• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
নতুন বছরে নতুন সরকার

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

নতুন বছরে নতুন সরকার

  • শহীদ ইকবাল
  • প্রকাশিত ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮

২০১৮ শেষ হওয়ার পথে। কালপরিক্রমায় তা নতুন কিছু নয়। শিগগিরই ২০১৯-এ পৌঁছাবে পৃথিবীর সব মানুষ। কোনো সাল-তারিখ চলে যাওয়া, এগিয়ে আসা, প্রকৃত অর্থে এ মানুষেরই ‘টাইম মেশিন’। মানুষই গ্রহাণুপুঞ্জের নক্ষত্ররাজির জন্ম-মৃত্যু-বয়স অনুসন্ধান করে। সেগুলোকে নতুন-পুরাতনরূপে বিশিষ্টার্থ করে তোলে। কিন্তু এর বাইরেও কথা আছে। কথাটি হচ্ছে, সভ্যতা, দেশ ও মানুষের জন্ম-মৃত্যু-বার্ধক্য-বৃদ্ধিরও পরিগণনা আছে। ফলে আমরা মনে রাখি, শেকসপিয়র কিংবা সক্রেটিস কোনো একসময় ছিলেন। তারা মহত্তর মানুষ। তাদের দেশটা অমন ছিল। সেই দেশে-সমাজ মানুষ ছিল। তারা এমন ছিলেন। এমন সময়গণনার সূত্রেই তা সম্ভব। এই সম্ভব ধরে জীবনের ধারা প্রবাহিত। জীবনের সত্যও তাতে নিহিত। এখন প্রতীক্ষিত নির্বাচন শেষ। ফল গণনাও সম্পন্ন। নতুন সরকার গঠনের পালা, তোড়জোড় শুরু হবে। নতুন বছরে সেটি নতুন অর্থবাহী। আমাদের দেশে রাজনীতিটা যেহেতু সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর নয়, ফলে এ নিয়ে নানা হিসাব-নিকাশ শুরু হবে। কিন্তু যেটাই হোক, সর্বৈব মানুষের জন্য ভালো কিছু ভাবতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। তাই নিয়ে এ নতুন বছরের এই নতুন মর্মার্থ। তবুও বলি, কী সে নতুন অর্থ? নির্বাচনী ইশতেহারে তো অনেক কথা ছিল। সেখানে প্রতিশ্রুতির শেষ নেই। অবশ্য এসব নিয়ে রাজনীতিও আছে। ভোটারদের মন জয় করতে কত কিছুই তো করতে হয়। প্রাপ্তিসুখের কিছু ইস্যু, মন জোগানো আকর্ষক কিছু বিষয় সবাই তো সামনে আনেন। সামনে আনলে ভোটারদের ফেস করাটা সহজ হয়। এই সহজ পথটাকে আরো অধিক দূরে নিয়ে যেতে চান তারা— তাতে বোধ করি সহজও হয়; নিশ্চিত হতে চান পার্টির কর্ণধাররা। কিন্তু এটা কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব? কীভাবে তা সম্ভব। নতুন বছরে নিশ্চয়ই পুরনো বছরের কথাগুলো আবার আসবে। সেটি প্রতিবছরের মতো এবারও গৎবাঁধা হবে না। কারণ, অনেক প্রতীক্ষার বছর এটি। নতুন সরকারের জন্যও অনেক কিছু গুছিয়ে ওঠার সময় এখন, অন্তত এ বছর। ফলে তাৎপর্যপূর্ণ হোক এ সূর্যোদয়, সেটাই প্রত্যাশা। আগাম কিছু না বলাই ভালো। তবে শুধু দেশের জন্যই নয় গোটা বিশ্বে এ বছরটা আরও প্রতীক্ষাশীল, এবং প্রত্যাশাপূর্ণ বলতে হবে। প্রতিশোধের বা উগ্রতার বিপরীতে এ প্রত্যাশা কতটুকু বাস্তব? বা কতটুকু সাফল্যের মুখ দেখবে? বা আদৌ কী তা সম্ভব? কতটা সম্ভব? ইতোমধ্যে আমরা জানি ডোনাল্ড ট্রাম্প তার শাসনকার্যে একপ্রকার ভজঘট অবস্থা করে ফেলেছেন। অনেকেই বলছেন, খুব সহজে এর সমাধান হচ্ছে না। ইউএস প্রশাসনে এরকম জীর্ণ দশা হলে তার প্রভাব বিশ্বের নানা দেশে পড়ে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে বা উত্তর আমেরিকার ও মধ্য আমেরিকায় তো বটেই। ওদিকে উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়া সম্পর্ক, চীন-মার্কিন সম্পর্ক, সোভিয়েত রাশিয়ার আর্থ-সামাজিক অবস্থা সবটাই স্বাভাবিক রূপে এখন আর আগের মতো নেই। জাতিগত, ধর্মগত, বর্ণগত সহিংসতা ক্রমাগত বাড়ছে। উগ্রতা এখন চরমে। সে উগ্রতা রাষ্ট্রীয়ভাবে রসদও পায় মাঝেমধ্যে। আমাদের উপমহাদেশের ‘মুরুব্বি’ ভারত সেও যে ভালো আছে তা বলা যাবে না। একদম ভালো নেই। উগ্রতার চরম বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যাচ্ছে। বস্তুত, বাংলাদেশও যে ভালো তাও কি বলা যাবে! বিশেষ করে রোহিঙ্গা সঙ্কট ‘বিষফোঁড়া’ এখনো। এর ফল সুবিধাজনক মনে হয় না। তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট যে নেই তা বলা যাবে না। সাম্প্রতিক নির্বাচন কিন্তু কিছু ইঙ্গিত দিয়ে গেছে। এর পরিণতি ও ফল নিয়ে সদ্য ক্ষমতাসীনদের ভাবতে হবে। নতুন সরকারকে এখন নানাভাবে নতুন কিছু মোকাবেলা করতে হতে পারে। বিশেষ করে এজন্য কৌশলগত পরিবর্তন তো অবশ্যই দরকার। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় বা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক সচেতন হতে হবে। কৌশলগত হওয়া তো বটেই। কারণ, সমস্যাগুলো এখন গতানুগতিক নয় যেমন, তেমনি তা মোকাবেলায় পূর্বের গতানুগতিক পন্থা অবলম্বন করে চললেও হবে না। সবকিছুর ভেতরেই ঝুঁকি আছে, আর এ ঝুঁকি শুধু আঞ্চলিক নয়, বৈশ্বিকও বটে। নতুন বছরের সময়সূচিতে সম্ভাব্য কিছু না দেখে আপাতত সামনের দিনগুলোর সতর্কতার কথাই এখন বলতে চাইছি।

২০১৯-এ বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের আশা ও বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা প্রবলভাবে জেঁকে বসবে। হ্যাঁ, এটা কী আগে ছিল না? ছিল। কিন্তু এখন আর্থ-সামাজিক যে কাঠামো, তার ভেতরেই এ বদলটির ইঙ্গিতটি লক্ষ করা যাচ্ছে। গ্রামগঞ্জে প্রতিটি মানুষের মধ্যে ‘আলাদা’ হবার প্রবণতা বেড়েছে। প্রথমে ব্যক্তিতে, পরে পরিবারে, তারও পরে সমাজে। এই ব্যক্তি-পরিবার-সমাজের যে আলাদা রূপ, তাতে করে নিজস্বতা, প্রভাব, ক্ষমতা, লোক দেখানো প্রবণতা, ফ্যাশনসর্বস্বতা তীব্রভাবেই বেড়েছে, এবং তা আরো বাড়বে। এই বাড়ার ভেতরে অধিক বিচ্ছিন্নতাও তৈরি হবে। কারণ, ইন্টারনেট যোগাযোগ ও ভুঁইফোঁড় কিছু উঠকো অনুষঙ্গের তীব্রতা অধিক হবে। এতে সামাজিক রেশারেশি বাড়বে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রদাহ থাকবে। সমাজে অসাম্য বিরাজ করলে তা তো হবেই। হয়ও। কার্যত, সমাজের লাগামটা টেনে ধরে যে চলতি মূল্যবোধ সেটা বিগত সময়ে ভালোরূপে দাঁড়ায়নি। কারণ, পড়াশোনাটা নতুন প্রজন্ম সঠিকভাবে পায়নি। হয়তো ফল ভালো করেছে কিন্তু শিক্ষাটা তাদের নিজের হয়নি। সর্বস্তরেই এরকম ঘটেছে। ফলে আমাদের সামাজিক ক্রোধ, অসুস্থ প্রতিযোগিতা, বিকারগ্রস্ততা ঊর্ধ্বমুখী হবার সুযোগ আছে, এবং সেটি অধিকভাবে তীরের বেগে সম্মুখের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলেই মনে হয়।

এবার আসি রাষ্ট্রের কথায়। খুব করে সম্প্রতি ভাবছি মার্কিন-তাত্ত্বিক ফ্রেডরিক জেমসনের একটি গ্রন্থের কথা। গ্রন্থটি প্রায় সবারই পরিচিত : Post modernism, or the cultural logic of late capitalism। তার ভাষ্য এরকম : ‘... between the cultural logics of human action and on economic and political processes within the asia-pacefic, including the impact of these forces on women and family life. Explaining how intensified travel, communications, and mass media’— ধরেই নিচ্ছি, সর্বস্তরের এ সম্ভাব্য অধিকৃতি আমাদের জন্য সুখের খবর নয়। এ থেকে সরে আসারও অবকাশ কম। আর বাংলাদেশ যেহেতু অধিক জনসংখ্যার দেশ সেখানে পারস্পরিক প্রতিযোগিতার উত্তেজনা নেহাত কম নয়, অধিক। এটা বাড়ছে এবং বাড়বে। বিশেষ করে, কিছুটা হলেও শিক্ষার যে কণামাত্র আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি যেভাবেই হোক তারা যে অর্জন করেছে, সেটি তাদের বিপথে নেওয়ার পথে সহায়তা করতে পারে। সে সহায়তা প্রতিরোধ করাও কঠিন। সরকার বা রাষ্ট্রকে তাই এসব বিষয়ে এখন সুকৌশলী হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রভাব ও সামর্থ্য জাতি অর্জন করবে এবং সেটি অর্জনের পথ রচনা করে দিতে তো হবেই কিন্তু সেটি করতে গেলে তার যে প্রতিক্রিয়া সেটি যেন নেতি না হয়ে ইতির পথে অভিমুখ তৈরি করে। এটিই এখন নতুন সরকারের চ্যালেঞ্জ। এর সাথে ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টিও আছে। সেটি উড়িয়ে দিলে হবে না। মূলত, শিক্ষা হোক, সংস্কৃতি হোক— তা চর্চার পথে যাতে যৌক্তিকতা থাকে, একটা লজিক্যাল পরিবেশ সৃষ্টি হয় বা গৃহীত হয়— তা দেখতে হবে। এখন সংস্কৃতি তো একটি বিরাট বিষয়, তার সঙ্গে মূল্যবোধ ও আস্থার পরিবেশও জড়িত। সেখানে রাষ্ট্রের যে ক্রিয়াশীল স্তম্ভগুলো আছে যেমন শাসন-আইন-বিচার সেগুলোকে তীব্রভাবে সক্রিয় করা জরুরি। এখনকার মতো চললে হবে না। এ প্রক্রিয়ায় কোনো ডোমিনেশনও চলবে না। ডোমিন্যান্ট হওয়াটা কেউ এখন আর মানতে চাইবে না। এজন্য ভারসাম্যটাই মুখ্য। আবারো বলছি, কমাতে হবে সর্বরকম বৈষম্য। আইনের শাসনের দিকটা খুব জোরালো করতে হবে। এটি দুর্নীতি কমায়। দুর্নীতিমুক্ত সমাজের কথা বারবার এবং সকল স্তরে উঠে এসেছে। এ বছরের মধ্যেই একটা সিগন্যাল নতুন সরকারের নিকট থেকে দেশবাসী এক্ষুণি পেতে চায়। বস্তুত, যে পরিবেশটি এখন আছে তা পাল্টাতে হবে। নীতিগত দিকগুলো সক্রিয় করে তুলতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি তো সোনার পাথরবাটি নয়। সেটি প্রতিষ্ঠার জন্য অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে খুনোখুনি, হানাহানি, কাড়াকাড়ি, লুটপাট বন্ধ করতে হবে। চরম বিশৃঙ্খলার বিপরীতে স্বাভাবিক শৃঙ্খলাটা আনতে হবে। এগুলো এ বছরই একটা সঠিক ট্র্যাকে আস্থাযোগ্য পরিবেশে, দৃশ্যমান করাটা জরুরি। নইলে সার্বিক যে পরিণতি তা সুখপ্রদ নয় বলা যায়।

সত্যিকার অর্থে, সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক শৃঙ্খলা অনেক ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান নয়। সেবা পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। হাসপাতালে প্রান্তিক মানুষের চিকিৎসা হয় না। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে, হাসপাতালে বা সচিবালয়ে সাধারণ মানুষ সেবার জন্য তেমন কিছুই পায় না। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা সেবা দেন না। কেন? ওই যে ‘কালচারাল লজিক’ অদৃশ্যমান। সেটির চর্চা বা ব্যবহার নেই। কৃষ্টিও নেই। সরকারি হাসপাতালে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা কাজ করেন না। চাকরি করেন, বেতন নেন কিন্তু কাজ করেন প্রাইভেট ক্লিনিকে। ডাক্তাররা নির্ধারিত সময়ে আসেন কম, চলে যান প্রাইভেট প্র্যাকটিসে, ওখানেই মনোযোগ। শিক্ষকরাও তাই। আমলারা ঠিক তাদের মতো। বিচারকরা আস্থাসূচক কিছু করেন না। সবাই জুজুর ভয় দেখাতে ব্যস্ত। এই যে প্রজাতন্ত্রের স্বভাব-চরিত্র, এটা দ্রুত পাল্টাতে হবে। এটাও নতুন সরকারের চ্যালেঞ্জ। নতুন বছরেরও চাহিদা— ও আশা। এগুলোর কোনো পরিবর্তন হয়নি অনেক দিন। একটা স্বাভাবিক সেবা প্রজাতন্ত্রের প্রজারা যদি না পায় তবে বেতন বাড়িয়ে, শিক্ষার হার বাড়িয়ে, কিছু অংশের জন্য সুবিধা দিয়ে উন্নয়ন-গণতন্ত্র কোনোটাই কি টিকিয়ে রাখা যায়! আগে তো স্বাভাবিক ব্যবস্থাটা নিশ্চিত করতে হবে। এই ঢাকায় প্রচুর ফ্ল্যাট উঠেছে, একটা বড় অংশ ঋণ-সুবিধা, ঋণখেলাপি ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সুবিধা পাচ্ছে। সবাই নয়। যারা পাচ্ছে না, তারা ন্যূনতমও পাচ্ছে না। এর পরিমাণটা অনেক বেশি। এসব চোখে লাগা ‘লজ্জাকর’ (সভ্যতার জন্য লজ্জাকর) বিষয়গুলোর পরিবর্তন দরকার। পরিবর্তনটা এক দিনে হবে, তা নয়। কিন্তু একটা সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিগন্যাল বা অর্ডার তো অনেক কিছু। অনেক কিছু তা করতে পারেও, পাল্টেও দিতে পারে— এই পাল্টানোটা অনেকেই চায়, এই সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads