• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
এনটিআরসিএ কর্তৃক এ কেমন তুঘলকি কাণ্ড!

সংগৃহীত ছবি

সম্পাদকীয়

এনটিআরসিএ কর্তৃক এ কেমন তুঘলকি কাণ্ড!

  • সোলায়মান মোহাম্মদ
  • প্রকাশিত ২১ জানুয়ারি ২০১৯

বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহকারী শিক্ষকদের নিয়োগ সম্পন্ন করে এনটিআরসিএ। এরই ধারাবাহিকতায় গণবিজ্ঞপ্তির প্রেক্ষিতে গত ১৯ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে এ বছরের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত চলে অনলাইনে বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহকারী শিক্ষকের শূন্যপদের বিপরীতে আবেদন কার্যক্রম। সব দলের অংশগ্রহণে সারা দেশ যখন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হাওয়ায় ভাসছে ঠিক তখনই চলে অনলাইনে আবেদন কার্যক্রম। অপপ্রচার ও গুজব বন্ধে অবশ্য বিটিআরসি এ সময় দুদিন ইন্টারনেট স্পিড কমিয়ে আনে। এক রকম ইন্টারনেটের সঙ্গে যুদ্ধ করেই নিবন্ধনধারীদের আবেদন করতে হয়েছে। গণবিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষক নেওয়ার কথা রয়েছে। এনটিআরসিএ’র তথ্যমতে সারা দেশ থেকে প্রায় ৩০ লাখ নিবন্ধনধারী আবেদন করেছে। সে হিসেবে একটি শূন্যপদের বিপরীতে ৭৫ জন প্রার্থী আবেদন করেছেন।

এনটিআরসিএ এ পর্যন্ত ১৪তম শিক্ষক নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। কিন্তু এ পর্যন্ত একটি নিয়োগ কার্যক্রমও স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন করতে পারেনি। বরং এ পর্যন্ত এনটিআরসিএ নামেমাত্র কয়েক হাজার শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। যখন ১-১২তম শিক্ষক নিবন্ধনের সনদের মেয়াদ ২০১৮ সালের পরে মেয়াদোত্তীর্ণ ঘোষণা করা হয় তখন বঞ্চিত নিবন্ধিত শিক্ষকরা আদালতের দ্বারস্থ হয়ে প্রায় দুইশটি মামলা দায়ের করে। মহামান্য আদালত ২০১৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর ১৬৬টি রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে রায় প্রদান করেন। মহামান্য হাইকোর্ট এনটিআরসিএ’কে সাতটি নির্দেশনা দেন। ১. এনটিআরসিএ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের উদ্দেশ্যে সনদের মেয়াদ নির্ধারণ না করেই সার্টিফিকেট ইস্যু করবে এবং যারা একই উদ্দেশ্যে সনদ অর্জন করবে তাদের নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত সনদের মেয়াদ বহাল থাকবে। ২. এই আদেশ প্রাপ্তির নব্বই দিনের মধ্যে এনটিআরসিএকে একটি মেধাতালিকা করার নির্দেশ করা হচ্ছে এবং এনটিআরসিএ’র অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে আবেদনকারীরা যেন তাদের মেধাতালিকা এবং পজিশন দেখতে পারে। ৩. শুধু একটি মাত্র মেধাতালিকা থাকবে, এনটিআরসিএ কর্তৃক উপজেলা, জেলা কিংবা বিভাগভিত্তিক কোনো মেধা তালিকা হবে না এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগ সুপারিশ সম্মিলিত জাতীয় মেধাতালিকা থেকে দেওয়া হবে। ৪. এনটিআরসিএ সর্বশেষ একটি নিয়োগ সম্পন্ন করে বছরে একবার সম্মিলিত মেধাতালিকা আপডেট করবে। ৫. এনটিআরসিএ’কে জাতীয় মেধাতালিকা অনুসারে রিট পিটিশনার এবং প্রত্যাশিত আবেদনকারীর নাম যাদের সনদ ইস্যু করা হয়েছে তাদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে এবং নিয়োগের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা শিক্ষাবোর্ড নিয়োগকৃত শিক্ষকদের আবেদনে নিজ এলাকার প্রতিষ্ঠানে বদলি করার অনুমতি দিতে পারেন। ৬. এনটিআরসিএ’র শিক্ষক নিয়োগ সুপারিশ পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি যদি কার্যকর না করে তাহলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাবোর্ড ওই কমিটিকে ভেঙে দেবে এবং ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেবে। ৭. চাকরির এন্ট্রি প্রসেসে যেহেতু কোনো বয়স নির্ধারণ নেই সেহেতু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের উদ্দেশ্যে প্রার্থীদের বয়সসীমা রাখতে সরকারের একটি জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

মহামান্য আদালত কর্তৃক উল্লিখিত সাতটি নির্দেশনার মধ্যে প্রথম এবং প্রধান যে নির্দেশনা সেটিই কিন্তু এনটিআরসিএ অমান্য করেছে।  আদেশ অনুযায়ী প্রথমে ১-১৪তম নিবন্ধিতদের নিয়োগ সুপারিশ সম্পন্ন করার কথা কিন্তু সেখানে তা না করেই পঞ্চদশ শিক্ষক নিবন্ধনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। উপরন্তু ওই বিজ্ঞপ্তিতে বয়স নিয়ে একটি বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন। বিজ্ঞপ্তি অনুসারে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব প্রার্থীরা শিক্ষক নিবন্ধনে আবেদনসহ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে সনদ অর্জন করবেন কিন্তু এমপিও নীতিমালা অনুসারে গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন কিংবা পরবর্তীতে এমপিওভুক্ত হতে পারবেন না। একজন পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব প্রার্থী যদি সনদ অর্জন করে গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করার সুযোগ না পায় কিংবা নিয়োগ পেয়েও এমপিওভুক্ত না হয় তাহলে তার এই সনদের কি মূল্য থাকে? শিক্ষক নিবন্ধনের সনদটি মূলত শিক্ষকতা করার একটি পেশাগত সনদ। শিক্ষকতা ছাড়া এ সনদের আর কোনো মূল্যই নেই। যদি এই সনদ অর্জন করেই বাতিল হয়ে যায়, তাহলে এনটিআরসিএ’র শিক্ষক নিবন্ধন বিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করার সুস্পষ্ট বিধি-নিষেধ আবশ্যক ছিল। কিন্তু তা না করে প্রতিষ্ঠানটি বয়স নিয়ে এ রকম লুকোচুরির মাধ্যমে বেকার যুবকদের সঙ্গে প্রহসনে মেতে উঠেছে। যদি পূর্ণাঙ্গ রায় অনুসরণ করা হয় তাহলে গণবিজ্ঞপ্তিতে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব প্রার্থীদের আবেদন করার সুযোগ থাকার কথা। সম্প্রতি প্রকাশিত হয় ১৪তম শিক্ষক নিবন্ধিতদের ফলাফল। তারা এখন পর্যন্তও সনদ পায়নি। কিন্তু এদের মাঝে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব সনদধারীরা শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় পাস করেই নীতিমালার কারণে বাদ পড়তে হচ্ছে। বিষয়টি স্পর্শকাতর ও অমানবিক। মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশিত সাতটি পয়েন্টই অনুসরণীয়। এ সাতটি নির্দেশনার মধ্যে কোনো বিচার প্রার্থী বঞ্চিত হলে তা আদালত অবমাননার পর্যায়েই পড়ে। সে কারণে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব নিবন্ধিত শিক্ষকরা তাদের অধিকার ফিরে পেতে আবারো আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে।

অপরদিকে নিবন্ধনধারী বেকার যুবকদের কাছ থেকে এনটিআরসিএ হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৪০ হাজার শিক্ষক নিয়োগের যে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছে এখানে এনটিআরসিএ’র মতে ৩০ লাখ আবেদন জমা পড়েছে। প্রতি আবেদনের বিপরীতে এনটিআরসিএ আবেদনকারীদের কাছ থেকে নিয়েছে ১৮০ টাকা করে। তার মানে এনটিআরসিএ বেকার যুবকদের কাছ থেকে মোট টাকা নিল ৫৪ কোটি টাকা। এখানে বলা বাহুল্য এনটিআরসিএ ১৮০ টাকা করে নিলেও নিবন্ধনধারীদের কিন্তু আরো অতিরিক্ত ৪০ থেকে ৫০ টাকা করে গুনতে হয়েছে যা কম্পিউটার অপারেটররা নিয়েছে। এনটিআরসিএ এখানে বেকার যুবকদের সঙ্গে সবচেয়ে বড় ডাকাতি কিংবা অন্যায় যেটি করেছে তা হলো প্রতিটি শূন্যপদের বিপরীতে আবেদন করতে বাধ্য করা এবং প্রতি আবেদনে ১৮০ টাকা করে হাতিয়ে নেওয়া। তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের এই যুগে কেন এবং ঠিক কোন যুক্তিতে একজন বেকার যুবককে একই বিষয়ে প্রতিটি শূন্যপদের বিপরীতে ১৮০ টাকা প্রদান করে আবেদন করতে হবে? যেখানে প্রত্যেক নিবন্ধনধারীদের জাতীয় মেধা তালিকা করা হয়েছে। বিষয়টি সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী কোনো মানুষেরই বোধগম্য হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া একজন নিবন্ধনধারীর কাছ থেকে একটি মাত্র আবেদন আসলে খুব সহজেই কিন্তু মেধাতালিকা অনুযায়ী প্রার্থীর নির্বাচিত স্কুল কলেজের বাছাই পর্ব শেষ করা যেত। এ ছাড়া এখানে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। এই একাধিক আবেদনের নিয়মে কিন্তু প্রকৃত মেধাবীরা শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত নাও হতে পারে। ধরা যাক একজন নিবন্ধনধারী ৮০ নম্বর পেয়েছে। কিন্তু সে অধিক স্কুলে আবেদন না করার কারণে কোনো স্কুলের জন্যই নির্বাচিত হলো না। অপরদিকে মাত্র ৫০ নম্বর পেয়েও অধিক স্কুলে আবেদন করার কারণে অনেকেই নির্বাচিত হয়ে গেল। তাহলে বিষয়টি কি এক রকম জুয়া খেলার মতো হলো না? আর এই জুয়া খেলায় মেধাবীরা জয়ী হবে না মেধাহীনরাই জয়ী হবে তা ঠিক বলা মুশকিল। যদিও এনটিআরসিএ’র বিরুদ্ধে আগে থেকেই প্রায় ৬০ হাজার ভুয়া সনদ প্রদান করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। 

পরিশেষে বলতে চাই এত কিছুর পরও আমরা আলোকিত ভোরের স্বপ্ন দেখি। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা এখানে কেবলমাত্র যোগ্যরাই এনটিআরসিএ’র সঠিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নির্বাচিত হোক। সুতরাং এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের জরুরিভিত্তিতে দৃষ্টি দিতে হবে।

 

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads