• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
পাঠাভ্যাসই অনেক সুন্দর অভ্যাসের জন্ম দেয়

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

পাঠাভ্যাসই অনেক সুন্দর অভ্যাসের জন্ম দেয়

  • মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশিত ১৬ এপ্রিল ২০১৯

মানবজীবনের সামগ্রিক উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বইয়ের কথা উল্লেখ করে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, ‘মানুষ জন্মায় প্রাণী হয়ে। সেটা এক ধরনের মানুষ। আরেক ধরনের মানুষ হচ্ছে বিকশিত মানুষ। মানুষের বিকাশের জন্য বই পড়লেই হবে। কারণ যে বই পড়ে, সে কবিতা পড়ে, গান শোনে, চিত্রকলা বোঝে। পূর্ণিমার আলো, নীল আকাশ- সবই বোঝে।’ বইকে নানা মনীষী নানা অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন। তবে সবার কথার মিলিত সুরটি হচ্ছে বই পড়ার আনন্দ এবং আহরণের বিষয়টি। বই পাঠে যা অর্জন করা যায, তা অন্য কোনো বিষয় থেকে পাওয়া যায় না। বিজ্ঞান-অর্থনীতি বা সামাজিক সূচকে যতই উন্নতি করা হোক না কেন, বই পাঠে যা অর্জিত হয়, তার কোনো তুলনা নেই। কোন জাতি সভ্যতার কোন সোপানে অবস্থান করছে তা পরিমাপ করা হয় সেই জাতির পাঠাভ্যাস এবং গ্রন্থাগারের মাপকাঠি দিয়ে। সভ্যতার এই পরিমাপটি যুগ যুগ ধরে স্বীকৃত হয়ে আসছে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে-অর্থনীতিতে। উন্নত দেশগুলোতে পাঠাগারের নান্দনিক অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। কোনো কোনো দেশের সমৃদ্ধ লাইব্রেরিগুলোকে বলা হয়ে থাকে ত্রিকালের সিঁড়ি বা জীবিত ও পরলোকগত মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। বিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হয়েছে, সেসব উন্নতির ঢেউ আমাদের দেশে লেগেছে। কিন্তু এত পরিবর্তনের স্রোতের মুখেও বইয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণ এখনো বিলুপ্ত হয়নি। বইপড়ার বিকল্প তৈরি হয়নি। ছাপার অক্ষরের পরিবর্তে এসেছে ‘ই-বুক’। যে প্রকরণেই থাকুক না কেন, বই থেকে যাবে। আমরা জ্ঞাননির্ভর যে সমাজের কথা বলি, তা নির্মাণে বই পাঠের কোনো বিকল্প নেই। বই পাঠের অভ্যাস বাড়াতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন পাঠাগারের সংখ্যা বাড়ানো এবং সেসব পাঠাগারে পাঠের সুযোগ বাড়ানো। আমাদের বর্তমানের পাঠাগারগুলোকে যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে।

