• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করা ও জানার আগ্রহই তাদের সৃজনশীলতা

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করা ও জানার আগ্রহই তাদের সৃজনশীলতা

  • মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশিত ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক ও পরিচালক গে ক্লাক্সটন বলেছেন, ‘সুশিক্ষা শুরু হয় প্রশ্ন করা দিয়ে, উত্তর দিয়ে নয়।’ প্রশ্ন করা শিক্ষার্থীদের বোধগম্যতা নির্ণয় করতে শিক্ষকদের সহায়তা করে। আর শিক্ষার্থীদের শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করার উৎসাহ জোগায়, কোনো বিষয়ের মূল ধারণা ও বিষয়ের প্রতি তাদের দৃষ্টি ও আগ্রহ নিবদ্ধ করে। প্রশ্ন চিন্তাকে নাড়া দেয়, উত্তর নয়। প্রশ্ন কাজকে ব্যাখ্যা করে, নির্দেশ করে, সমস্যা বর্ণনা করে, আর উত্তর চিন্তার অগ্রগতিকে থামিয়ে দেওয়ার সঙ্কেত দেয়। কাজেই বুঝা যাচ্ছে, যে শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে প্রশ্ন করছে সে চিন্তা করছে এবং শিখছে অর্থাৎ সে একজন সক্রিয় শিক্ষার্থী। সে যখন প্রশ্ন করছে তার মাধ্যমে তার জানার আগ্রহকে বুঝাচ্ছে, সে নতুন কিছু সৃষ্টি করছে। নির্জীব শিক্ষার্থীর মতো শ্রেণিকক্ষে বসে থাকা মানে শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ না করা। আর শিক্ষার্থী যখন শিক্ষককে কোনো প্রশ্ন করে না তার অর্থ তাই। শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে করে উচ্চতর চিন্তন দক্ষতার অধিকারী হয়। তাই শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা শিক্ষাদানের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থী মূলত একটি প্রশ্নই করে থাকে আর তা হচ্ছে, ‘স্যার এটি পরীক্ষায় থাকবে তো?’ যে দু-চারজন সব সময় প্রশ্ন করে তারাই বা তাদের মধ্যে দুয়েকজন প্রশ্ন করে এবং বাকিরা শুধু শ্রবণ করে। অর্থাৎ অধিকাংশ শিক্ষার্থীই শ্রেণিকক্ষের পাঠে সক্রিয় অংশগ্রহণ করছে না। আর অনেক শিক্ষকও প্রকৃত অর্থে প্রশ্ন করতে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করেন না। এ ধরনের শ্রেণিকক্ষ ট্র্যাডিশনাল। আর ট্র্যাডিশনাল শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকই সবকিছুর কেন্দ্রে থাকেন। তাকেই মনে করা হয় তথ্য ও জ্ঞানের আধার। শিক্ষক মাঝে মাঝে দুয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন শিক্ষার্থীদের বোধগম্যতা যাচাইয়ের জন্য, যা একটি নিষ্ক্রিয় মডেল বা ধরন। কারণ শিক্ষার্থীদের মনে করা হয় তাদের কিছু তথ্য ধরে রাখতে হবে পরীক্ষার জন্য।

আমরা জানি সক্রেটিস এথেন্সের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মানুষকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেন সত্যের গভীরে প্রবেশ করার নিমিত্তে। তারপর থেকেই দর্শন এবং আইনের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বেশি বেশি চিন্তা করার, কোনো বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করার জন্য প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেন যাতে শিক্ষার্থীরা সরাসরি উত্তর দেওয়ার পরিবর্তে চিন্তা করে উত্তর দিতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে চিন্তার শুরু হয় কোনো বিষয়ের ওপর যখন শিক্ষক-শিক্ষার্থী প্রশ্ন করা শুরু করে তখন থেকে। কোনো গবেষণা নির্ভর করে একটি মৌলিক ধারণার ওপর— যেটি এক ধরনের প্রশ্ন করার পদ্ধতি। একজন পণ্ডিত বা একজন গবেষক সব সময়ই কিছু মৌলিক প্রশ্ন করে থাকেন কিছু বিষয় এবং কৌশল সম্পর্কে। একজন শিক্ষার্থী যখন প্রশ্ন করে তখন সে ভুল প্রশ্নও করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন করে করে তার সাহস বেড়ে যায় এবং ফিডব্যাক পেয়ে পেয়ে সে ভালো ও সঠিক প্রশ্ন করতে শেখে। আর যখনই একজন শিক্ষার্থী প্রশ্ন করে, তার অর্থ হচ্ছে, সে তখন একজন সেলফ-মটিভেটেড শিক্ষার্থী এবং একজন ছোট গবেষকও বটে। আর শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে এই পরিবেশ সৃষ্টি করা ও ধারণ করাটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

আপনি শ্রেণিকক্ষে যদি শিক্ষর্থীদের সঙ্গে অনেক উঁচুমানের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন যা তদের বয়স ও বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় তাহলে শিক্ষার্থীরা চুপ হয়ে যাবে, আর কোনো প্রশ্ন করবে না। যখন প্রশ্ন করবে তার অর্থ তারা আপনার কথা বুঝতে পারছে। তাদের প্রশ্ন করা মানে আপনি যাচাই করতে পারছেন যে, আপনার ক্লাস তাদের কাজে লাগছে। আপনার ক্লাস ফলপ্রসূ হচ্ছে। আপনি বুঝতে পারছেন যে, ক্লাস জেগে আছে, ঘুমুচ্ছে না। আর একজন সার্থক শিক্ষক তো তাই চায়, তার ক্লাস জেগে থাকুক, উৎফুল্ল থাকুক। শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিলে তারা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে এবং তাদের প্রশ্ন করার মাধ্যমে আপনি আপনার পড়ানোর ফিডব্যাক পেয়ে যাচ্ছেন। আপনি তখন বুঝতে পারবেন আপনাকে কীভাবে এগোতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে শিক্ষা হচ্ছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের কথোপকথন। শিক্ষাদান মনোলগ অর্থাৎ স্বগতোক্তি নয়। আর তাই যদি হতো তাহলে শিক্ষার্থীরা বই কিনে বাসায় একা একা পড়ত। শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে আসা মানে দুই দিক থেকে যোগযোগ হওয়া আর প্রশ্ন করা হচ্ছে এই কথোপকথনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

শিক্ষার্থীরা কখন প্রশ্ন করে না? যদি তাদের বিষয়ের সঙ্গে একজন শিক্ষকের পাঠদান প্রাসঙ্গিক না হয়, যদি বেশি উচুঁমানের হয় কিংবা একেবাইে নিম্নমানের হয়, কিংবা ক্লাস যখন খুব বোরিং হয়। আবার শিক্ষার্থীরা যদি মনে করে, প্রশ্ন করলে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষের মধ্যে শিক্ষার্থীদের বোকা বানাবে। এ লজ্জা কেউ পেতে চাবে না। কাজেই একজন শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করবে। শিক্ষক উত্তর দেওয়ার সময় যদি এমন ভাব করেন, প্রশ্নটি ছিল বোকার মতো। এটি একবার হলে ওই শিক্ষার্থীরা আর প্রশ্ন করতে উৎসাহ বোধ করবে না, মনে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উদয় হলেও তারা করবে না।

আবার একটি শ্রেণিকক্ষ যখন শিক্ষার্থীতে ভর্তি থাকে তখন শিক্ষার্থীরা স্বভাবতই কোনো প্রশ্ন করতে আগ্রহী হয় না। কারণ মানুষের এ বিষয়টি স্বভাবজাত যে, সে একটি বিষয় সম্পর্কে জানে না বা কম জানে তা অন্যকে সহজে জানাতে চায় না। আর ক্লাসভর্তি শিক্ষার্থী কিংবা জনগণে ঠাসা কোনো জায়গায় শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করে না। তবে ক্লাসের সবার মধ্যে যদি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকে; একজন শিক্ষক যদি সে ধরনের ক্লাস উপহার দিতে পারে, একটি শ্রেণিকক্ষের সবাই একে অপরের বন্ধু; এমনকি, সবাই সমালোচনা থেকে নিরাপদ— তাহলে ভরা ক্লাসেও শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করতে উৎসাহ বোধ করবে। কাজেই ক্লাসের সাইজ এবং শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কাজেই শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য তারা যে ধরনের প্রশ্নই করুক না কেন বলতে হবে, চমৎকার প্রশ্ন, যথার্থ প্রশ্ন। এটি প্রশ্ন করার জন্য এক ধরনের মটিভেশন। আর শিক্ষার্থী যখন একজন শিক্ষককে প্রশ্ন করে তার অর্থ হচ্ছে তাদের মধ্যে এক ধরনের সম্পর্কও তৈরি হচ্ছে। তারা একে অপরের কাছাকাছি আসছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে দূরত্ব কমানো কার্যকরী শিক্ষাদানের ইঙ্গিত বহন করে, শেণিকক্ষে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করে। তা নাহলে সেই প্রাচীনকালের মতোই মনে করা হবে, শিক্ষককে প্রশ্ন করা মানে এক ধরনের বেয়াদবি। এই ধারণা এখনো অনেক শিক্ষকের মধ্যে বিরাজ করে। এ থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। শিক্ষার্থীদের প্রচুর উৎসাহ দিতে হবে যাতে তারা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষককে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে থাকে। এর মধ্যেই লুকায়িত থাকে কোনো বিষয়ের সঠিক ধারণা পাওয়া। যা কোনো বই কিংবা সংজ্ঞা মুখস্থ করে সবসময় বুঝা সম্ভব হয় না।

আর একটি বিষয় আমরা খেয়াল করতে পারি। একজন শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের বলে দেন, আগামীকাল ক্লাসে তোমরা অমুক বিষয়ের ওপর যত বেশি পার আমাকে প্রশ্ন করবে। তার অর্থ কী? শিক্ষার্থীরা ওই বিষয়টি খুব ভালোভাবে পড়বে। বুঝে পড়ার চেষ্টা করবে। একইভাবে শিক্ষক নিজেও চিন্তা করবেন শিক্ষার্থীরা কী ধরনের প্রশ্ন করতে পারে, সে বিষয়ে। কাজেই শিক্ষক নিজেও চমৎকারভাবে প্রস্তুতি নেবেন। এতে উভয়েরই লাভ হবে। একটি বিষয়কে ভালোভাবে বুঝানোর জন্য, এর প্রায়োগিক ব্যবহারের জন্যই তো শিক্ষকের ক্লাস। আর তা না হলে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসবে কেন? বাসায় বই থেকে নিজেরাই পড়ে নিতে পারত। আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীরা যখন প্রশ্ন করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তার মানে পাঠদানের আসল উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে অর্থাৎ প্রকৃত ধারণা পাওয়ার পথ তৈরি হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাসও বাড়ছে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আমরা এগুলো অবশ্যই আশা করব।

লেখক : প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads