• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণ

বাঙালির অবিনাশী প্রেরণা

  • প্রকাশিত ০৭ মার্চ ২০১৯

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বিকালে রেসকোর্স ময়দানে উত্তাল জনসমুদ্রে রাজনীতির মহান কবি মেঘমন্দ্র কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে জয়বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত-প্রকম্পিত হয়ে উঠল রেসকোর্স ও ময়দানসংলগ্ন আদিগন্ত সমুদ্র জনতার। পাকিস্তানি শোষণ ও দুঃশাসনের শৃঙ্খল ভাঙার স্বপ্ন-সংকল্পে অবিচল বাঙালি দেখতে পেল এক স্পষ্ট ও আলোকিত পথরেখা। আর সে পথই তাদের নিয়ে যায় প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার সোনালি দুয়ারে।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে ফিরে যায় নিজ বাসভূমি যুক্তরাজ্যে। মাত্র ২৪ বছরের মাথায় কেন পাকিস্তান ভেঙে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিলাম, তার কারণ খুঁজলে দেখা যাবে পাকিস্তানি শাসনের কালো ইতিহাস। সেখানে রয়েছে দীর্ঘ বঞ্চনা, অত্যাচার আর বৈষম্যের নিষ্ঠুর ইতিহাস। একটি উদাহরণ  দিলেই বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে যাবে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের নিরস্ত্র মানুষের ওপর পুলিশ ২৮৮ বার গুলি চালায়। শুধু কি তা-ই, ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী কারাগারে সাত রাজবন্দিকে মধ্যযুগীয় কায়দায় গুলি করে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল। পাকিস্তানি শাসকচক্রের অব্যাহত দুঃশাসনের কারণেই মোহভঙ্গ ঘটে বাঙালিদের। পাকিস্তানের সেই নির্মম অত্যাচার বন্ধ করার লক্ষ্যে স্বাধিকার আন্দোলনের পথে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া বাঙালিদের আর কোনো বিকল্প ছিল না।

বাস্তবিকপক্ষেই জাতির মহান নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের মাত্র আঠারো মিনিটের স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণটি বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিল। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশ ট্রানজিস্টার খুলে কান পেতে ছিল এই ভাষণ শোনার জন্য। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বন্ধ করে দিয়েছিল ঐতিহাসিক এই ভাষণের সম্প্রচার। প্রতিবাদে বেতারকর্মীরা কাজ বন্ধ করে দিলে সামরিক কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে পরদিন সে ভাষণ প্রচারের অনুমতি দেয়। ৮ মার্চ সারা বাংলাদেশ শুনল  ব্যক্তিত্বে শৃঙ্গস্পর্শী মহান সেই জননায়কের বজ্রকণ্ঠ। শুরু হয়ে গেল যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার প্রস্তুতি। একাত্তরের প্রতিটি মুহূর্তে, রণাঙ্গনে, বন-বাদাড়ে যুদ্ধের সুকঠিন সময়ে এই বজ্রকণ্ঠ জুগিয়েছে অনিঃশেষ শক্তি ও সাহস।

৭ মার্চের সেই ভাষণ আজ আর বাঙালির একার নয়। এর আবেদন আজ বিশ্বময়। বিশ্বঐতিহ্যের স্মারক ও সম্পদ অসাধারণ তাৎপর্যমণ্ডিত বঙ্গবন্ধুর সেই মহাকাব্যিক ভাষণ। ২০১৭-এর অক্টোবরে ইউনেস্কোর দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে বিশ্বঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে ভাষণটি নিবন্ধিত করা হয়। আন্তর্জাতিক সমাজের এই স্বীকৃতি আমাদের জাতির পিতার মনীষা ও ব্যক্তিত্বকেই কেবল মহিমান্বিত করেনি, জাতি হিসেবে আমাদের মর্যাদাকে করেছে সমুন্নত। বাংলাদেশের বয়স এখন ৪৭ বছর। নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে আজ আমরা মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। এ অবস্থায় বেশি প্রয়োজন জাতির ঐক্যবদ্ধ শক্তি। আমাদের আজ সিদ্ধান্ত নিতে হবে এই ঐক্যবিনষ্টকারীদের কাছে আমরা কিছুতেই আত্মসমর্পণ করব না। মনে রাখা দরকার, যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়ানোর শিক্ষা ও শক্তি জুগিয়েছে ৭ মার্চের ভাষণ। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।

বিশ্বের বহু শতাব্দীর ইতিহাসে এ ধরনের স্মরণীয় ভাষণ খুব বেশি নেই। আলেকজান্ডার, জুলিয়াস সিজার, আধুনিককালে আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ বক্তৃতা, মার্টিন লুথার কিং-এর ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিমে’র সঙ্গে সমুচ্চারিত বঙ্গবন্ধুর নাম ও তার অজেয় বাণী, তার বজ্রকণ্ঠ। আর তাই ৭ মার্চ বাঙালির অবিনাশী প্রেরণা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads