• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মধ্যে যাতে ফারাক না থাকে

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মধ্যে যাতে ফারাক না থাকে

  • গোলাম কাদের
  • প্রকাশিত ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮

এ লেখাটি যখন ছাপা হবে, তখন সবাই সারিবদ্ধভাবে, সুশৃঙ্খলভাবে, সভ্য জাতি হিসেবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। উল্লেখ থাকে যে, এবার নতুন ভোটারের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। নবীন প্রাণের উল্লাসে তারা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার জন্য মুখিয়ে আছে। আর এ ভোটই যে কোনো দলের কপাল ফিরিয়ে দিতে পারে।

শান্তিপ্রিয় বাঙালি জাতি সব সময়, বিশেষ করে জাতির ক্রান্তিকালে সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে না। এবারো মহাজোট, ঐক্যফ্রন্ট বা মূল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি শেষপর্যন্ত মাঠে থাকার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। এবার মাঠ ত্যাগের বহু আলামত থাকা সত্ত্বেও বা রণে ভঙ্গ দেওয়ার বহু আলামত দৃশ্যমান থাকা সত্ত্বেও কেউ মাঠ ছাড়ছে না এটা জাতির জন্য একটি ভালো দিক। বিনা চ্যালেঞ্জে ‘কেউ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান’- প্রতিযোগিতার নিয়মনীতি মেনেই এগুচ্ছে। তারপরও ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’ জাতীয় প্রবাদ বাক্য এখনো বিদ্যমান। প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনী নিরন্তর ক্ষমতাসীনদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় নানান কথা উঠেছে। লেভেল প্লেয়িং নিয়ে কথা উঠেছে। শোনার কেউ যেন নেই। সর্বত্রই যাদের কাছে বিচার চাওয়া হচ্ছে, তারা সবাই যেন সিন্দাবাদের গল্পের একচুক্ষ দানবের ভূমিকায় অবতীর্ণ।

মামলা হামলা ভাঙচুর খুনখারাবি প্রতিকারহীনভাবে চলছে। নির্বাচন বাংলাদেশে উৎসবের আমেজে থাকে, সারা দেশ সেখানে শঙ্কা ও ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়ানোর, যখন তখন গ্রেফতারের মহড়া চলছে। যে কোনো সময়ের চেয়ে এ আতঙ্ক বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। মাঠের এই অস্থিরতা, নির্বাচনী সময়ের এই চূড়ান্ত অস্থিরতা, অধৈর্য ও শঙ্কা প্রকাশ পেয়েছে সিইসি ও ঐক্যফ্রন্টের ড. কামাল হোসেনের বিতণ্ডার মাধ্যমে। কোনো সভা-সমাবেশ বা মাঠ গরম করা বক্তৃতায় নয়, খোদ নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে এবং সেখানে ধৈর্যচ্যুতি ঘটিয়ে দুজনই চরম ভব্যতাবর্জিত কথা কাটাকাটি করেছেন যা শিষ্টাচারবহির্ভূত। এতদিন দেখেছি একজন মাহবুব তালুকদার বিবেকের কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত ছিলেন। এখন খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার উল্টো আচরণ করে বসলেন একজন বর্ষীয়ান নেতাকে- তিনি কী হয়ে গেছেন জাতীয় কথাবার্তা বলেছেন। ড. কামাল হোসেনও ধৈর্যধারণ করতে পারেননি। তিনি পুলিশকে জানোয়ার, লাঠিয়াল বাহিনী বলেছেন, তিনি কিছুদিন আগে সাংবাদিকদের ‘খামোশ’ বলেছেন। মওলানা ভাসানীর বিখ্যাত সেই ‘খামোশ’ শব্দের যথাযথ ব্যবহার করতে পারেননি তিনি। বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশন থেকে বেরিয়ে ড. কামাল সিইসির পদত্যাগ চেয়েছেন। আবার ওবায়দুল কাদের ড. কামাল হোসেনের পদত্যাগ চেয়েছেন। এরকম বাহাসের মধ্যেই শেষ পর্যন্ত সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হচ্ছে। আশা করছি ক্ষমতার রাজনীতিতে এবার ভারসাম্যের রাজনীতি ফিরে আসবে।

যদিও মাহবুব তালুকদার ভোটের দু’দিন আগে বলেছেন, নির্বাচন ও সন্ত্রাস একসঙ্গে চলতে পারে না। ভোটের মাঠে সহিংসতা ও সন্ত্রাসের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ‘অনভিপ্রেত আচরণ’ না করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও সন্ত্রাসের ঘটনায় আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। নির্বাচন ও সন্ত্রাস একসঙ্গে চলতে পারে না। বুধবার নির্বাচন ভবনে নিজ কার্যালয়ে লিখিত বার্তায় তিনি এসব কথা বলেন।

তিনি আরো বলেন, স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর একটি সহিংসতামুক্ত পরিবেশে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন না করতে পারলে এ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে। আমরা তা হতে দিতে পারি না। তিনি বলেন, নির্বাচন কেবল অংশগ্রহণমূলক হলে হয় না, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও আইনানুগ হতে হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পোশাকের মর্যাদা ও পবিত্রতা রক্ষার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সদস্যদের বলছি— অতিউৎসাহী হয়ে কোনো অনভিপ্রেত আচরণ করবেন না। আপনারা নির্বাচনে সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি। প্রত্যেকের প্রতি সম-আচরণ ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন আপনাদের কর্তব্য। নির্বাচনে পক্ষপাতমূলক আচরণ থেকে বিরত থাকুন। নিজের পোশাকের মর্যাদা ও পবিত্রতা রক্ষা করুন।

তিনি রিটার্নিং অফিসারসহ নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট অন্য কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘জাতির ক্রান্তিকালে আপনারা এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করছেন। বিবেক সমুন্নত রেখে অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সাহসিকতার সঙ্গে আইন অনুযায়ী নিজেদের দায়িত্ব পালন করুন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণে আপনাদের অবদান জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে। কোনো কলুষিত নির্বাচনের দায় জাতি বহন করতে পারে না। ভোটারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ভোটারদের বলতে চাই- নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে আসুন। আপনার ইচ্ছানুযায়ী প্রার্থীকে ভোট দিন। ভয়ভীতি বা প্রলোভনের কাছে নতিস্বীকার করবেন না। আপনার একটি ভোট গণতন্ত্রকে রক্ষা করবে মনে রাখবেন। এবারের নির্বাচন আমাদের আত্মসম্মান সমুন্নত রাখার নির্বাচন। এবারের নির্বাচন আগামী প্রজন্ম ও আপনাদের স্বপ্নের সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণের নির্বাচন।’

উপরোক্ত বক্তব্য ও আলোচনা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পক্ষে হলে ভালো হতো। নির্বাচন কমিশন, কমিশনার তাদের আচরণ নিয়ে এখন নানা মুখরোচক আলোচনার জন্ম দিচ্ছে। অতএব অনেকেই মনে করেন, তাদের দ্বারা ভালো কিছু আশা করা যায় না।

তারপরও নির্বাচন বলে কথা। জাতির ভাগ্য সুপ্রসন্নের এই ডামাডোলে অবশ্যই আমরা একটি ভালো নির্বাচন নিয়ে ঘরে ফিরব। ভারসাম্যের একটি সরকার গঠন হবে। জাতি প্রত্যাশিত ফলাফল পেয়ে গণতন্ত্র, সুশাসন, সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন নিশ্চিত করে বিজয়ে উল্লাস করবে। যেখানে থাকবে না হামলা, মামলা, চাপাতির কোপ, ভাঙচুর, অগ্নিসন্ত্রাস। থাকবে আনন্দ মিছিল, পরস্পরের প্রতি ভ্রাতৃপ্রতিম অনুরাগ, শান্তি ও সমৃদ্ধির কর্মপরিবেশ, কথায় কথায় কারো প্রতি বিষোদ্গার নয়। আমরা এগিয়ে যাব ঐক্যবদ্ধভাবে।

নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা আমাদের দেশের একটি খারাপ আচরণ। এটি যেন কোনো দলই সমর্থন না করে। উসকে না দেন। উসকানিমূলক বক্তব্য যেন না দেন।

এ ব্যাপারে দল, সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক অবস্থানে কয়েকদিন যেন মাঠে থাকে। আমাদের দেশে ‘ভয়ঙ্কর বিজয়’ অনেক সময় ভয়ঙ্কর সব কর্মকাণ্ডের জন্ম দেয়। অতীতের সেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের এগুতে হবে।

আরেকটি বিষয় খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে, তা হলো গুজব। নির্বাচনের আগে-পরে গুজবের অনেক ডালপালা ছড়াবে, তা থেকে সতর্ক থাকতে হবে। অতীতে দেখা গেছে, গুজবের কারণে অনেক হতাহত ও জাতীয় ক্ষতি হয়ে গেছে। সব পক্ষকে গুজব থেকে দূরে থাকতে হবে। অনেক নেতা-নেত্রীর মুখ থেকে গুজব ছড়ায়। তাদের মুখ তখন গুজবের প্রেস হয়ে যায়। কিছু গুজব আয়োজনের প্রস্তুতি ছাড়াচ্ছে, যেমন— ‘গোপন ব্যালট পেপার ছাপা হচ্ছে’, ‘টাকা ছড়ানো হচ্ছে’, ‘অমুক টাকা দিতে গিয়ে ধাওয়া খেয়েছে’, ‘অমুক নেতাকে আটকে রেখেছে’।  আমরা এখন ডিজিটাল যুগে আছি। এ সময় গুজব আরো দ্রুত ছড়ায়। এগুলোতে লাইক, শেয়ার, কমেন্ট করা যাবে না। তবে হ্যাঁ, ভিডিও ফুটেজ তো আর মিথ্যা হবে না। একতরফা যাতে কিছু না হয়, সে খেয়াল রাখতে হবে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন জাতির ভাগ্য উন্নয়নের নির্বাচন। সবাই একযোগে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে যার যার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার এ উৎসব যাতে আনন্দের হয়, সেদিকে সবাই খেয়াল রাখবেন। এ চাওয়া সবার। আমরা চাই একটি ভারসাম্যমূলক সরকার, যারা সর্বস্তরের মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে পারবে। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মধ্যে যাতে ফারাক না থাকে।

লেখক : সাংবাদিক ও বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads