• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
শব্দদূষণ থেকে বাঁচতে চাই

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

বিনোদন কেন্দ্র

শব্দদূষণ থেকে বাঁচতে চাই

  • সোলায়মান মোহাম্মদ
  • প্রকাশিত ১৪ মার্চ ২০১৯

আমরা সবাই ব্যস্ত। নিজের জীবনকে সুন্দরভাবে সাজাতে অথবা জীবিকার তাগিদে সবাই সবার অবস্থান থেকে শশব্যস্ততার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করে থাকি। ব্যস্ততার কারণে আপনজনদেরও খোঁজখবর রাখতে পারি না। একে একে মাসের পর মাস শেষ হয়ে আসে, চলে যায় বছরের পর বছর। এভাবেই জীবনের সময়গুলো শেষ হয়ে যৌবন নদীর শেষ তীরে এসে পৌঁছে যায় নাগরিক মানুষ। তবে কাজের চাপে বা একই কাজ পুনশ্চ করার ফলে আমাদের মধ্যে একধরনের একঘেয়েমি বা বিরক্তবোধ কাজ করে। কর্মব্যস্ততায় নিজের মধ্যে অনেক সময় একধরনের মানসিক অবসাদ ও চাপেরও সৃষ্টি হয়। ফলে ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতায় ভুগতে হয়। ঠিক তখনই আমরা ঘুরতে বের হই। ভ্রমণে যাই। এ ভ্রমণ প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও হয়, আবার পারিবারিকভাবেও আমরা প্রত্যেকে যাই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে তো অবশ্যই বার্ষিক ভ্রমণ বা পিকনিকের আয়োজন করতে হয়। এ ছাড়া অনেকেই ঘুরতে খুব ভালোবাসেন। তাই অবসর সময়ে ছুটে বেড়ান দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তে। আর এসব কারণেই আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও গড়ে উঠেছে অগণিত বিনোদন কেন্দ্র বা পার্ক। মূলত ব্যবসায়িক চিন্তা মাথায় নিয়েই বিত্তশালীরা পিকনিক স্পটের সব সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে গড়ে তোলেন আধুনিক মানসম্মত বিনোদন কেন্দ্র। দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বিনোদন স্পটকেন্দ্রিক ব্যবসায়িক এসব প্রতিষ্ঠান। সাধারণত শীতকালেই এ ধরনের আনন্দ উৎসব বেশি হয়ে থাকে। জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ— এই তিন মাসই বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে উপচেপড়া ভিড় থাকে। পিকনিক স্পটগুলোও সারা বছরের আয় এই তিন-চার মাসেই একবারে করে নেয়।

কথা তা নয়, পিকনিক হবে, আনন্দ উৎসব ও বিনোদনের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই হবে। তাহলে ভাবছেন সমস্যা কোথায়? সমস্যা পরিবেশের, দূষণের। এ থেকে যেন কিছুতেই রেহাই নেই! এই তো সবেমাত্র ভাষার মাস শেষ হলো। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ছিল। যদিও আমাদের মধ্যে দিবসকেন্দ্রিক একটি কু-প্রবণতা তৈরি হয়েছে। তবু দিবসকে কেন্দ্র করে হলেও আমরা নিজেরা নিজেদের খুঁজে পাই। ভাষার জন্য অনেকেই জীবন দিলেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলো। দেশ স্বাধীন হলো। লাল-সবুজের স্বাধীন পতাকা আকাশে উড়ালাম। অর্থনৈতিকভাবেও এগিয়ে চলছি। কিন্তু যে ভাষাকে কেন্দ্র করে এতকিছু, তার সামান্যটুকু মানও আমরা রাখতে পারছি না। পারছি না বাংলা বর্ণমালাকে সালাম রফিক জব্বারের মতো ভালোবাসতে। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে নিজেদের হারিয়ে ফেলছি। পিকনিক বা আনন্দ উৎসবে গিয়ে হিন্দি গানেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। এমনকি একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবসের দিনও হিন্দি গানে মেতে উঠছি। যাদের বাড়ি কোনো পিকনিক স্পটের আশপাশে, কেবল তারাই অনুভব করতে পারবেন বছরের এই তিন-চারটি মাস ঠিক কী পরিমাণ শব্দদূষণের নির্যাতন সহ্য করতে হয়। দিনব্যাপী উচ্চশব্দে কান ঝালাপালা হয়ে ওঠে। উচ্চ শব্দে মাইক বাজানোর উন্মত্ততায় বাড়িঘর ছেড়ে দিতে মন চায়।

সাধারণত শব্দের সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৬০ ডেসিবেল। যদিও শব্দের গ্রহণযোগ্যতার কয়েকটি ভাগ রয়েছে। কিন্তু পিকনিক স্পট, বিয়েবাড়ি ও আশপাশের নানামুখী আনন্দ উৎসবে মাইকের যে শব্দ তা সবসময় ১০০ ছাড়িয়ে যায়। উচ্চমাত্রায় শব্দদূষণের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস, বধিরতা, হূদরোগ, আলসার ও বিরক্তিবোধ থেকে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। এ থেকে যে কোনো সময়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটে যেতে পারে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় শিশু ও বয়স্কদের। নিজেদের অধিকার ফলাতে গিয়ে সাধারণ মানুষের যে কত বড় ক্ষতি হচ্ছে, সেদিকটার বিন্দু পরিমাণও নজর নেই কারো। বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে সেই কাকডাকা ভোর থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলে গানবাজনা। আশপাশের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা পড়ার টেবিলে মনোযোগী হতে পারে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক শিক্ষা ভ্রমণেও কিন্তু সতর্কতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি টাকা বাঁচাতে ফিটনেসহীন গাড়ি করে দূরের কোথাও ভ্রমণে বের হয়ে অনেক সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়। শিক্ষার্থীদের আবদার রক্ষায় গাড়িতেই সাউন্ড বক্স বসিয়ে ডিজে বা হিন্দি গান বাজিয়ে উচ্চ শব্দে মহাসড়কেই গাড়ি ছুটে চলে। ওই সাউন্ড বক্সের শব্দে সড়কে চলন্ত অন্যান্য গাড়ির সাংকেতিক শব্দ স্বাভাবিকভাবেই চালকের না শোনার কথা, ফলে দুর্ঘটনা ঘটা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। একদিকে শব্দদূষণের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি, অন্যদিকে দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীদের জীবন ঝুঁকির দিকে ঠেলে না দিয়ে নির্দিষ্ট স্থানেই নির্দিষ্ট সময়ে আনন্দ করা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি।

শহরের মানুষগুলোর গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সবুজ-শ্যামল প্রকৃতিতে গড়ে ওঠা বিনোদন কেন্দ্রগুলোতেই বেশি আগ্রহী হয়ে থাকে। বড় বড় গ্রুপ বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বনভোজন বা আনন্দ উৎসবগুলো সাধারণত শুক্রবারই বেশি হয়ে থাকে। আমাদের গাজীপুরের গত কয়েকটি শুক্রবারের চিত্র তুলে ধরলে বোঝা যাবে ধর্মীয় কাজে কতটুকু বাধাগ্রস্ত হতে হয়। সাধারণত বেলা সাড়ে বারোটা থেকে দেড়টার মধ্যে মসজিদে মুসল্লিরা নামাজ শুরু করেন। তখনো পিকনিকে আসা বন্ধুদের উচ্চমাত্রায় সাউন্ড বক্স বাজিয়ে গান পরিবেশন থামে না। একদিকে ইমাম সাহেব মসজিদে খুতবায় দাঁড়ান; অন্যদিকে ভ্রমণে আসা বন্ধুরা মাইক বা সাউন্ড বক্স বাজিয়ে মহা আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, অনেক বন্ধুকে দেখা যায় নামাজ রেখে নামাজের সময়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দিয়ে কোরআন তেলাওয়াত করায়। অথচ পিকনিক স্পট তথা বিনোদন কেন্দ্রগুলোর কর্তৃপক্ষের একটু নজরদারি ও পরিকল্পনার অভাবে এ ধরনের অশোভনীয় ও অসঙ্গতিপূর্ণ অনুষ্ঠানমালা পরিচালিত হয়ে থাকে। নামাজ ও স্কুলের সময়ে কোনো ধরনের গানবাজনা চলবে না এমন নির্দেশনা থাকলেই কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া পিকনিকে আসা বন্ধুদেরও একটু ভেবেচিন্তে অনুষ্ঠানসূচি সাজাতে অনুরোধ করছি। বিনোদন কেন্দ্র মালিকদের পাশাপাশি সরকারের অবস্থান থেকে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক কিছু বিধিনিষেধ আরোপিত থাকলে শব্দত্রাস থেকে অনেকাংশেই রেহাই পাওয়া যেতে পারে।

 

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads