• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
নিয়োগে বেকার নিবন্ধনধারীরা অসহায়

ছবি : বাংলাদেশের খবর

সম্পাদকীয়

নিয়োগে বেকার নিবন্ধনধারীরা অসহায়

  • সাধন সরকার
  • প্রকাশিত ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮

দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের উদ্দেশ্যে ‘এনটিআরসিএ’ (বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ) কর্তৃক অতিসম্প্রতি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ধরে ঝুলে থাকা নিয়োগপ্রত্যাশী নিবন্ধনধারীদের নিয়োগ প্রক্রিয়ার দ্বার খুলে গেল। প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষক (১-১৪তম নিবন্ধনের) নিয়োগের গণবিজ্ঞপ্তি দেখে নিবন্ধনধারীরা যতটা না খুশি হয়েছিলেন; তার চেয়ে দ্বিগুণ বেশি অসহায় হয়ে পড়েছেন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আবেদনের শর্ত দেখে (গত ১৯ ডিসেম্বর থেকে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আবেদন শুরু হয়েছে)। বলা হয়েছে, যিনি যে বিষয়ে এনটিআরসিএ’র নিবন্ধন সনদধারী তিনি e-Advertisement-এ প্রদর্শিত তার সংশ্লিষ্ট বিষয় বা বিষয়গুলোর বিপরীতে তালিকায় বর্ণিত সব প্রতিষ্ঠানের সব পদে আবেদন করতে পারবেন। সহজ কথায়, দেশের সব প্রতিষ্ঠানের  সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সব পদে আবেদনের প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছে। মানে যত খুশি তত আবেদন! আবেদনে কোনো উপজেলা, জেলাভিত্তিক কোনো নিয়োগের কথা বলা হয়নি। সব নিবন্ধনধারী শূন্য পদ সাপেক্ষে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে পারবে। এতে করে নিয়োগ পেতে প্রত্যেক নিয়োগপ্রার্থীর প্রতিষ্ঠান ভেদে ধারণাভিত্তিক (ধারণা করে আবেদন করতে হবে, কেননা কেউ জানে না তার কোন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ হবে) আবেদন করতে হাজার হাজার টাকা খরচ হবে! উদাহরণস্বরূপ, সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে একজন কলেজ নিবন্ধনধারীর মেধা তালিকায় সিরিয়াল হলো ১৯৩। ধরলাম, সারা দেশের বেসরকারি কলেজগুলোয় সমাজবিজ্ঞানে শূন্য পদ আছে ২০২টি। তাহলে নিয়োগ নিশ্চিত করার জন্য তাকে কতটি পদে আবেদন করতে হবে চিন্তা করা যায় (সাধারণভাবে যেখানে একটি আবেদন করলে তার হয়ে যেত, সেখানে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক আবেদনে অসংখ্য আবেদন না করলে তার নিয়োগের নিশ্চয়তা থাকবে না)! সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ের নিয়োগপ্রত্যাশী প্রায় প্রত্যেক স্কুল-কলেজ নিবন্ধনধারীকে প্রত্যেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে ১৮০ টাকা ফি দিতে হবে। ফলে এনটিআরসিএ’র এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার ফাঁদে পড়ে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে নিয়োগপ্রত্যাশীদের হাজার হাজার টাকা ফি দিতে হবে। ধরলাম, স্কুল-কলেজের আলাদা আলাদা নিবন্ধনে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের মেধা তালিকায় অনেকের সিরিয়াল ২৫০, ৩০০, ৪০০, ৫০০, ৬০০, ...। অথচ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পদ শূন্য আছে ধরলাম প্রায় ২৯০টি। তাহলে নিয়োগ পেতে প্রত্যেককে কতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে হবে? আবার প্রতিষ্ঠানভিত্তিক আবেদনে দেখা যাবে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে অনেকে ৬০ নম্বর পেয়ে নিয়োগ পেয়ে গেছেন, অপরদিকে কোনো প্রতিষ্ঠানে ৮০ পেয়েও নিয়োগ পেতে পারেননি (কেননা সবাই সব কলেজে আবেদন নাও করতে পারে!) তাহলে জাতীয় মেধা তালিকা সঠিক মূল্যায়ন হলো কি ? শুধু নিয়োগ প্রক্রিয়াকে সম্বল করে প্রায় ৫ লক্ষের বেশি বেকার নিবন্ধনধারীর প্রতি এনটিআরসিএ’র এই ‘পকেট কাটার’ প্রক্রিয়া বন্ধ করা উচিত। নিবন্ধনধারীরা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক আবেদন চায় না। তারা বিষয়ভিত্তিক একটি আবেদনের মাধ্যমে মেধা তালিকা অনুযায়ী নিয়োগ চায়। প্রশ্ন হলো, মেধা তালিকা অনুযায়ী উপজেলা, জেলা কিংবা বিভাগ অনুযায়ী নিয়োগের ব্যবস্থা করা কি যেত না? নিয়োগ পেতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কেন আবেদন করতে হবে? প্রতিষ্ঠানভিত্তিক এমন নিয়োগ প্রক্রিয়া বাংলাদেশে তো বটেই বিশ্বের আর কোনো দেশে আছে কিনা সন্দেহ! যদিও এনটিআরসিএ ২০১৬ সালে একই প্রক্রিয়ায় শিক্ষক নিয়োগ শুরু করেছিল। সে সময়ও লক্ষ লক্ষ নিবন্ধিত চাকরিপ্রার্থী একইভাবে হয়রানির শিকার হয়েছিলেন তথা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক আবেদনে বেকারদের ‘পকেট কাটা’ হয়েছিল। কেননা হাজার হাজার টাকা খরচ করে বহু প্রতিষ্ঠানে আবেদন করলেও খুব কম চাকরিপ্রার্থীর চাকরি হয়েছিল।

অন্য আর একটি সমস্যা হলো, আবেদনে নতুন শর্ত হিসেবে ৩৫ প্লাস বয়সধারীদের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। এতে করে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রার্থী এবারের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আবেদন করতে পারছে না। তাদের দোষটা কী? যখন চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল তখন তো নির্দিষ্ট বয়সের কথা বলা হয়নি। বাদ পড়া অনেকের শিক্ষাজীবনে চারটিতে প্রথম শ্রেণি আছে। আবার স্কুল-কলেজের নিবন্ধনে বাদ পড়া অনেকের মেধা তালিকা প্রথম সারির দিকে (২য়, তয়, ৬ষ্ঠ, ... )। তাদেরকে যদি সদ্য নীতিমালার বেড়াজালে আটকিয়ে বাদ দেওয়া হয় তাহলে এ দুঃখ তারা কোথায় রাখবে? নিবন্ধনধারীদের কে কোথায় কবে নিয়োগ পাবে তাও অজানা। হাজার হাজার টাকা খরচ করে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক আবেদন করলেও যে চাকরির নিশ্চয়তা থাকবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কেননা নিয়োগের আবেদনে বলা হয়েছে, মামলা বা আইনগত কোনো কারণে অনলাইনে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি-এর কোনো পদে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব না হলে তার জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। এনটিআরসিএ’র একেক সময়ের খামখেয়ালিপূর্ণ সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে মহামান্য হাইকোর্টে বহু রিট হয়েছে (প্রায় ১৬৬টির মতো)। অনেক রিট এখনো চলমান। এরই মধ্যে হাইকোর্ট ১২ ও ১৩তম নিবন্ধনধারীদের একক নিয়োগ দিতে রায় দিয়েছেন। ৩৫ প্লাস বয়সধারীরাও হাইকোর্টে রিট করেছে। প্রশ্ন হলো, হাইকোর্টের নির্দেশনা মানতে সমস্যা কোথায়? চলমান এত সমস্যার কারণে যদি চলতি নিয়োগ প্রক্রিয়া সমস্যার সম্মুখীন হয় তাহলে এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষ তখন কী বলবে? বেকার নিবন্ধনধারীদের আবেদনের কষ্টের হাজার হাজার টাকা কি ফেরত দেবে? আর যত শর্তই থাকুক না কেন তা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শুরুতে আবেদনকারীকে জানানোর কথা। তা না করে বেকার নিবন্ধনকারীদের নিয়োগ প্রক্রিয়াকে সম্বল করে নিয়োগের আগ মুহূর্তে এসে বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দিয়ে নিয়োগপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়াসহ বিভিন্ন হয়রানি করা হবে- এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। এনটিআরসিএ’র কর্তৃপক্ষের প্রতি আকুল আবেদন, প্রতিষ্ঠানভিত্তিক আবেদনে এভাবে অসহায় বেকারদের পকেট কাটবেন না। নিবন্ধিতদের লটারির মতো করে ভাগ্য নির্ধারণ করবেন না। তাই চলমান নিয়োগ প্রক্রিয়া সংশোধন করে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক নয়, বিষয়ভিত্তিক একটি আবেদনের ভিত্তিতে মেধা তালিকা অনুসারে অতি দ্রুত নিয়োগের ব্যবস্থা করা হোক।   

লেখক : সাবেক ছাত্র, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads