• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
আশায় বসতি

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

আশায় বসতি

  • গোলাম কাদের
  • প্রকাশিত ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮

আগের দিনের প্রবাদ বাক্য ‘হারি জিতি নাহি লাজ’ এখন আর সমাজে দৃশ্যমান হয় না। এ সহনশীল কথাগুলো এখন যেন অচল মুদ্রা। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে এ ভাবনা শূন্যের কোঠায় বিরাজ করছে। সর্বত্রই একটি অস্থির অবস্থা, যেকোনো কিছুর বিনিময়ে জিত ছিনিয়ে আনতে হবে। সবার এ মনোভাব। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় শামিল।

ইশতেহার

জাতির সম্মুখে দুই বৃহৎ দল তাদের ইশতেহার নিয়ে হাজির হয়েছে। প্রতিশ্রুতির এ চমক দুই দল কারো চেয়ে কেউ কম যায় না। আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ ইশতেহারে স্থান পেয়েছে- ১ কোটি ২৮ লাখ লোকের কর্মসংস্থান, প্রতিটি উপজেলা থেকে ১০০০ জনকে বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, জঙ্গিবাদ, মাদক সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, ঢাকা ও বিভাগীয় শহরের মধ্যে বুলেট ট্রেন চালু, ১ বছরের নিচে ও ৬৫ বছরের উপরে সবাইকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা চালু, ২০২০ সালে সবার জন্য বিদ্যুৎ, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ। বিএনপির ইশতেহারে গুরুত্ব পেয়েছে- রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিম কোর্টে ন্যস্ত, র্যাবের বর্তমান কাঠামো পরিবর্তন, শর্তসাপেক্ষে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা থাকবে না, জাতীয় প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশ, বেকার ভাতা চালু, তরুণ দম্পতি ও উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ চালু। ‘রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা সুদৃঢ়’ করতে বিএনপি ১৯টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ইশতেহারে। আর আওয়ামী লীগ প্রধান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যিনি সব সময় দৃঢ়তার সঙ্গে বলতেন পরিণতি ভেবেই কাজ করি। তিনি ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার আহ্বান জানিয়ে ২১টি বিশেষ অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। জাতির নিকট ভুলভ্রান্তির ক্ষমা চাওয়া তার পিতার মতো তারও মহত্ত্ব ফুটে উঠেছে।

নিজের দোষত্রুটি ক্ষমা চাওয়া এক জিনিস আর ক্ষমা করা আরেক গুণ। ইসলামিক পরিভাষায় ‘ইহসান’ বা ক্ষমা। এ ক্ষমা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভেতর ছিল ভরপুর। তিনি অনেক ক্ষমা করেছেন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে। আমরা আশা করি আওয়ামী লীগ অবার ক্ষমতায় এলে ক্ষমা চাওয়া নয়, এ দরিদ্রতা যাতে না থাকে, ক্ষমা করার মহত্ত্ব নিয়ে যেন আবির্ভূত হয়। জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত নয়, ঐক্যবদ্ধ রাখেন। ইশতেহারে ঐক্যবদ্ধ জাতির আকাঙ্ক্ষা ফুটে ওঠা উচিত ছিল। ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে। দুইবার তিনবার চারবার, বারবার ক্ষমতায় থাকলে মানুষ ‘ধরাকে সরা’ জ্ঞান করে- তা থেকে দেশকে মুক্ত রাখার জন্য বিএনপির ইশতেহারে একটি ভালো দিক ক্ষমতার ভারসাম্য এবং দুইবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না।

বণিক বা ধনিক শ্রেণির রাষ্ট্র নয়, সাধারণ মানুষের কল্যাণ রাষ্ট্র ভাবনা বিএনপির ইশতেহারকে বাস্তব অধিক গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। আমরা এখন পদ্মা সেতুর সুফল পাইনি, মেট্রোরেল কাঙ্ক্ষিত সময়ে দেখতে পাইনি, রাজধানী রাস্তাঘাট এখনো চন্দ্রপৃষ্ঠের মতো। এরপরও আন্তর্জাতিকমানের আরো একটি এয়ারপোর্ট এবং বুলেট ট্রেন আগামী ৫ বছরে কল্পনা করা অসাধ্য সাধন করার শামিল। তারপরও বলব, বাঙালি তো অসাধ্য সাধন করার জন্যই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। স্বপ্ন দেখা এবং বাস্তবায়ন করায় আন্তরিকতা থাকলে সব সম্ভব।

বেগম রোকেয়া তার গ্রন্থ ‘সুলতানার স্বপ্ন’তে দেখিয়েছেন, চাঁদের মেয়েরা সূর্যের আলোয় রান্নাবান্না করছে। বহু যুগ পরে আমরা সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখছি- সোলার সিস্টেম। আজ আমরাই এবং পৃথিবীর মানুষ সোলার সিস্টেমে রান্নাবান্না, যাবতীয় যান্ত্রিক শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করছে। বিকল্প এই জ্বালানির স্বপ্ন তো বেগম রোকেয়া দেখিয়ে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব উন্নয়ন বাস্তবায়ন না করতে পারলেও তিনি তো পথ দেখিয়ে গেলেন। জয়তু শেখ হাসিনা।

নতুন ব্যাংক

আর্থিক খাতের ব্যাংকগুলো উজাড়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দিকনির্দেশনা না মানা এবং একের পর এক নতুন ব্যাংকের অনুমোদন। এ অনুমোদন দেওয়ার ফলে আর্থিক খাত ঝুঁকির মুখে পড়বে, এ চিন্তা থাকা সত্ত্বেও আরো একটি নির্বাচনী উৎসবকে সামনে রেখে নতুন নতুন ব্যাংকের অনুমোদন বিশেষজ্ঞরা মোটেই সুখকর ভাবতে পারছেন না। এই মুহূর্তে ব্যবসায়ীরা সরকারকে চাপে ফেলে নানা সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছেন কি? সাধু সাবধান!

প্রচার-প্রচারণা

প্রচার-প্রচারণায় সাংবাদিক, পত্রিকা, চ্যানেলগুলো বেশ জমকালো পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। বিশেষ করে টিভি চ্যানেলগুলো মাঠে ময়দানে, জনগণের দ্বারে দ্বারে ভোটপ্রার্থীদের মতো তারাও ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছু কিছু পক্ষপাতদুষ্ট রিপোর্টিং তো আছেই। আমরা দেখেছি নিউজের স্বার্থে অনেক ফুটেজ ব্যবহার করা হয় নিউজকে অর্থবহ ও সমৃদ্ধ করার জন্য, যেমন- সিএনএন, আলজাজিরা, বিবিসি, এনডিটিভি। পাকিস্তানের চ্যানেল তো একদম নিষিদ্ধ আমাদের দেশে।

সরকারকে কে কতটা তেল দিতে পারে সেরকমই স্থানীয় একটি আওয়ামী লীগপন্থি চ্যানেল সম্প্রতি নিউজের ফাঁকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্য দিয়ে ফুটেজসমৃদ্ধ নিউজ প্রচার করে। নিউজটি ভালো, অর্থাৎ বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতি, সমৃদ্ধি নিয়ে তারা কথা বলেছেন। এগুলো আওয়ামী লীগের, সরকারের পক্ষে ভালো যায়, তাই চ্যানেল কর্তৃপক্ষ প্রচার করেছে যেহেতু বাংলাদেশকে উন্নয়নের মডেল হিসেবে তারা দেখছে। ৪৭ বছরে তাদেরকে কীভাবে পেছনে ফেলে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। ভালো কথা। সারা পৃথিবী আমাদের উন্নয়নের কথা বলে। কিন্তু এই মুহূর্তে ভেতরে ভেতরে নিষিদ্ধ পাকিস্তানকে নানাভাবে প্রচারণায় নিয়ে আসা হচ্ছে। পাকিস্তান আমাদের ভালো বললেই কী না বললেই কী, তারা আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। আওয়ামী লীগের জন্য পাকিস্তান ভালো, বিএনপির জন্য খারাপ- এ মনোভাব ভালো না।

প্রচার-প্রচারণার কথা যেহেতু উঠেছে সব পক্ষকেই সমান সুযোগ দিতে হবে। সবাইকে গুরুত্ব দিতে হবে। মাঠে এক দল মার খাবে কেউ দেখবে না এ তো কল্যাণ রাষ্ট্রের ভাবনা হতে পারে না।

ইসি অনেক কিছু দেখেও না দেখার ভান করছে। ব্যারিস্টার খোকনের ওপর পুলিশি হামলা হয়েছে বেশ কয়েক দিন আগে। ইসি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সিইসি নুরুল হুদার নিকট তিনি যা বলেছে তা আবার হুবহু সাংবাদিকদের নিকট বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য পুলিশ প্রশাসন এবং বিচার বিভাগ একাকার হয়ে গেছে। যেটা তিনি সংবিধান পরিপন্থী বলে মনে করেন।

তিনি বলেন, এটা উচিত নয়। তিনি বলেন, আমার নির্বাচনী প্রচারণায় আওয়ামী লীগ কর্মী সমর্থকরা বাধা দেয়নি তাদের কোনো মিছিল ছিল না। আমার গণসংযোগের পেছনে পুলিশ ছিল, সামনেও ছিল। পুলিশসহ প্রশাসনেরই গণসংযোগের কথা অবহিত করা ছিল। একপর্যায়ে সোনাইমুড়ী থানার ওসির নেতৃত্বে পুলিশ সাধারণ মানুষের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। তিনি বলেন, আমি নিষেধ করে বলি- গুলি করছেন কেন? গুলি বন্ধ করুন। তারপরও ওসি সাহেব গুলি বন্ধ করলেন না। আমি বললাম, মানুষকে গুলি করবেন না, গুলি করলে আমাকে করুন। তখন তিনি আমাকে গুলি করলেন। গুলি আমার কণ্ঠনালিতে লাগে, রক্ত বেরুচ্ছিল। আমি বললাম, আপনি আমাকে গুলি করে দিলেন? তারপর তিনি আমাকে বললেন, আপনি ওদিকে যান। তার দেখানো দিকে যেতেই আমাকে সে পেছনের দিকে গুলি করলেন। মোট সাতটি গুলি আমার গায়ে লেগেছে পেছনে ৬টা সামনে ১টা।

তিনি সাংবাদিকদের আরো বলেন, সিইসিকে আমি বলেছি, পুলিশ কী বলল, না বলল- ডাজনট ম্যাটার। আমি একজন ল’ইয়ার, একজন ব্যারিস্টার। আমি বললাম, সেখানে কোনো আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী, মিছিল ছিল না, এই হলো ঘটনা। পরবর্তী সময় আমি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দেড় দুই ঘণ্টা পর পুলিশ প্রহরায় আওয়ামী লীগ কর্মীরা বিএনপি সমর্থিত লোকদের দোকানপাট, হাসপাতাল ভাঙচুর করে তারা ভিন্ন ভিন্ন স্টোরি তৈরি করেছে।

কমিশনকে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। তারা ব্যবস্থা নেবেন বলে বলেছেন। এরকম পুলিশি তাণ্ডব চললে সরকার যে অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু সুন্দর নির্বাচন করতে চায়, তা হবে না।

পুলিশ, প্রশাসন, ধনিক শ্রেণি সরকারের পেছনে যেভাবে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন মিরাকলি কিছু না ঘটলে সুন্দর নির্বাচন হবে না। সুন্দর নির্বাচনের যে পরিবেশ প্রয়োজন তা নেই। যে কয় দিন আছে সরকার, নির্বাচন কমিশন চেষ্টা করলে একটি সুশৃঙ্খল, সবার অংশগ্রহণমূলক ভালো নির্বাচন উপহার দেওয়া সম্ভব। সবার জন্য সমান সুযোগ যতটা পারা যায় নির্মোহভাবে দিতে পারলে জাতি একটি ভালো নির্বাচন আশা করতে পারে।

আশায় বসতি

শেষ মুহূর্তে এসে দেখা যাচ্ছে সমতার উন্নতি হচ্ছে। ইসির অভিযোগের পাহাড় থেকে রিটার্নিং অফিসারসহ চার ওসিকে প্রত্যাহার করেছে। ব্যারিস্টার খোকনের ওপর হামলাকারী ওসিকেও প্রত্যাহার করা হয়েছে। সম্ভবত ব্যারিস্টার খোকনের অভিযোগটি ইসি দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তি করল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে নামলে হয়তো আরো অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। বাঙালি জাতি নিরাশ জাতি নয়। আমরা আশাবাদী, আশায় আমাদের বসতি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads