• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
সভ্যতার বিকাশে নারীর অবদান

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

সভ্যতার বিকাশে নারীর অবদান

  • আরাফাত শাহীন
  • প্রকাশিত ২৮ মার্চ ২০১৯

বাঙালির জাতীয় জীবনে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল বিষয় হলো মহান মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের জীবনে এই মহান সংগ্রামের যতটা ভূমিকা, অন্য কিছুতে তেমন নয়। দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রাম এবং অপরিসীম ত্যাগের ফলেই আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। এই মহান সংগ্রামে নারীদের যে বিশাল ভূমিকা আছে- তার কতখানি মূল্যায়িত হয়, সেটাও দেখার বিষয়। যুদ্ধের নয় মাসে দুই লাখ মা-বোন শুধু যে তাদের ইজ্জত বিলিয়ে দিয়েছেন তা নয়, তারা অস্ত্রহাতে যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। অস্ত্র সরবরাহ, চিকিৎসাসেবা, খাবার সরবরাহ এমনকি খবর সংগ্রহেও ভূমিকা রেখেছেন বাংলার নারীরা।  অগনিত নারী- স্ত্রী স্বামীকে, মা সন্তানকে সাহস এবং উৎসাহ দিয়ে যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। জীবন এবং নিজের সম্ভ্রমের নিরাপত্তার কথা কিছুমাত্র বিবেচনা না করে যুদ্ধের দিনগুলোতে আমাদের দেশের সংগ্রামী নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকেই নারীরা স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক এবং তাদের ত্যাগ ছিল অপূরণীয়। বিশিষ্ট গবেষক মালেকা বেগম তার এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বহুমাত্রিকভাবে নারীরা সেই যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। মুসলমান হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান- সব ধর্মের নারীই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কেবল বাঙালি নয়, সর্বাত্মকভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন আদিবাসী নারীরাও।’ স্বাধীনতার বহু বছর পেরিয়ে গেলেও নারীদের সেভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এ দায় আমরা কিছুতেই এড়াতে পারি না। তাদের এই আত্মত্যাগ আমরা কীভাবে ভুলে যেতে পারি!

সভ্যতার বিকাশে নারীর অবদান অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ইসলাম ধর্মের প্রাথমিক দিনগুলোতে নারীরা অভূতপূর্ব অবদান রেখেছেন। এমনকি ইসলাম ধর্মের জন্য সর্বপ্রথম যে মানুষটি জীবন দিয়েছিলেন, তিনিও ছিলেন একজন নারী। আমাদের এই সমাজের কিছু উন্নাসিক পুরুষ নারীর কর্মগুলোকে খাটো করে দেখতে অভ্যস্ত। হয়তো আমাদের সমাজব্যবস্থাই তাদের এমনটা ভাবতে প্ররোচিত করছে। কিন্তু সভ্যতা বিনির্মাণে নারীর অবদান আমরা কীভাবে অস্বীকার করতে পারি? আমাদের প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) হেরা গুহায় আল্লাহর বাণী পেয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী হজরত খাদিজা (রা.)-এর কাছে এসে যখন দাঁড়ালেন, তখন তিনি রসুল (সা.)-কে বিশ্বাস করে সর্বস্ব দিয়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন। ফলে পৃথিবীতে সভ্যতার ইতিহাস নতুনভাবে লেখা শুরু হলো।

আমাদের নারীরা পরিশ্রমী এবং সংগ্রামী। ফলে নানান ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে শেষ পর্যন্ত তারা টিকে থাকতে সমর্থ হন। নারীদের এই প্রবল পরিশ্রম এবং সংগ্রামের সময়ে তারা সত্যিকারার্থে একজন পুরুষকে সঙ্গী হিসেবে পাশে পেতে চান। কিন্তু সমাজ বাস্তবতায় দেখা যায়, পুরুষ সবসময় নারীর সহযাত্রী হয়ে তার পাশে থেকেছে এমনটা বলার উপায় নেই। বরং অনেক সময় দেখতে পাই, নারীর সহযাত্রী হওয়ার পরিবর্তে পুরুষ হয়ে ওঠে তার প্রতিদ্বন্দ্বী এবং চলার পথে সবচেয়ে বড় বাধা। নারীরা আমাদের এই সমাজের পুরোপুরি অর্ধেক অঙ্গ। একজন নারী তার নিজের জন্মের পর থেকে সংসার নামক বোঝা নিজের কাঁধের ওপর বহন করে চলেন। কেননা একজন নারী প্রথমত কন্যা হিসেবে পরিবারে তার ভূমিকা রাখেন, স্ত্রী হিসেবে ভূমিকা রাখেন এবং সর্বশেষ মা হিসেবে পরিবারে তার ভূমিকা থাকে অসামান্য।

বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিকভাবে বেশ অগ্রগতি সাধন করেছে। বিশ্বের বুকে আমরা আর গরিব দেশ বলে পরিচিত নই। বরং মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে সর্বত্র আমরা বিবেচিত হচ্ছি। আমাদের এই অর্থনৈতিক অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছেন আমাদের নারীরা। এদেশের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার সবচেয়ে বেশি আসে তৈরি পোশাক শিল্পের মাধ্যমে। গার্মেন্টগুলোর শ্রমিকদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এই যে তৈরি পোশাক খাতে নারীদের এতটা অবদান, কিন্তু আমরা তাদের কাজকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারছি তো?

জীবিকার তাগিদে নারীরা আজ সব পেশাতেই নিজেদের নিয়োজিত করছেন। এটা সমাজের অগ্রগতির জন্য অবশ্যই একটা ভালো দিক। তবে তাদের নিরাপত্তা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। তারা যেন পুরুষের লালসার শিকার না হন, সেদিকে লক্ষ রাখা এই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আমাদের সংগ্রামী নারীরা আজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে কাজের সন্ধানে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। তবে তাদের এই পথচলা মোটেও মসৃণ নয়। বরং তাদের প্রতি পদে পদে বিপদের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বিদেশ থেকে ফিরে আসা নারীরা তাদের যে অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছেন, তাতে আমরা শিউরে না উঠে পারছি না। তাদের বিদেশযাত্রা নিরাপদ করতে হবে। এ ব্যাপারে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

শিক্ষাক্ষেত্রে নারীদের অগ্রযাত্রা সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। বিগত বছরগুলোতে পাবলিক পরীক্ষায় ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ভালো রেজাল্ট এটাই প্রমাণ করে যে, এখানে তারা অনেকটাই এগিয়ে। একসময় দেশে নারী ডাক্তারের ব্যাপক সঙ্কট ছিল। প্রসূতি নারীরা প্রসবকালীন খুবই সমস্যার সম্মুখীন হতেন। এ অবস্থা থেকে এখন উত্তরণ ঘটছে। মেডিকেল শিক্ষায় নারীরা ব্যাপকভাবে এগিয়ে আসছেন। শুধু শিক্ষাক্ষেত্রেই নয়, খেলার মাঠেও আমাদের নারীরা আজ সমানতালে তাদের উপস্থিতি জানান দিয়ে যাচ্ছেন। নারীরা আজ বিশ্বের বুকে আমাদের লাল-সবুজের পতাকা পতপত করে উড়িয়ে চলেছেন। এই সংগ্রামী নারীরা আমাদের সর্বক্ষেত্রে গর্বিত করছেন।

এদেশের নারীদের এগিয়ে চলা কোনোভাবে খুব একটা মসৃণ নয়। নানা প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছেন আমাদের সংগ্রামী ও সাহসী নারীরা। তবে এখনো তারা সব জায়গায় এগিয়ে আসতে পারেননি। এজন্য তাদের ভীরু মনোভাব যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী পুরুষের অসহযোগিতামূলক মনোভাব। এই পুরুষরাই নারীদের নির্যাতন করছে। নারী তার নিজ ঘর থেকে শুরু করে অফিস-আদালত, রাস্তাঘাট এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এই সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো আবশ্যক। আমরা যদি নারীদের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করি, তাহলে সভ্যতার অগ্রগতিও থেমে যাবে। সবাইকে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। এই সমাজ, এই দেশ এবং সর্বোপরি এই পৃথিবী আমাদেরই। একে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা আমাদেরই কর্তব্য।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads