• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
প্রবাসী নারী শ্রমিকের কান্না বেড়েই চলেছে  

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

প্রবাসী নারী শ্রমিকের কান্না বেড়েই চলেছে  

  • প্রকাশিত ১৫ জানুয়ারি ২০১৯

সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যে অভিবাসী নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে খুব করে ভাবছে। বিশেষ করে বাসাবাড়ি কিংবা কর্মক্ষেত্রে অভিবাসী নারীরা বিভিন্নভাবে যৌন হেনস্তার শিকারের ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সরকারের টনক নড়েছে। তারা নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে হোস্টেলে রাতযাপনের সিদ্ধান্তে উপনীত হতে যাচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে নারী শ্রমিকরা নির্বিঘ্নে রাতযাপন করবেন হোস্টেলে। সেখান থেকে সকালে বিভিন্ন কর্মস্থলে গিয়ে আবার সন্ধ্যালগ্নে হোস্টেলে ফিরে আসবেন। তাতে করে কারো বাসাবাড়িতে রাতযাপনের প্রয়োজন পড়বে না। কারণ দেশগুলোর সরকার ইতোমধ্যে জেনে গেছে তাদের নাগরিকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য; যা রীতিমতো আমাদেরও ভাবাচ্ছে। সেই ভাবনার বিষয়টি পরিষ্কার করে না বললে নারী শ্রমিকদের ব্যাপারে সতর্ক হতে পারব না আমরাও।

আমরা জানি, সমগ্র বিশ্বে বাঙালিদের পদচারণা ক্রমেই বেড়ে চলেছে, নিঃসন্দেহে আমাদের জন্যে এটি একটি সুখবর। এই মানুষগুলো আমাদের কাছে প্রবাসী বাঙালি হিসেবেই পরিচিত। এদের কেউ কেউ ভালো অবস্থানে থেকে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পেলেও অধিকাংশই শ্রমজীবী মানুষের তালিকায় রয়েছে। শ্রমজীবী হলেও তারা আমাদের কাছে অতি সম্মানিতদের একজন। আমরা জানি ট্যাঁকের টাকা খরচ করে পঁইপঁই করে ঘুরতে বিদেশে ভ্রমণে যাননি তারা, গেছেন দৈহিক শ্রমের বিনিময়ে অর্থকড়ি উপার্জন করতে। যে অর্থের ভাগীদার হচ্ছি আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে।  

বিশ্বদরবারে আমাদের এ শ্রমজীবী মানুষগুলোর দারুণ খ্যাতি রয়েছে। দুটি কারণে সাধারণত এ খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন তারা। বিশ্বস্ততা এবং স্বল্পমূল্যে শ্রম বিক্রি করার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে রীতিমতো বাঙালিদের জয়জয়কার শোনা যাচ্ছে। মাঝে-মধ্যে অপ্রীতিকর কিছু ঘটনা ঘটে থাকলেও তা ধর্তব্যের আওতায় পড়ছে না। বিদেশি প্রভুরাও তা মেনে নিচ্ছেন, আর কিছু না হোক বাঙালিদের সহজে ঠকিয়ে দেওয়া যায়। বাঙালিদের দেহঝরা প্রতি ফোঁটা ঘামের মূল্য গুনে গুনে পরিশোধ করতে হয় না, শুধু দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার অনুমতি মিললেই বাঙালিরা খুশি হয়ে যান। সেটি বুঝেই বিদেশিরা আমাদের শ্রমিকদের কদর করেন। কদর করেন নারী শ্রমিকদেরও। বাঙালি নারী শ্রমিকদের মধ্যপ্রাচ্যের ধনাঢ্যরা তাদের শয্যায় নিতে কার্পণ্য করেন না। কারণ এরা প্রতিবাদ করতে অপারগ, এ ছাড়া বিনিময়ে বাড়তি রিয়াল, ডলার, পাউন্ড খরচ করতে হয় না তাদের। মাইনের সঙ্গেই সব হিসাব চুকিয়ে দেওয়া যায়। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমাদের অধিকাংশ নারী শ্রমিক তা মেনে নিতে বাধ্য হন। বাধ্য হন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে গর্ভধারণ করতে। অনেকেই গর্ভপাত ঘটাতে সক্ষম হলেও কারো কারো পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। কারো কারো জন্য তখন ভয়ানক বিপদটি নেমে আসে সন্তান প্রসবের মাধ্যমে। ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তান নিয়ে তখন বেচারিকে পড়তে হয় নানান বিপাকে। শিশুটাকে ক’দিন লালন-পালন করলেও দেশে ফিরে আসার সময় হূদয়বিদারক ঘটনার সৃষ্টি হয়। মান-ইজ্জতের ভয়ে ওই সন্তানকে ফেলে আসতে বাধ্য হন তখন মা। এতসব নির্যাতন হজম করে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও দেশে ফিরতে পারছেন না নারীরা। প্রথমত চিন্তা থাকে নিজের ভিটেমাটি উদ্ধারের দিকে। চিন্তা থাকে মহাজনের টাকা শোধ করতে হবে কিংবা বিক্রীত জমিটুকু চড়া দামে কিনতে। এসব চিন্তায় মুখ বুজে সহ্য করে যান শত নির্যাতন। আর দেশে ফিরে বিষয়টি কাউকে বলতে পারেন না স্বামী-সংসার হারানোর ভয়ে অথবা বিভিন্ন ধরনের অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে। সে রকম অনেক ঘটনা আমরা খবরের কাগজের মাধ্যমে ইতোমধ্যে জানতে পেরেছি। তেমনি একটি সংবাদ প্রকাশিত হলে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

ঘটনাটি রাজশাহীর নারী শ্রমিকদের। জর্ডান ফেরত দুজন নারী জানিয়েছিলেন তারা জর্ডান গিয়েছেন একটি সংস্থার ব্যবস্থাপনায়। অতঃপর তারা খালিহাতে দেশে ফিরে আসতেও বাধ্য হয়েছেন। ওই দলে ছিলেন মোট ১৮ জন নারী। জর্ডানে ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন দুজন নারী। এই দুজন নারী জর্ডান থেকে ফেরত এলেও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ থেকে হাজার হাজার মা-বোনেরা ফেরত আসতে পারেননি।

আমরা খবরের কাগজ মারফত জানতে পারি ১৮ জন নারীকে প্রথমে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে একটি কক্ষে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে লোকজন এসে তাদের পছন্দ করে বাসাবাড়িতে কাজের উদ্দেশ্যে নিয়ে যায়। জানা যায়, ওই রাতে তাদের একজন মালিকের লালসার শিকার হয়েছেন। বিষয়টি গৃহকর্ত্রীর কাছে অভিযোগ করলে তাকে বাথরুমে আটকে রাখা হয়েছিল। আরো অমানবিক বিষয় হচ্ছে বাথরুমে আটকরত অবস্থায় তাকে একটি রুটি, এক গ্লাস পানি বরাদ্দ দেওয়া হয় সারাদিনের জন্যে। বিষয়টি অফিসে জানালে তাকে দ্বিতীয় একটি বাড়িতে কাজের জন্য পাঠানো হয়। দ্বিতীয় বাড়িতে কাজ করতে গিয়েও তিনি নিরাপদে থাকতে পারলেন না। একইভাবে নির্যাতনের শিকার হলেন। আবারো অফিসে অভিযোগ করলেন তিনি। এবার তৃতীয় একটি বাড়িতে পাঠালেন। একই অবস্থা সেখানেও। মোট ২২ দিনে স্বস্তি না পেয়ে তিনি দেশে আসতে চাইলে তাকে পদাঘাত করে বিমানে উঠিয়ে দেন। এবং শূন্য হাতেই দেশে ফেরেন তিনি। এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে, যা ইজ্জতের ভয়ে প্রকাশ করতে পারছেন না নারী শ্রমিকরা।

উল্লেখ্য, নারী বিদেশগামীদের রাজশাহী জেলার টিটিসি-তে প্রশিক্ষণ দেওয়ার খবরও আমরা জানতে পেরেছি। এটি অবশ্যই সংস্থাটির ভালো একটি উদ্যোগ। বিদেশ-বিভূঁইয়ে কাজকর্মের প্রশিক্ষণ নিয়ে গেলে শ্রমিকদের আর পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয় না। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, তাদের সেখানে ওই ধরনের প্রশিক্ষণ না দিয়ে বরং শেখানো হচ্ছে নিরাপদ যৌনাচার, সুরক্ষা ও এইচআইভি প্রতিরোধ বিষয়ে সচেতন হতে। এ ধরনের তথ্য সহায়িকাও সরবরাহ করা হয়েছিল একসময়। এমতাবস্থায় প্রশিক্ষণরত অনেক নারী আশঙ্কা করছেন গৃহপরিচারিকার নামেই কি তবে তাদের মধ্যপ্রাচ্যে দেহব্যবসার জন্য পাঠানো হচ্ছে! অনেক নারী প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরও জর্ডানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করেছেন এসব তথ্য সহায়িকা দেখে। 

প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপরায়ণ। ধর্মভীরুতা এদেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে লক্ষ করা যায়। ফলে নারায়ণগঞ্জের টানবাজার এবং ঢাকার ইংলিশ রোডের মতো অসামাজিক কার্যকলাপের স্থানগুলো উচ্ছেদ করতে পিছপা হননি মানুষ। ঘটনাগুলো ঘটেছে বর্তমান সরকারের বিগত সময়ে। আমরা দেখেছি তখন সরকার মানুষের নৈতিকতাবোধের বিপরীতে অবস্থান নেয়নি। গণমানুষের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়েছেন। দেশের দুটি প্রধান শহর থেকে অসামাজিক কার্যকলাপকে বিদায় করেছেন মানুষ। কিন্তু আমরা অসামাজিক কার্যকলাপ থেকে প্রধান দুটি শহরকে মুক্ত করলেও জনশক্তি রফতানির (নারী শ্রমিকদের) মাধ্যমটাকে কলুষমুক্ত করতে পারিনি। পারিনি শক্তিশালী করতেও। বলতে হয় বিষয়টি নিয়ে আমরা কূটনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম হইনি অদ্যাবধি। হয়তো নারী শ্রমিক রফতানি বন্ধের আশঙ্কায় এটি হয়নি। প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, যে দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা এবং স্পিকার নারী, সে দেশের নারীর ইজ্জত এত ঠুনকো কেন? শুধু তা-ই নয়, মনে রাখতে হবে এ দেশে প্রায় ২৭ বছরের অধিক নারীশাসিত। তবু প্রবাসী নারী শ্রমিকদের ইজ্জত বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারিনি আমরা। এ ব্যর্থতার দায়ভার কার কাঁধে চাপাবো? নাকি সেই সময় এখনো আমাদের আসেনি? যদি এসেই থাকে মনে করি তাহলে এক্ষুনি যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে আমাদের; হতে হবে সচেষ্ট। তাহলেই বোধকরি এ থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব হতে পারে। এতে করে দেশের ভাবমূর্তি যেমনি বৃদ্ধি পাবে তেমনি নারী নেতৃত্ব সার্থক হবে বলে আমাদের বিশ্বাস রয়েছে। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি বিষয়টি নিয়ে দ্রুত ভাবার জন্যে। কারণ তিনি শুধু বঙ্গবন্ধুর কন্যাই নন, তিনি হচ্ছেন একজন সফল প্রধানমন্ত্রীও। যার দক্ষ নেতৃত্বের ফলে দেশ বিশ্বদরবারে সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছেছে এবং উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশের তকমা লাগতে যাচ্ছে।

 

আলম শাইন

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও বন্যপ্রাণী বিশারদ

alamshine@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads