• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

ফিরে আসুক তাঁত শিল্পের হারানো ঐতিহ্য

প্রয়োজন প্রণোদনা ও আধুনিকায়ন

  • প্রকাশিত ০৮ এপ্রিল ২০১৯

তাঁত শিল্পের ইতিহাস অতি প্রাচীন এবং দেশের সর্ববৃহৎ কুটিরশিল্প এটি। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত আছে এদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। অথচ ১৯৯০ সালের আগেও হস্তচালিত তাঁত শিল্পের জৌলুস ছিল। তখন দেশের সর্ববৃহৎ কুটিরশিল্প হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন তাঁতিরা। জানা যায়, তাঁত শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ নিয়োজিত ছিল। কর্মসংস্থানের দিক থেকে কৃষি ও গার্মেন্ট শিল্পের পরেই তৃতীয় বৃহত্তম এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থানের দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত ছিল তাঁত। কিন্তু কালের বিবর্তনে ভিনদেশি পোশাকের ব্যাপক প্রভাবে তাঁত কাপড়ের প্রতি নতুন প্রজন্মের আগ্রহ কমে যাওয়ায় চাহিদাও হ্রাস পায় এবং উৎপাদনে ভাটা পড়ে। আরো একটি বড় কারণ হলো, এই শিল্পের বিকাশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, কাঁচামাল ও উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি, দেশি কাপড়ের বাজার তৈরিতে সঙ্কট, নতুন প্রযুক্তির যন্ত্রচালিত তাঁতের সঙ্গে সক্ষমতায় পেরে না ওঠা, বিপণন ব্যর্থতা, যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের অভাব ও পুঁজিসঙ্কটে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিরাট সম্ভাবনাময় হস্তচালিত তাঁত শিল্প। প্রধানত আধুনিকায়ন ও পৃষ্ঠপোষকতা-প্রশিক্ষণের অভাবে তাঁত শিল্প ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁতিরা।

একটি দেশ যখন সবদিক দিয়ে উন্নতির দিকে এগিয়ে যায়, তখন তার ঐতিহ্য ধারণকারী শিল্পগুলোর দিকে বেশি নজর দিতে হয়। আমাদের ক্ষেত্রে হয়েছে ঠিক উল্টো বিষয়। উন্নয়নের নামে আমরা ঐতিহ্যকে অবহেলা করলে এই জাতির স্বকীয়তা বলে আর কিছু থাকবে না। দেশে উন্নত প্রযুক্তি আসবে, সেই প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সব শিল্পের চাকা সচল থাকবে নতুন ও আধুনিকায়নের ধারায়। যেমন বাংলাদেশে বিদেশি পোশাকের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজেদের অবস্থান তৈরি করছে বুটিক শিল্প। এই শিল্পটি আধুনিক বিশ্বের অধিবাসী নতুন প্রজন্মের রুচি অনুযায়ী বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধারণ করছে তাদের তৈরি পোশাকের নৈপুণ্যতায়। সে তুলনায় আমাদের তাঁত শিল্প সনাতনি বা লোকজ ঐতিহ্যের ধারক হওয়ার কারণে পিছিয়ে পড়েছে। তবে তাঁত শিল্পের ঐতিহ্য ও অর্থনীতিতে অবদান অনস্বীকার্য। এখন সরকারের উচিত দেশের এই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শিল্পটিকে সংস্কারের মাধ্যমে আধুনিকায়নে সবরকমের সহায়তা করা। কেননা সরকার চাইলেই এই শিল্পটির পুনর্জাগরণ ঘটতে পারে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ দুটি তাঁত শুমারি (১৯৯০ ও ২০০৩) অনুযায়ী, ১৯৯০ সালে যেখানে দেশে মোট দুই লাখ ১২ হাজার ৪২১টি তাঁতকল ছিল, সেখানে ২০০৩ সালে কমে দাঁড়ায় এক লাখ ৮৩ হাজার ৫১২টিতে। অর্থাৎ তাঁতকলের সংখ্যা ক্রমেই কমছে।

জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজনের দিক দিয়ে অবদান ছিল এক হাজার ২২৭ কোটি টাকারও বেশি। দেশে সবচেয়ে বেশি তাঁত গড়ে উঠেছে সিরাজগঞ্জ, পাবনা, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, যশোর, কুষ্টিয়া, ঢাকা ও দেশের পাহাড়ি অঞ্চলে। এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফরিদপুর, পটুয়াখালী ও বরিশালসহ কিছু এলাকায় তাঁত শিল্প আছে। এ ছাড়া পাহাড়ি অঞ্চলেও রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতির তাঁত শিল্প। এর মধ্যে অনেক তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হয়েছেন দক্ষ তাঁতিরা। অথচ বংশপরম্পরায় এরাই এই শিল্পটির ধারক ও বাহকের ভূমিকা রেখেছে। তাই আমরা যতই উন্নত হই না কেন, এই ঐতিহ্য হারালে আমরা গৌরবহীন উন্নয়নকে উপভোগ করতে পারব না। কেননা একটি দেশের শিল্প-সংস্কৃতি কেবল অর্থনীতিতেই অবদান রাখে না, দেশের সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দেয় বিশ্বদরবারে।

উন্নত বাংলাদেশের অভিযাত্রায় এটি কোনো ভালো খবর নয়। তবে আশার খবর হলো, তাঁতিদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এই শিল্পে ধরে রাখতেই সরকার কিছু উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। তাঁতিদের ঋণ বিতরণের হার বাড়ানো হচ্ছে। ‘তাঁতিদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে চলতি মূলধন সরবরাহ ও তাঁতের আধুনিকায়ন’ প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন সুবিধা পাবেন তাঁতিরা। আমাদের প্রত্যাশা, প্রকৃত তাঁতিরা যেন সবরকম সুবিধা পায়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads