• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা প্রসঙ্গে

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা প্রসঙ্গে

  • প্রকাশিত ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮

গতকাল বিশ্বের দুটি গণতান্ত্রিক দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। প্রথমটি হলো আফ্রিকা মহাদেশের কঙ্গো ও দ্বিতীয়টি হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশে। বাংলাদেশে নির্বাচন বললে দুটো বিষয় আমাদের সামনে চলে আসে একটি হলো উৎসব অন্যটি সহিংসতা। গত দুটি জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় নির্বাচনে যতটা আমেজ ভোটারের মধ্যে অনুভূত হয়েছিল তার চেয়েও বেশি অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল ভীতির। আর এ ভীতি হলো নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার, গুমের, লুটতরাজের, ঘরবাড়ি, দোকান-পাটসহ অন্যান্য ভিটেমাটিতে অগ্নিসংযোগের। নির্বাচনে জয়লাভের পর প্রতিপক্ষের বাড়িঘরে আগুন, আসবাবপত্র লুট, প্রতিপক্ষকে খুন, মারধর কিংবা এলাকাছাড়া করা বাংলাদেশের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার স্বাভাবিক রূপ। গত ১০টি নির্বাচন ও নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার ভয়ঙ্কর পরিসংখ্যান দেখলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। আর এক্ষেত্রে রেহাই পায় না পাড়া-প্রতিবেশী, স্বজন, বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এ সহিংসতা বন্ধে কোনো রাজনৈতিক দল কখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বরং নির্বাচন কমিশনের একজন কমিশনার একে সমর্থন দিয়ে বলেছেন ‘এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের সংস্কৃতি’! এ ধরনের অবিবেচনাপ্রসূত উক্তি খুব বেদনার। সভ্য সমাজে সহিংস কোনো কিছুই কোনো দেশের সংস্কৃতি হতে পারে না, একে অপসংস্কৃতি বলাই যুক্তিযুক্ত।

বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে খ্যাতি পাচ্ছে কিন্তু নির্বাচনী সহিংসতা আমাদের মাথা নত করে দেয় বিশ্বদরবারে। অনেকে আমাদের নির্বাচনী সহিংসতা দেখে আফ্রিকার গৃহযুদ্ধ লেগে থাকা বিভিন্ন দেশ যেমন— সোমালিয়া, কেনিয়া, কঙ্গো, নাইজার কিংবা জিম্বাবুয়ের সঙ্গে তুলনা করে থাকে। তাদের এ তুলনা নিশ্চয়ই আমাদের জন্য লজ্জাকর। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে— নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় হাজার হাজার লোক মারা গেলেও এসব খুন, বাড়িঘরে আগুন দেওয়া, শারীরিকভাবে নির্যাতন প্রভৃতির কোনো বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি কিংবা কোনো সরকারই এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করেনি। এমনকি, সহিংসতার শিকার পরিবারগুলোকে সমবেদনা জানানো কিংবা ক্ষতিপূরণ দেওয়া অথবা এসব সহিংসতার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান করার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেনি কোনো সরকার।

আমরা প্রতিবারই দেখি জাতীয় কিংবা স্থানীয় নির্বাচনের পর বিজয়ী দল কর্তৃক প্রতিপক্ষ দলের নেতাকর্মীদের জন্য এক ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়।  এসব কারণে গ্রাম ছেড়ে কিংবা কেউ দেশ ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এক্ষেত্রে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন আনুপাতিক হারে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। স্বাধীনতার পর থেকে দিন দিন এ সম্প্রদায়ের দেশ ত্যাগের হার বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। এক পরিসংখান মতে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যালঘু ভোটার ছিল প্রায় ১৬ শতাংশ। ১৯৯৬ সালের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার জন্য ২০০১ সালে এ সংখ্যা দাঁড়িয়ে ছিল  ১০.৪ শতাংশ আর বর্তমানে সংখ্যালঘুদের হার মাত্র ৮ শতাংশেরও নিচে। অন্য এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি জাতীয় নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগে বাধ্য হয় ১.৭% হারে। অন্যদিকে ঘরবাড়ি, দোকানপাট কিংবা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে আগুন, লুটতরাজ, নির্যাতন হয় ২০ শতাংশ সংখ্যালঘুদের পরিবারে। যদিও এবার বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলই নির্বাচিত হওয়ার পর সংখ্যালঘুদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয়/ দফতর করার ঘোষণা দিয়েছেন তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে। সুতরাং সংখ্যালঘুসহ প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী যেন কোনো রকম হয়রানি কিংবা নির্যাতনের শিকার না হয় সেদিকে নব-নির্বাচিত সরকারকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের সরকারকে বুঝতে হবে তিনি যখন সরকার গঠন করেন তখন তিনি বাংলাদেশের সরকার হিসেবে বিবেচিত হন। সুতরাং দেশের প্রতিটা নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব সরকারের ওপরে বর্তায়। এসব অপরাধ দমনে সরকারকে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে হবে এবং পরবর্তীতে এ সংখ্যা একেবারে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতিও জাতি আশা করে।

২০০১ সালে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে মোট কতটি সহিংসতা হয়েছে তার জন্য ২০১১ সালে সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং সে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে মোট ৩৬২৫টি সহিংসতার ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে ৩৫৫টি ছিল হত্যা। এর মধ্যে মামলা হয়েছিল ২২২টির এবং চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল মাত্র ১৪টির। তা ছাড়া তদন্ত কমিটি কতগুলো সুপারিশ করেছিল যার কোনোটি বাস্তবায়ন হয়নি। এ রিপোর্টের আলোকে বাংলাদেশে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতাকে পরোক্ষভাবে সরকারের সমর্থন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া ১৯৯১-১৯৯৬ সালে ১৭৬ জন এবং ১৯৯৬-২০০১ সালে ৭৭৮ জনকে নির্বাচনী সহিংসতায় প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল। ওই পরিসংখ্যানগুলোর আলোকে বলা যায় যে, বাংলাদেশের কোনো নির্বাচনই সহিংসতা ছাড়া হয়নি।

বাংলাদেশেই নির্বাচনী পরবতী সহিংসতা হয় এমনটা নয়, বরং বিশ্বের সর্বত্রই নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার খবর পাওয়া যায়। এর মধ্যে কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা সবচাইতে বেশি। নির্বাচনী সহিংসতার কারণে ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী দুদল নিয়ে গঠিত হয়েছিল যৌথ সরকার। এ যুক্তি কিংবা উদাহরণ দিয়ে সহিংসতাকে কোনোভাবে সমর্থন করা যায় না। বরং এ যুক্তির ওপর ভিত্তি করে সহিংসতার নিত্য-নতুন রূপ আবিষ্কার হচ্ছে। যেমন— জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থীদের ওপর হামলা এর আগে কখনো ঘটেনি। অথচ এবারের নির্বাচনে সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীদের ওপর হামলার বহু ঘটনা ঘটেছে এবং নির্বাচন পরবর্তী সময়ে আরো ঘটার শঙ্কা রয়েছে যা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সুতরাং এসব সহিংসতা বন্ধে নির্বাচিত নতুন সরকারকে কঠোরভাবেই নির্দেশনা দিতে হবে। যেসব দেশে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা সংঘটিত হয় তার মধ্যে হন্ডুরাস এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য জরুরি অবস্থা জারি করে। এ ছাড়া অন্য কোনো দেশ এ ধরনের সহিংসতাকে প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সকল ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে বিশ্বে তার মান সমুন্নত রাখবে জাতি হিসেবে এটাই সকলের প্রত্যাশা। বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষগুলো শান্তিতে বসবাস করার নিশ্চয়তা চায়। গণতন্ত্রের  মূল উপাদানই হলো বিজিতদের প্রতি সমবেদনা, সহানুভূতি ও  শ্রদ্ধা প্রদর্শন। এদিক থেকেও বাংলার মানুষ বাংলাদেশকে বিশ্বের রোল মডেল হিসেবে দেখতে চায়।

 

শরীফুর রহমান আদিল

লেখক : শিক্ষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads