৭ মার্চ ’৭১ কারফিউ শিথিলের পর গাড়ি নিয়ে ঢাকা ঘুরে বর্বরতার ঘটনা নিজে লিখেছিলেন গোলাম আযম। ৪ এপ্রিল তিনি সদলবলে সাক্ষাৎ করেন কসাই টিক্কা খানের সঙ্গে। তারপর গঠন করলেন তথাকথিত শান্তি কমিটি, সমর্থন জোগালেন রাজাকার বাহিনী ও গুপ্তঘাতক দল আলবদর বাহিনী গঠনে। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে রাও ফরমান আলীর সঙ্গে এক বৈঠকে বসে গোলাম আযম বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশা পেশ করেন। এরপর বিভিন্নভাবে দফায় দফায় হত্যা করা হয় দেশের বুদ্ধিজীবীদের।

১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর ঢাকাতেই ১ হাজার ১০০ বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের মধ্য উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. মুনীর চৌধুরী, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. আনোয়ার পাশা, ড. আবুল খায়ের, ড. সিরাজুল হক খান, ড. এ এন এম ফাইজুল মাহি, হুমায়ুন কবির, রাশিদুল হাসান, সাজিদুল হাসান, ফজলুর রহমান খান, এন এম মনিরুজ্জামান, এ মোক্তাদির শরাফত আলী, এ আর কে খাদেম, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্জ, এম এ সাদেক, এম সাদত আলী, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, গিয়াস উদ্দিন আহমদ, ডা. এম মর্তুজা, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. হাবিবুর রহমান, ড. সুখরঞ্জন সমাদ্দার, মীর আবদুল কাইয়ুম, ডা. ফজলে রাব্বি, ডা. আবদুল আলীম চৌধুরী, ডা. হুমায়ুন কবির চৌধুরী, ডা. আজহারুল হক, ডা. সোলায়মান খান, ডা. আয়েশা বদেরা চৌধুরী, ডা. কসির উদ্দিন তালুকদার, ডা. মনসুর আলী, ডা. মুহাম্মদ মোর্তুজা, ডা. মহিউদ্দিন খান, ডা. জাহাঙ্গীর, ডা. নুরুল ইসলাম, ডা. এস কে লালা, ডা. হেমচন্দ্র বসাক, ডা. ওবায়দুল হক, ডা. আসাদুল হক, ডা. মোসাব্বের আহমদ, ডা. আজহারুল হক, ডা. মোহাম্মদ শফি এবং সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, নিজাম উদ্দিন, সেলিনা পারভীন, সিরাজ উদ্দিন হোসেন, আ ন ম গোলাম মুস্তফা, গীতিকার ও সুরকার আলতাফ মাহমুদ, আইনজীবী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রণদা প্রসাদ সাহাসহ আরো অনেককে হত্যা করা হয়।

স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা হয়নি। হয়নি বিচার।

 

লেখক : কলামিস্ট

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads