• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
উপকূল অঞ্চলের চাষিরা হতাশ

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

লবণে লোকসান

উপকূল অঞ্চলের চাষিরা হতাশ

  • নিতাই চন্দ্র রায়
  • প্রকাশিত ১৪ মার্চ ২০১৯

লবণ উৎপাদনের ভরা মৌসুমে লবণ বিক্রি করে উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেন না উপকূলীয় লবণচাষিরা। লবণের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন তারা। অনেকে উৎপাদন বন্ধ রেখেছেন। দু’বছর ধরে ক্রমাগত লোকসানের কারণে লবণচাষিদের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের সময় এদেশে একবার লবণের তীব্র অভাব দেখা দিয়েছিল। টাকা দিয়েও সে সময় লবণ পাওয়া যেত না। একশ্রেণির ব্যবসায়ী বেশি লাভের আশায় লবণ মজুত করে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করেছিল। মানুষ কচুপাতায় লবণ কিনে বাড়িতে নিয়ে আসত। এখনো মানুষ নূরুল আমীনকে লবণচোরা বলে অভিহিত করে।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থার মতে, চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, কক্সবাজার সদর, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া ও টেকনাফ উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলে দেশের সিংহভাগ লবণ উৎপাদন হয়। চলতি মৌসুমে দেশে এসব এলাকা থেকে বিসিকের লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ১৮ লাখ টন। আর পুরো বছরের জন্য লবণের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬ লাখ ৫৭ হাজার টন। এ পর্যন্ত লবণ উৎপাদন হয়েছে পাঁচ লাখ টন। জানা যায়, মাঠপর্যায়ে এক মাস ধরে ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা লবণ বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায়। অথচ প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) লবণ উৎপাদনে চাষিদের খরচ হয়েছে ৩৬০ থেকে ৪০০ টাকা। দুর্ভাগ্য, বর্তমানে উৎপাদন খরচের অর্ধেক দামে চাষিদের লবণ বিক্রি করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ লবণচাষি সমিতির তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ সালে দেশে লবণের ঘাটতি ছিল ৮০ হাজার টন। ২০১৭-১৮ সালেও ১ লাখ ১ হাজার টন লবণ ঘাটতি ছিল। গত দুই অর্থবছরে লবণের মোট ঘাটতি ছিল ১ লাখ ৮১ হাজার টন। এর মধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকার লবণ আমদানি করে ৩ লাখ টন। এ হিসাবে দেশে বর্তমানে লবণ উদ্বৃত্ত আছে ১ লাখ ১৯ হাজার টন। বিসিকের তথ্যমতে, গত মৌসুমে ৫৯ হাজার ৫৬৪ একর জমিতে ১৪ লাখ ৯৩ হাজার টন লবণ উৎপাদন হয়েছে। গত বছর লবণের চাহিদা ছিল ১৩ লাখ ৬৫ হাজার টন। অর্থাৎ চাহিদার চেয়ে প্রায় ১ লাখ ২৮ হাজার টন বেশি লবণ উৎপাদন হয়। বাঁশখালী উপজেলার একজন লবণচাষি দুঃখ করে বলেন, ৩৮ থেকে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে লবণ চাষের জন্য এক কানি (৪০ শতক) জমি ইজারা নিতে হয়। মাঠ তৈরি করতে খরচ করতে হয় ৬ হাজার টাকা। সেচ দিতে খরচ হয় ৪ হাজার টাকা। প্রতি কানি জমিতে লবণ তৈরিতে শ্রমিক খরচ লাগে ২০ হাজার টাকা। পলিথিন বিছাতে খরচ হয় আরো ৪ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে প্রতি কানি জমিতে লবণ উৎপাদনে খরচ হয় ৭২ থেকে ৭৪ হাজার টাকা। অন্যদিকে প্রতি কানি জমিতে লবণ উৎপাদিত হয় ২০০ মণ। ভালো মানের প্রতিমণ লবণের বর্তমান বিক্রয়মূল্য ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। সে হিসাবে এক কানি জমির উৎপাদিত লবণ থেকে চাষিদের আয় ৩৪ থেকে ৩৬ হাজার টাকা। তাই এক কানি জমিতে লবণ উৎপাদন করে চাষিকে লোকসান দিতে হচ্ছে প্রায় ৩৮ হাজার টাকা। দিনরাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে চাষিরা লবণের উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেন না।

উপকূলের হাজার হাজার লবণচাষির কথা- গরিব চাষিদের বাঁচাতে সরকারকে লবণ আমদানি সীমিত করতে হবে। অন্যথায় চাষিদের লবণ উৎপাদন বন্ধ করে অন্য পেশা গ্রহণ ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। এ প্রসঙ্গে বাঁশখালী লবণ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতির বলেছেন, আমদানি করা লবণের মজুত থাকায় ব্যবসায়ীরা মাঠ থেকে লবণ কিনছেন কম। মাঠপর্যায়ে কৃষকদের লবণ সংরক্ষণের কোনো সুযোগ না থাকায় উৎপাদন মৌসুমেই চাষিরা পানির দামে লবণ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে বড় কোম্পানিগুলো চাষিদের ঠকিয়ে মাঠ থেকে কম দামে লবণ কেনার এক অশুভ ফাঁদ তৈরি করেছেন। এ কারণে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন উপকূলের লবণচাষিরা। তাই লবণ শিল্প বাঁচাতে হলে সরকার পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ এই লবণের ওপর উপকূলের হাজার হাজার লবণচাষি ও তাদের পরিবার-পরিজনের জীবন-জীবিকা জড়িত। পুরো মৌসুমে লবণ উৎপাদনের লাভের অর্থ দিয়ে চাষিদের সারা বছর সংসার চলত। আর এখন লাভ তো দূরের কথা, লবণ বিক্রি করে চাষিরা উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেন না। লবণের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে চাষিরা পথে বসলেও বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো মৌসুমের সময় কম দামে লবণ কিনে ৮ থেকে ১০ গুণ বেশি দামে লবণ বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ আছে।

উপকূল অঞ্চলের চাষি পর্যায়ে বর্তমানে প্রতি কেজি অপরিশোধিত লবণ ৩ টাকা ৪০ পয়সা থেকে ৩ টাকা ৬০ পয়সা দামে বিক্রি হলেও সারা দেশের হাটবাজারে প্যাকেটজাত লবণ বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ৩৫ টাকা কেজিতে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, উপকূলীয় অঞ্চল থেকে অপরিশোধিত লবণ চট্টগ্রামের মাঝির ঘাট, চাক্তাই ও পটিয়ায় মিলগুলোতে নিয়ে আসা হয় পরিশোধনের জন্য। বর্তমানে এসব এলাকায় বস্তাপ্রতি (৭৪ কেজি) অপরিশোধিত লবণ বিক্রি হচ্ছে ৬২০ থেকে ৬৪০ টাকা, যার কেজিপ্রতি মূল্য দাঁড়ায় ৮ থেকে ৯ টাকা। ক্রাশিং শেষে মিল থেকে বেরিয়ে এই লবণ বিক্রি হচ্ছে প্রতি বস্তা ৭২০ থেকে ৭৫০ টাকা, অর্থাৎ প্রতিকেজি ১০ টাকা দামে। আর সেই লবণই প্যাকেটজাত করে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামে পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ৩৫ টাকা। অথচ লবণচাষিরা, যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে লবণ উৎপাদন করছেন, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করছেন, তারা লবণ উৎপাদনের আসল খরচটাও তুলতে পারছেন না, এর চেয়ে পরিতাপের বিষয় আর কী হতে পারে?

দেশের লবণ পরিশোধন কোম্পানিগুলোর কথা- শিল্পের নামে খাওয়ার লবণ আমদানি করে বাজারে বিক্রি করছে। এই লবণ আসছে সরাসরি পরিশোধিত অবস্থায়। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী আয়োডিন না মিশিয়েই পরিশোধন ছাড়া শিল্প-কারখানার নামে লবণ এনে প্যাকেটজাত করে বাজারে বিক্রি করছে। এতে একদিকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে লবণচাষিরাও বঞ্চিত হচ্ছেন ন্যায্যমূল্য থেকে। লবণ ব্যবসায়ীদের অভিমত হলো, শিল্প খাতে আমদানি করা লবণের একটি বড় অংশ খাওয়ার লবণ, যা শিল্প লবণ নামে আমদানি করে খাওয়ার লবণ হিসেবে বাজারে ছাড়া হচ্ছে। জানা যায়, শিল্প খাতে লবণ আমদানিতে মোট করভার ৩৭ শতাংশের মতো। অন্যদিকে খাওয়ার লবণ আমদানির মোট করভার ৮৯ শতাংশ। ফলে শিল্প লবণ আমদানি করাটাই বেশি লাভজনক। তথ্য অনুযায়ী, পরিশোধিত অবস্থায় এক কেজি শিল্প লবণ আমদানির খরচ হয় ১২ টাকা। স্থানীয় পরিশোধিত লবণের দাম পড়ে ২০ টাকার মতো।

দেশের প্রায় ৪৫ হাজার চাষি লবণ উৎপাদন কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এ ছাড়া লবণ উৎপাদন, বিপণন, পরিশোধন এবং বাজারজাতকরণের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায় ৫ লাখ লোকের জীবন-জীবিকা জড়িত। লবণ শিল্প একটি কৃষিভিত্তিক শিল্প। উপকূলীয় অঞ্চলের জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে ২০১১ সালে জাতীয় লবণ নীতি প্রণয়ন করা হয়। লবণচাষিদের আশা ছিল জাতীয় লবণ নীতি প্রণয়নের ফলে চাষিরা লবণের ন্যায্যমূল্য পাবেন এবং উপকূলীয় এলাকায় সমুদ্র থেকে জেগে ওঠা চরাঞ্চলের জমির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হবে। ফলে লবণ উৎপাদন এলাকায় কর্মচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হবে। বেকার জনগণের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক অবদান রাখবে। একই সঙ্গে এ নীতির ফলে উপকূলীয় জনজীবনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে। জাতীয় লবণ নীতির উদ্দেশ্য হলো- দেশে বছরভিত্তিক লবণের চাহিদা নিরূপণ এবং চাহিদা মোতাবেক লবণ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও কৌশল নির্ধারণ। এ ছাড়া চাষযোগ্য জমির পরিমাণ বৃদ্ধি এবং একরপ্রতি লবণের উৎপাদন বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ। কালো লবণ উৎপাদনে চাষিদের নিরুৎসাতি করে সাদা লবণ উৎপাদনে উদ্বুদ্ধকরণ ও বিসিক উদ্ভাবিত পলিথিন পদ্ধতির প্রচার ও প্রসার। মাঠপর্যায়ে জরিপের মাধ্যমে লবণ চাষে ব্যবহূত প্রকৃত জমির পরিমাণ, চাষির সংখ্যা ও মিল মালিকের সংখ্যা নির্ধারণ করে সিঙ্গেল ডিজিট হার সুদে লবণচাষি ও মিলমালিকদের পর্যাপ্ত ঋণ সহায়তা প্রদান। লবণচাষিদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধান এবং আপৎকালীন সময়ের জন্য বাফার স্টকের ব্যবস্থাকরণ। বিশেষ পরিস্থিতিতে চাহিদা অনুযায়ী দেশের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী লবণ আমদানি করা। স্বাস্থ্যসম্মত ভেজালমুক্ত, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, আয়োডিনযুক্ত লবণ উৎপাদন নিশ্চিতকরণ ও বাজারজাতকরণে সহায়তা প্রদান। উৎপাদিত লবণ সংরক্ষণ, সরবরাহ এবং বাজারজাতকরণের অবকাঠামোগত সহায়তা প্রদান। কিন্তু ২০১১ সালে জাতীয় লবণ নীতি প্রণয়নের পর দীর্ঘ ৮ বছর কেটে গেলেও তার সুফল দৃশ্যমান হচ্ছে না। জাতীয় লবণ নীতির সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমে চাষিদের লবণের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হলে লবণ আমদানি সীমিতকরণসহ শিল্পের নামে আমদানি করা লবণ খাওয়ার কাজে ব্যবহার বন্ধের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এখনই।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিমিটেড

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads