• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
আরো অনেক পলান সরকার দরকার

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

বইকেন্দ্রিক সামাজিকতা

আরো অনেক পলান সরকার দরকার

  • প্রকাশিত ০৩ মার্চ ২০১৯

নিজে হেঁটে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বইপড়ার আগ্রহ সৃষ্টির ক্ষেত্রে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন পলান সরকার। আমাদের সমাজে বিত্তবান মানুষের অভাব না থাকলেও হূদয়বান মানুষের যে কত অভাব তা আমরা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে লক্ষ করছি। লোভ, লালসা, বিত্ত-বৈভব আর খ্যাতি অর্জনের জন্য এ সমাজের মানুষ কত কিছুই না করছে। কিন্তু তারই বিপরীতে একজন পলান সরকার একটি আলোর পথের রচনা করেছেন। সামান্য পড়াশোনা জানা মানুষটির এই বোধ থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণের সেই দিন কবে আসবে? পলান সরকার যে পথ দেখিয়েছেন সেই পথ ধরে আমরা কতদূর এগুতে পারব তা ভবিষ্যতই বলে দেবে।

গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে ঘুরে ছোটবড় সবার কাছে বই পৌঁছে দিতেন। বইপড়া আন্দোলনের মহাযজ্ঞের নজির রেখে তিনি চলে গেলেন পরপারে। পলান সরকারের বইপড়া আন্দোলনকে কেবল বিরল, ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখলেই হবে না। তার দেখানো পথ ধরে দেশের প্রতিটি এলাকায় যদি এমনভাবে পাঠাগার গড়ে ওঠে তবেই আমরা লক্ষ্যস্থানে পৌঁছাবার কথা ভাবতে পারি।

পলান সরকারের জন্ম ১৯২১ সালে। খবরে জানা যায়, জন্মের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় তার বাবা মারা যান। টাকা-পয়সার টানাটানির কারণে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই লেখাপড়ায় ইতি টানতে হয় তাকে। বইপাগল এই মানুষটি প্রথমে এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিবছর স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যারা প্রথম থেকে দশম মেধা তালিকায় স্থান পাবে তাদেরকে একটি করে বই উপহার দিতেন। এক সময় ডাক্তারি পরীক্ষায় ডায়াবেটিস ধরা পড়লে তিনি নিজের সুস্থতায় হাঁটার প্রয়োজনকে সমাজ পরিবর্তনে শৈল্পিক কর্মের গোড়াপত্তন করলেন। তিনি  হেঁটে হেঁটে বই বিলির কাজ শুরু করলেন। সেই থেকে শুরু এই অভিনব বইপড়ুয়া প্রজন্ম গড়ার অভিযান। এরপর থেকে তিনি সবাইকে বই দিতেন। একটানা ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে তার এই কাজটি রাজশাহী অঞ্চলের বেশ কয়েকটি গ্রামজুড়ে বইপড়ার আন্দোলনে রূপ নেয়। জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি, খবরের কাগজ, টিভি মিডিয়ায় ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে তার এই অভিযান। ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে বিশ্বের ভিন্ন ভাষার প্রধান প্রধান দৈনিকে একযোগে পলান সরকারের বইপড়ার এই আন্দোলনের গল্প ছাপা হয়। সারা দেশে তাকে বহুবার সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তার জীবন ও কর্ম নিয়ে নির্মিত হয় নাটক ‘সায়াহ্নে সূর্যোদয়’। স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ২০১১ সালে একুশে পদক পান।

আমরা মনে করি পলান সরকারের এই আন্দোলন সমাজকে নানাভাবে আলোকিত করবে। এই চেতনার আলো ছড়িয়ে দিতে বইপড়া আন্দোলনকে আরো জোরদার করা প্রয়োজন। দেশে ঝিমিয়ে পড়া গ্রন্থাগারগুলোর মাধ্যমে বইয়ের আলোয় আলোকিত করতে হবে নতুন প্রজন্মকে। কেননা একমাত্র বইয়ের নেশাই পারে প্রজন্মকে সকল প্রকার অপরাধ ও নেশাগ্রস্ততা থেকে দূরে রাখতে। সেজন্য বইকেন্দ্রিক সামাজিকতার বিকাশের মাধ্যমে প্রয়োজন বইপড়া আন্দোলনকে সামাজিক আন্দোলনে রূপায়ণ করতে হবে এখনই। পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে বিয়ে, জন্মদিন, বিশেষ সাফল্য অর্জন, বিদেশযাত্রা, বিশেষ দিবসে অন্য গিফটের পরিবর্তে আমরা যদি বই উপহারকে বেছে নিই তাহলে বইপ্রীতি বাড়বে। সমাজে এই প্রচলন ছড়িয়ে দিলে দেশব্যাপী বইপড়া আন্দোলন জোরদার হবে। ঘরে ঘরে গড়ে উঠবে পারিবারিক পাঠাগার। আর এর মাধ্যমে মেধায়, মননে ও সৃজনশীলতায় আমাদের প্রজন্ম গড়ে উঠবে পরিশীলিত ও মানবীয় গুণে। আমরা যত বই পড়ব, মনের চক্ষু ততই খুলবে। চলমান অস্থির সমাজের অহমিকার ব্যারিকেড ভেঙে দিতে পারে বইপড়া আন্দোলন। এ প্রজন্মের সন্তানদের মোবাইল, ইন্টারনেট আর ফেসবুকের নেশা কাটিয়ে দিতে পারে বইয়ের নেশা। কিন্তু সে নেশাটি ধরাতে হবে অভিভাবকদের প্রাণান্তকর  চেষ্টায়। আর এই চেষ্টায় প্রয়োজন সরকারের প্রণোদনা। 

সমাজ থেকে মাদকের নেশাগ্রস্ততা, অপরাধপ্রবণতা, জঙ্গিবাদের বিপথগামিতা সর্বোপরি মূল্যবোধের জাগরণে এখন অতি আবশ্যিক হলো সাংস্কৃতিক জাগরণ। আর এই জাগরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো বইকেন্দ্রিক সামাজিকতা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads