আজ ২১ ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আজ থেকে ৬৭ বছর আগে ১৯৫২ সালের এই দিনে বাঙালি রক্ত দিয়েছিল তার মাতৃভাষা ‘বাংলা’কে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে। মায়ের ভাষা, মুখের ভাষা ‘বাংলা’কে রক্ষায় আত্মদানকারী সেসব বীর শহীদদের জানাই গভীর শ্রদ্ধা। কিন্তু প্রশ² হচ্ছে, এত বছর পরে এসে আমরা শুদ্ধ ও নির্ভুলভাবে মাতৃভাষা ‘বাংলা’ শিখতে পেরেছি কি? এখন ঘরে-বাইরে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যে জগাখিচুড়ি বাংলায় কথা বলে তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। শুধু কি তা-ই, বিভিন্² চ্যানেল এবং কয়েকটি প্রিন্ট মিডিয়াকে বাংলা ভাষার অশুদ্ধ চর্চা করতে দেখা যায়।
আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার আর বাংলা শব্দের অপব্যবহার এক কথা নয়। বিভিন্² সড়ক ও বিপণি বিতানে ভুল বানানে প্রদর্শিত হতে দেখা যায় সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও এসব দেখারও কেউ নেই! আজকাল ছেলেমেয়েদের মুখে শোনা যায়, বাংলা বানান ধর্তব্যের ভেতরে নয়। প্রশ² জাগে, ছেলেমেয়েদের গড়ে তোলার জায়গা যে বিদ্যালয়, তার শিক্ষকরাই কি ঠিকভাবে বাংলা ব্যাকরণ এবং বানান সম্পর্কে সচেতন?
অথচ বছর ঘুরে-ফিরে আসে একুশের মাস ফেব্রুয়ারি তথা একুশের গ্রন্থমেলা। বাঙালির জীবনে প্রতিবারই ফেব্রুয়ারি আসে মনে করিয়ে দিতে যে, আমরা সেই জাতি, যারা বুকের রক্ত দিয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্²ত রেখেছি। উজ্জীবন ও উদ্দীপনের ডাক দিয়ে আসে মহান ভাষা আন্দোলনের এই মাস। রাজধানীবাসীর জীবনে এখন একুশের চেতনা আবর্তিত হয় প্রধানত মাসব্যাপী বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে। কিন্তু বই মেলার এই আবাহন কি শুদ্ধ মাতৃভাষা চর্চায় কোনো অবদান রাখতে পারছে? এ প্রশ² বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কেবল ঢাকার মধ্যেই কিন্তু সীমাবদ্ধ নয়। দেশের অন্যান্য শহর ও গ্রামেও কমবেশি সবাইকে ছুঁয়ে যায় বই মেলার তরঙ্গ। অন্যদিকে আমাদের দেশে সৃজনশীল যত বই বের হয়, তার শতকরা নব্বই ভাগই প্রকাশিত হয় একুশের বই মেলা সামনে রেখে এবং
মেলা চলাকালে।
ফেব্রুয়ারির শেষপর্যন্ত বই প্রকাশিত হতে থাকবে। কিন্তু এসব বইয়ে শুদ্ধ ভাষার ব্যবহারও দুর্লঙ্ঘ হয়ে উঠছে। এই যখন আমাদের বাংলা ভাষার অবস্থা, তখন কেবল ফেব্রুয়ারি মাস এলে আবেগে বাঙালির ভেসে যাওয়ার যৌক্তিকতা কতখানি! সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ, কঠোর নীতিমালার ভেতর দিয়ে এখনই রুদ্ধ করতে হবে সর্বত্র গুরুচণ্ডালী বাংলা ভাষার ব্যবহার। প্রমিত বাংলা শেখা ও এর ব্যবহারে জোর দিতে হবে। ভুল বানানে প্রদর্শিত সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ড সংশোধনে উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহারে আইন প্রণয়নের ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের মর্যাদা দিতে হলে বাংলা ভাষার শুদ্ধ ও সঠিক ব্যবহারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের এখনই সময়। এখন একুশ কিংবা ফেব্রুয়ারি আর বাঙালির একার নয়। এ এখন বিশ্বমানবের। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদায় অভিষিক্ত। বিশ্বময়তার এই বন্ধনকে আরো দৃঢ় করবে মাতৃভাষার পরিশীলিত ও শুদ্ধ চর্চা।