দেহ, মন ও আত্মার প্রশান্তি ও সামঞ্জস্যপূর্ণ বিকাশের নামই শিক্ষা। আর এই শিক্ষার প্রধান উপকরণ হচ্ছে বই। বই জ্ঞানের বাহক ও আনন্দের প্রতীক। ভালো বই মানুষের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করে। বইয়ের আকর্ষণ আদিম আকর্ষণের মতোই দুর্বার। এর মাধ্যমেই প্রতিভার স্পন্দন অনুভূত হয়। বই পবিত্র এক আলোকদীপ্তি। আলোকিত মানুষ ও সুশীল সমাজ গড়তে জ্ঞানচর্চা ও এর উপকরণ যেমন— বই, পত্রিকা, সাময়িকী ইত্যাদি সংরক্ষণের কেন্দ্র হচ্ছে পাঠাগার বা গ্রন্থাগার। এটি শক্তি, সৌষ্ঠব, বুদ্ধিবৃত্তি ও জ্ঞানের ভান্ডার যা মানসিক শক্তির বিশাল সরোবর। গ্রন্থাগার মানুষের জীবনে এক শাশ্বত আলোর উৎস যা আলোকিত করে তোলে মানুষকে আর তাদের আলোয় আলোকিত হয় সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব। গ্রন্থাগার প্রকৃত অর্থেই দেখাতে পারে আলোর ঠিকানা। নেশার কবল থেকে মানুষকে ফেরাতে পারে সুস্থ জীবন। শেখাতে পারে বাস্তবতা এবং মুক্ত ও মানবিক চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করে নির্মূল করতে পারে ধর্মীয় গোঁড়ামি, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও মানসিক বিকাশে প্রতিটি স্কুল, কলেজ, ইউনিয়ন, গ্রাম, পাড়া-মহল্লায় গ্রন্থাগার স্থাপন করা দরকার। সেখানে সব বয়সের মানুষ পত্রিকা, গল্প, উপন্যাস, ধর্মীয় বই, খেলাধুলার বই, ভ্রমণকাহিনী, বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনীগ্রন্থ পড়ার সুযোগ যাতে পায়। এভাবে পাঠাভ্যাস গড়তে পারলে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হবে সৃজনশীল চেতনার। খারাপ সঙ্গ, নেশা, আড্ডা এগুলো তারা বাদ দিয়ে পড়ার জগতে, বইয়ের জগতে প্রবেশ করবে। গ্রন্থাগারই তাদের দেখাতে পারবে সঠিক আলোর ঠিকানা, উদ্বুদ্ধ করবে মানবিক চেতনায়। তাই জ্ঞান, আলো ও হ্রদয়ের প্রশান্তির জন্য বই হোক শ্রেষ্ঠ বন্ধু এবং বই হোক নিত্যদিনের সঙ্গী।

মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিষবাষ্পে আক্রান্ত গোটা সমাজ। মাদকের থাবায় আক্রান্ত হতাশাগ্রস্ত তরুণ সমাজ ধীরে ধীরে পা বাড়ায় অপরাধের দিকে। খুন, টেন্ডারবাজি, রাজনৈতিক মাস্তানি, জমি দখল ইত্যাদি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সন্ত্রাসীরা অনেকেই ভাড়ায় খাটে। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে একটি গোষ্ঠী তরুণদের ব্যবহার করে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও পদ্ধতিকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা করছে। ফুটবলের রাজা পেলের মতো মানুষের পেটের খোরাকের সঙ্গে সঙ্গে মনের খোরাকও জোগাতে হয়। খাঁটি স্বর্ণ দিয়ে যেমন গহনা হয় না, প্রয়োজন হয় খাদের; তেমনি পরিপূর্ণ মানুষ হতে শিক্ষার পাশাপাশি খেলাধুলা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি পাঠ্যক্রমবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকাও আবশ্যক। আমাদের সমাজে বর্তমানে খেলার মাঠ, বিনোদন কেন্দ্র, গ্রন্থাগার ইত্যাদির রয়েছে যথার্থ অপর্যাপ্ততা। ফলে ছাত্রছাত্রী ও তরুণ প্রজন্ম প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত চাপ, পুরনো ধাঁচের শিক্ষাব্যবস্থা ও মুখস্থ বিদ্যার প্রভাবে ছেলেমেয়েদের মধ্যে অল্প বয়সেই পড়াশোনার প্রতি এক ধরনের অনীহা সৃষ্টি হয়। বই পড়ার প্রতি আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আগ্রহী করে তোলার জন্য আমাদের প্রাণের বই মেলা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, আমাদের সৃজনশীল প্রকাশক, স্বনামধন্য ও নতুন নুতন লেখকরা প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করছেন।

বই পড়া সম্পর্কে বিল গেটস বলেছেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। আর এই স্বপ্ন পেয়েছিলাম বই থেকে। আপনারা যদি আমার ঘরে যান, দেখবেন বই; অফিসে যান, দেখবেন বই; যখন আমি গাড়িতে থাকি, আমার সঙ্গে থাকে বই।’ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পড়তে খুব পছন্দ করেন। সাহিত্যের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসার প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে তার লেখা ‘ড্রিমস ফ্রম মাই ফাদার’ বইটিতে। সেখানে এক জায়গায় তিনি বলেছেন, ‘সাপ্তাহিক ছুটির দিনে যখন আমার কোনো কাজ থাকে না, তখন নিজের শূন্য অ্যাপার্টমেন্টে বই-ই হয় আমার একমাত্র সঙ্গী।’

আজকাল ছেলেমেয়েরা যারা সফল হতে চায়, বড়লোক হতে চায়, নাম করতে চায়, মানুষের উপকার করতে চায়— বিল গেটসের এই উপদেশ তাদের কাজে লাগবে। ‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি, দুটি যদি জোটে তবে একটিতে ফুল কিনিও হে অনুরাগী’— কবির এই কথা কী আমরা ভুলে গেছি? আমরা যদি মাসে ৩০০-৫০০ টাকার মোবাইল বিল দিতে পারি, তা হলে বছরে কেন দুই হাজার টাকার বই কিনব না? আমাদের যদি সোয়া কোটি ফেসবুক গ্রাহক থাকে, তাহলে কেন অন্তত সোয়া কোটি বই বিক্রি হবে না? স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে বই দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হোক। উদ্যোগের অভাবেই দেশে আশানুরূপ পাঠক বাড়েনি।

বইপড়া সম্পর্কে বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময় লেখক হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, ‘বই পড়া যায় না, নিজেকে পড়তে হয়। মনোযোগ দিয়ে পড়তে হয়। বুঝতে হয়, জ্ঞান বা শিল্পকলার প্রতি আকর্ষণ থাকতে হয় এবং বই পড়ে হাতে নগদ আমরা কিছু পাই না। একটি ফাইল চাপা দিয়ে এক লাখ টাকা রুজি করতে পারি, যদি মন্ত্রী হই, তা হলে স্ত্রীর নামে পঞ্চাশ কোটি টাকার জমি পাঁচ হাজার টাকায় নিতে পারি, এমনকি একটি পোক্ত ক্যাডার হলেও দিনে দশ হাজার টাকা অর্জন করতে পারি। আমাদের রাষ্ট্র যারা চালায়— মন্ত্রী, আমলা, বিচারপতি, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সেনাপতি এবং অন্যরা বই পড়েন না; কেননা তাতে কোনো আশু লাভ নেই; বরং পড়া বেশ কষ্টের কাজ; আর শিল্পকলা ও জ্ঞানে গুলশান বারিধারায় প্রাসাদ ওঠে না।’ আমাদের এই মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আর সেজন্য প্রয়োজন পাঠাভ্যাস বাড়ানো।

কোনো কাজে সাফল্য অর্জন করতে হলে মনোযোগ সহকারে সেই কাজটি করা একান্ত প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আমাদের বই পড়া যথেষ্ট সাহায্য করে। প্রতিদিন বই পড়লে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে উন্নতি ঘটে মনোযোগ ক্ষমতারও। যারা অ্যাটেনশন ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোমে ভুগছেন, তারা বই পড়া শুরু করলে উপকার পাবেন। পরিস্থিতি পুরোটাই পাল্টে যাবে। বই পড়ার সময় মস্তিষ্কের মধ্যে থাকা হাজারো নিউরন বেশি বেশি করে কাজ করতে শুরু করে। ফলে সার্বিকভাবে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ অবস্থায় একদিকে যেমন বুদ্ধির বিকাশ ঘটে, তেমনি নানা ধরনের ব্রন ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কমে যায়। সারাদিন কাজের পর ৬০-৭০ শতাংশ মানুষই মন-মেজাজ চাঙা করতে টেলিভিশন দেখেন। বিজ্ঞানের ভাষ্যমতে, মন ও মস্তিষ্কের ক্লান্তি দূর করতে টেলিভিশনের পরিবর্তে বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা প্রয়োজন।

 

লেখক : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads