• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

সহশিক্ষা হিসেবে খেলাধুলা অন্তর্ভুক্ত করা হোক

  • আরাফাত শাহীন
  • প্রকাশিত ১৫ জানুয়ারি ২০১৯

খেলাধুলার উপকারিতা নানাবিধ। খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুরা নেতৃত্বদানের ক্ষমতা অর্জন করে। আপনার শিশু আগামী দিনে নেতৃত্ব দিতে পারবে কি-না, সেটা আপনি কীভাবে বুঝতে পারবেন? এটা বোঝার একমাত্র উপায় হলো শিশুকে অন্য শিশুদের সঙ্গে মিশতে দেওয়া। আর এটা করতে হলে অবশ্যই আপনার শিশুকে খেলার মাঠে পাঠাতে হবে। খেলাধুলার মধ্যে আত্মনিবেদিত ছেলে অথবা মেয়ে অন্য কোনো বাজে কাজে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ কম পায়। ফলে বাবা-মায়ের জন্য এটাও স্বস্তির একটা কারণ বলে বিবেচিত হতে পারে। আমরা যখন ছোট ছিলাম, স্কুল থেকে ফিরে এসে বাড়িতে বই রেখে সামান্য কিছু মুখে দিয়েই খেলার মাঠে ছুটে যেতাম। ক্রিকেট, ফুটবল, কাবাডি-প্রায় সব খেলাই চলতো সমানতালে। কই পরীক্ষার সময় তো কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়তে দেখিনি! বরং যেসব ছেলেমেয়ে খেলাবিমুখ ছিল, দিন দিন তাদেরই পিছিয়ে পড়তে দেখেছি। প্রবলভাবে খেলার মাঠের অভাব আমাদের দিন দিন খেলাধুলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। আবার সহশিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে খেলাধুলাকে অন্তর্ভুক্ত না করার ফলেও খেলাধুলা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান একেবারে শূন্যই থেকে যাচ্ছে।

আমাদের এ প্রজন্মের শিশুরা বলতে গেলে পুরোপুরি খেলাবিমুখ। মাঠের খেলার চেয়ে তাদের কাছে স্মার্টফোনে গেমস খেলা বেশি জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে আমরা অভিভাবকরাও কিন্তু কম দায়ী নই। পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের নিজেদের কাছ থেকে দূরে রাখার জন্যই মূলত তাদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেন। এভাবে ধীরে ধীরে যে শিশু স্মার্টফোনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে, তাদের পক্ষে এটা থেকে দূরে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এটা যখন তাদের কাছে নেশায় পরিণত হয়, তখন তাদের ফেরাবে এমন সাধ্য কার? এভাবে আমাদের শিশুরা দিন দিন মাঠের খেলাধুলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। অথচ শিশুর শারীরিক এবং মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আমরা কীভাবে অস্বীকার করব? আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আজ বড্ড বেশি একমুখী। ভোরসকালে সূর্যের মুখ দেখা যেতে না যেতেই ছেলেমেয়েরা একগাদা বই কাঁধে নিয়ে স্কুলের দিকে নয়তো কোচিং পানে ছুটে চলে। সারাদিন স্কুলে ক্লাসের পড়া শেষে তারপর ঘরে ফেরা। অনেকের কপালে আবার এই সৌভাগ্যটুকুও জোটে না। কারণ স্কুল ছুটি শেষে অনেক ছেলেমেয়ে ফের প্রাইভেট বা কোচিংপানে ছুটে। কেমন যেন মনে হয় এই দুনিয়াটাই শুধু ছোটাছুটির জন্য! বিন্দুমাত্র অবসর কিংবা সামান্য একটু বিনোদন এখানে অপরাধ! এখানে খেলাধুলার জন্য একটুখানি সুযোগ পাওয়া তো বহু দূরের ব্যাপার।

এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, একটি জাতির সার্বিক উন্নতি, অগ্রগতি এবং প্রগতির জন্য লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলার বিকল্প নেই। যারা মনে করেন খেলাধুলা শুধু সময়ের অপচয়, তারা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে বসে আছেন। একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন, খেলাধুলা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বিশেষভাবে সাহায্য করে। মানুষের শরীর কাঠামোকে মজবুত করে গড়ে তোলে। আমরা নিশ্চয়ই আমাদের সন্তানদের অতিশয় দুর্বল হিসেবে দেখতে চাই না! তাহলে শিশুদের খেলার মাঠে পাঠাতে বাধা কোথায়? প্রতিদিন বিকেলে একঘণ্টা কিংবা তার চেয়ে সামান্য বেশি সময় খেলাধুলার পেছনে ব্যয় করলে কোনো ক্ষতি হয় না বরং সতেজ শরীর এবং মন নিয়ে পড়ার টেবিলে বসতে পারে। আফসোস! আমাদের দেশের অধিকাংশ পিতা-মাতা বিষয়টি সম্পর্কে একেবারে বেখবর।

সত্যি কথা বলতে কী, আমরা শিশুকালে যেসব খেলাধুলা করেছি তার বেশিরভাগের নামই এই প্রজন্মের শিশুরা জানে না। সেসব খেলাধুলার একটা বড় অংশই আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। হা-ডু-ডু যে আমাদের দেশের জাতীয় খেলা এটা কে না জানে! ক্লাস ওয়ান পড়ুয়া শিশুটিও জানে আমাদের জাতীয় খেলার নাম। অথচ এই প্রজন্মের শিশুদের যদি খেলাটি সম্পর্কে আরেকটু বেশি প্রশ্ন করা হয় তাহলে তারা জবাব দিতে পারবে না। যে খেলাটিকে তারা কখনো নিজ চোখে দেখেনি, তার বর্ণনা তারা কীভাবে দিতে সক্ষম হবে? এটা আমাদের জন্য অবশ্যই লজ্জার বিষয় যে, আমাদের জাতীয় খেলা হা-ডু-ডু আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। অথচ আমাদের দায়িত্ব ছিল এটাকে ভালোমত সংরক্ষণ করা।

আমাদের আগামী প্রজন্ম ব্যাপকভাবে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। মাদকের ভয়াবহতা দেখে মাঝেমধ্যেই ভয়ে শিউরে উঠতে হয়। তরুণদের যদি খেলাধুলার প্রতি উৎসাহিত করা যায়, তাহলে মাদকের ভয়াবহতা কিছুটা হলেও কমবে। শুধু মাদক কেন, অশুভ যে কোনো কিছুর মোকাবেলার জন্য খেলাধুলা হয়ে উঠতে পারে প্রজন্মের শক্তিশালী হাতিয়ার। আমরা যদি একটু সচেতন হতে পারি, তাহলে সহজেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আজকাল খেলাধুলা শুধু বিনোদনের মাধ্যমই নয়, খেলাধুলার মাধ্যমে বিশ্ব পরিমণ্ডলে নিজেদের দেশকে পরিচিত করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তাহলে আমরা কেন খেলাধুলায় ভালো করার মাধ্যমে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে তুলে ধরব না?

ছোটবেলায় দেখেছি, প্রতিটি স্কুল এবং কলেজে প্রতি বছর মহা ধুমধামের সঙ্গে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতে। মানুষ দলে দলে ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা দেখতে ছুটে আসত। এখন আমাদের স্কুল-কলেজগুলোতে ঠিকমতো বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় না। গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আয়োজন করা হলেও শহরের বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এই আয়োজন অনুপস্থিত। হবে কীভাবে! স্কুলগুলোতে যে খেলার মাঠই নেই! অত্যন্ত নির্মম হলেও সত্যি যে, ধীরে ধীরে আমাদের দেশে খেলার জায়গা সংকুচিত হয়ে আসছে। অথচ উচিত ছিল জনসংখ্যা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই অনুপাতে খেলার মাঠও বৃদ্ধি পাবে। অপরিকল্পিত নগরায়ন শহরের বুকের এক চিলতে খেলার মাঠকেও গিলে খেয়েছে। তাহলে কীভাবে আমাদের দেশ থেকে তৈরি হবে পেলে, ম্যারাডোনা, মেসি কিংবা ব্রায়ান লারার মতো গ্রেটদের! শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দিয়েই কি একটি দেশ কখনো এগিয়ে যেতে পারে? আমাদের এগিয়ে যেতে হবে শিল্প, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের উৎকর্ষের পাশাপাশি খেলাধুলায় বিশেষ পারদর্শিতার মাধ্যমে। মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই স্কুলে স্কুলে খেলাধুলার জন্য বিশেষভাবে ব্যবস্থা করতে হবে। এই খেলাগুলো যাতে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালিত হয়, সেদিকেও বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সুস্থ-সবল জাতি গঠনের জন্য খেলাধুলার কোনো বিকল্প নেই।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

smshaheen97@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads