• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
মারণাস্ত্রের হুমকিতে পৃথিবী

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

মারণাস্ত্রের হুমকিতে পৃথিবী

  • অলোক আচার্য
  • প্রকাশিত ২৯ জানুয়ারি ২০১৯

বিশ্বের পরাশক্তিগুলো একের পর এক মারণাস্ত্র বানিয়ে পৃথিবীকে হুমকির মুখে ফেলছে। নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে রেখেই যে এটা করছে তা নিশ্চিত। কিন্তু কেবল নিরাপত্তার অজুহাতে একের পর এক আধুনিক মারণাস্ত্র দিয়ে পৃথিবী ভরে ফেলছে, এ কথা পুরোপুরি হয়তো সত্যি নয়। নিজের ক্ষমতা জাহির করাও এর একটা উদ্দেশ্য। এক দেশ নতুন কোনো অস্ত্র বানাচ্ছে তো আরেক দেশ তার থেকেও ভয়ঙ্কর কোনো অস্ত্র বানিয়ে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। এসব অস্ত্রের ভয়াবহতা এতই যে, এই সুন্দর সবুজ শ্যামল পৃথিবী তার অস্তিত্ব হারাতে পারে। বহুবার এ ধরণি আধুনিক মারণাস্ত্রের আঘাতে কেঁপে উঠেছে। এক্ষেত্রে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি বড় উদাহরণ। এরই ধারাবাহিকতায় দেখা যাচ্ছে পেশিশক্তি দেখানোর প্রবণতা বিশ্বের মোড়ল দেশগুলোর মধ্যে। একজন আরেকজনকে ধ্বংস করতে ব্যস্ত। ভালো কাজের উদ্দেশ্যে ডিনামাইট আবিষ্কার করা হলেও সেই ডিনামাইট আজ মানুষের জীবন নেওয়ার কাজে ব্যবহূত হচ্ছে। কয়েকদিন আগে আমরা মাদার অব অল বোম্ব দেখলাম।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স- এসব উন্নত দেশ প্রতিনিয়তই নতুন নতুন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্র তৈরি করছে, যার ব্যবহার নিমেষেই শেষ করে দিতে পারে স্বপ্নের পৃথিবীকে। এর ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক সময়গুলোতে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের নাম বেশ আলোচিত। রাশিয়া ও চীন এই দুই দেশ এ ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহারে অনেকটা এগিয়েছে। আর এতেই বিশ্বে আলোচনার নাম হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র। গতানুগতিক ক্ষেপণাস্ত্রের চেয়ে এই ক্ষেপণাস্ত্র বেশ আধুনিক এবং উন্নততর। আলোচনায় আসার আরো একটি কারণ হলো, বিশ্বের বড় পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে এই ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকানোর কোনো কার্যকর প্রযুক্তি নেই। হাইপারসনিক এই ক্ষেপণাস্ত্র পরাশক্তির মাথাব্যথা তৈরি করেছে। এটি কেবল আক্রমণের সম্ভাব্য নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণেই নয়; বরং প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে বা স্নায়ুগত দিক থেকে এটি আপাতত আমেরিকাকে পেছনে রাখছে। হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে এত আলোচনার কারণ হলো এর গতি শব্দের চেয়ে আটগুণ বেশি গতিতে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারে। এই ক্ষেপণাস্ত্রটিকে গতিপথ পরিবর্তন করেও আঘাত করা যায়। ফলে এটি আকাশেই ধ্বংস করে দেওয়া প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। এ বছরের শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্রের একটি সরকারি রিপোর্টে মার্কিন আধিপত্যের হুমকির তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। মার্কিন গভর্নমেন্ট আ্যাাকাউন্টিবিলিটি অফিস (জিএও) এই রিপোর্টটি প্রকাশ করে। এই রিপোর্টে ২৬টি হুমকির তালিকায় চীন, রাশিয়া ও ইরানসহ পারমাণবিক শক্তিসমৃদ্ধ উত্তর কোরিয়াকে শীর্ষে রাখা হয়েছে। রিপোর্টটি মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ও ডাইরেক্টরেট অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সি- এই চার সংস্থার ওপর জরিপ চালিয়ে তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে চীনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন নিজের কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে ভূ-রাজনীতিতে আধিপত্য বাড়াতে চায় এবং বিশ্বশক্তি হিসেবে দাঁড়াতে চায়। এই প্রতিবেদনে চীনের স্থল, নৌ, বিমান, সাইবারস্পেস, মহাকাশ ও জলসীমায় আধিপত্য বিস্তারের ধরন বিশ্লেষণ করে আমেরিকার প্রতি চ্যালেঞ্জস্বরূপ বর্ণনা করেছে। মার্কিন সরকারের ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধাস্ত্র তৈরিতে চীন অবিশ্বাস্য গতিতে এগিয়ে চলেছে। শেষ কয়েক দশকে পৃথিবীর সব থেকে উন্নত ও অত্যাধুনিক বেশকিছু যুদ্ধাস্ত্র বানিয়েছে চীন। সামুদ্রিক শক্তির ক্ষেত্রে সমুদ্র, আকাশ, মহাকাশ এবং অন্তর্জাল সব ক্ষেত্রেই নিজেদের অন্যতম শক্তিশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে তারা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই পৃথিবীতে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বও প্রমাণ করেছে। এক্ষেত্রেও মার্কিন গোয়েন্দাদের মাথাব্যথার কারণ সেই হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে। পেন্টাগনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রযুক্তির কারণে পিপলস লিবারেশন আর্মির হাতে এখন আছে পৃথিবীর অন্যতম সেরা সব যুদ্ধাস্ত্র। যুদ্ধবিমান বানানোর ক্ষেত্রেও অভাবনীয় উন্নতি করেছে তারা। আকাশপথ, সমুদ্রপথসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই চীন নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চীনের এই এগিয়ে চলায় বিশ্বের বাকি সব পরাশক্তির মাথাব্যথা হওয়ারই কথা। ভারত, চীন, জাপান, আমেরিকা, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য বা ফ্রান্সের মতো দেশগুলো মহাকাশে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন উদ্ভাবনে ব্যস্ত। তাছাড়া পাকিস্তান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কাসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে চীন ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং বিনিয়োগ করছে। যেখানে ভারতও চেষ্টা করছে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে। আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু আকাশ নয়- ভারত মহাসাগরের নিয়ন্ত্রণও নিজের কব্জায় রাখতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে দেশটি। সেই নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে নিজেদের উপকূল ছাড়িয়ে এখন চীনের নজর বিভিন্ন বিদেশি সমুদ্রবন্দরে। তার উদাহরণ শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকায়ও চীন নানাভাবে নিজের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে।

অস্ত্রবাণিজ্যেও চীন এগিয়ে রয়েছে। আইআইএসএসের গবেষকরা বলছেন, চীনের অস্ত্র পশ্চিমা অস্ত্রের তুলনায় অন্তত ৭৫ ভাগ সক্ষমতাসম্পন্ন। কিন্তু দামে প্রায় অর্ধেক। সাম্প্রতিক সময়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধে দুই দেশেরই কিছু ক্ষতি হয়েছে। ক্ষমতাশালী অস্ত্রে রাশিয়া সমানতালে এগিয়ে চলেছে। সম্প্রতি রাশিয়া সব থেকে শক্তিশালী পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন ৫৮৬ ফুট লম্বা বরফভেদী জাহাজ সাগরে ভাসিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেরুপ্রদেশ সামরিক দখলে নেওয়া এর একটা অন্যতম লক্ষ্য। এর পাশাপাশি চলছে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দুই দেশই এমন জাহাজ আনার কথা ঘোষণা করেছে। মাটিতে, আকাশে বা মহাসাগরে কেউ কারো থেকে পিছিয়ে নেই। মহাশূন্যও দখলে নেওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্প্রতি নতুন একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার তথ্য প্রকাশ করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী মহাকাশে সেন্সর বসানো হবে শত্রুর ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র চিহ্নিত করার জন্য। সেই ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করার জন্য মহাকাশেই স্থাপন করা হবে অস্ত্র। রাশিয়ার মতে, এতে মহাকাশে বিপজ্জনক অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে। তারা বিষয়টিকে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের দিকে ইঙ্গিত করেন। এসব থেকে বোঝা যায়, বিশ্ব অত্যাধুনিক সব সমরাস্ত্রে ভরে যাচ্ছে। এসব অত্যাধুনিক অস্ত্রের ভারে পৃথিবীকে সত্যিই করুণ কোনো পরিণতি বরণ করতে হয় কি-না, তা সময়ই বলে দেবে। 

 

লেখক :  সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads